Powered By Blogger

Monday, April 22, 2024

প্রবন্ধঃ কেউ সুখী নয়।

কেন কেউ সুখী নয়? সুখের চাবিকাঠি কি? অর্থ, মান, যশ, ক্ষমতা, খ্যাতি, প্রতাপ, প্রতিষ্ঠা, প্রভাব, প্রতিপত্তি ইত্যাদি? আচ্ছা এই সমস্ত কিছু কম বা বেশি যাদেরই আছে তারা কি সুখী? রাজনীতি, ধর্ম্ম, সাহিত্য, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প, আইন, চিকিৎসা, শিক্ষা, গল্প, উপন্যাস, গান, নাটক, সিনেমা, অভিনয়, আঁকা ইত্যাদি ইত্যাদি সবক্ষেত্রের অবস্থানকারী প্রতিষ্ঠিত মানুষেরা কি সুখী? শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে কি সুখী?
যারা গরীব, যারা নিম্নবিত্ত, যারা দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী এমনকি মধ্যবিত্তও, যারা জীবনে ব্যর্থ অসফল, যারা অক্ষম, যারা সরকারী, বেসরকারি, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ইত্যাদি সবরকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, অবহেলিত, পদদলিত, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, অপমানিত, বিতাড়িত এবং রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা দলিত পীড়িত তারা প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত তাই তারা সুখী না হ'তেই পারে। সুখ, শান্তি, আনন্দ তাদের কাছে অলীক স্বপ্ন মাত্র। সুখ, শান্তি, আনন্দ তাদের কাছে বিলাসিতা। তবুও তারা তথাকথিত ঝাঁ চকচকে, লোক দেখানো, নকল, কৃত্রিম, কপট, মিথ্যে অভিনয় সমৃদ্ধ সুখের পরিবর্তে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কারের পাহাড় প্রমাণ জঞ্জালের স্তুপের মধ্যে তাদের মতো ক'রে অলৌকিকতায় ভরা শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে অসুখের মাঝেও সুখী, তাদের মতো ক'রে অশান্তি ও নিরানন্দের মাঝে শান্তি ও আনন্দ খুঁজে নেয়, নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারাও সুখী নয়। এই সুখী না থাকার তবুও একটা পিছনের ইতিহাস আছে, যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।
কিন্ত যারা উচ্চবিত্ত, বিত্তশালী তারা কি সুখী? যারা জীবনে অর্থ, মান, যশ, ক্ষমতা, প্রতাপ, প্রভাব, প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যারা প্রতিপত্তিতে সমাজের উচ্চবর্গের মানুষ তারা কি সুখী? আর যারা ধর্মাত্মা, ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন তারা কি সুখী?
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়ে বেঁচে থাকাই কঠিন, সুখী হওয়া তো দূরের কথা। সেই অর্থে কেউই সুখী নয়। সুখ ও দুঃখ দু'টোই ভাব। একটাকে তাড়ালে আর একটা এসে পড়ে। ভাবের যখন অভাব ঘটে তখন সুখ শান্তি দু'টোই নষ্ট হয়। সুখ সুখ ভাবকে জীবন থেকে তাড়িয়ে দিলে অসুখ এসে পড়ে আর তা শরীরে ও মনে বাসা বাঁধে ও ঘূণ পোকার মতো তা বৃদ্ধি পায়। আর ঘূণ পোকার যা কাজ ভিতর থেকে কাঠকে কুরে কুরে খাওয়া ও ঝরঝরে ক'রে ফেলা। ঠিক তেমনি সবসময় কারণ-অকারণ, যৌক্তিক-অযৌক্তিক, সত্য-মিথ্যা ও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে দুঃখ দুঃখ ভাব মনে বাসা বাঁধার জায়গা পেলে শরীরকে ঘূণপোকার মতো ভিতর থেকে ঝাঁঝরা ক'রে দেয়। সবসময় দুঃখের কথা বলা মানুষকে আবার মানুষ পছন্দ করে না। এমনিতেই অন্যের দুঃখ, কষ্ট, সমস্যার কথা শোনবার ইচ্ছা ও সময় দু'টোর একটাও নেই মানুষের। হয় নিজেই সমস্যার বেড়াজালে মাথার ঘায়ে কুকুরের পাগলের মতো অবস্থা; নতুবা অর্থ, মান, যশ, প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা, খ্যাতি, প্রতাপ, প্রভাব, প্রতিপত্তি ইত্যাদির অহংকারে মত্ত তাই গরীবের, সাধারণ মানুষের জন্য সময় ও ইচ্ছা কোনওটাই নেই, নেই কারণ সেটা স্ট্যাটাস সিম্বল এলাও করে না।
এদের জন্য শেষের সেদিন ভয়ংকর। কর্মফল কাউকেই ছাড়ে না। অন্যকে শরীরে মনে কষ্ট দিয়ে, যন্ত্রণা দিয়ে, অপমান, লাঞ্ছনা, অত্যাচার, অপদস্ত ক'রে, অন্যকে ঠকিয়ে, প্রবঞ্চনা ক'রে, অন্যের প্রাপ্য হক মেরে দিয়ে, অন্যের সম্পত্তি লুট ক'রে, অসৎ পথে, অন্যায় পথে অর্থ রোজগার ক'রে, অন্যকে ষড়যন্ত্র ক'রে নানা কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে, অন্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অন্যের মান, সম্মান নষ্ট ক'রে, ইজ্জত লুটে নিয়ে বহাল তবিয়তে তুমি আরাম সুখ শান্তি মস্তি ভোগ ক'রে এ পৃথিবী থেকে হাসতে হাসতে বিদায় নেবে সে আশা দুরাশা, সে স্বপ্ন অলীক, সে গুড়ে বালি। আর সেই অসৎ অন্যায় পথের রোজগার, যে রোজগারে অন্যের কষ্ট যন্ত্রণাবিদ্ধ দীর্ঘশ্বাস, বঞ্ছনার অভিশাপ লেগে আছে তাও থাকবে না অবশেষে। কথায় আছে, উৎপাতের ধন চিৎপাতে যায়। আর কর্মফল ভুগতেই হবে। কড়ায় গন্ডায় সুদে আসলে হিসাব দিয়ে যেতে হবে সবাইকে তা সে ধনী দরিদ্র, পন্ডিত লেন্ডিত, আস্তিক নাস্তিক, ধার্মিক অধার্মিক সে যেই-ই হ'ক না কেন আর যতবড় যোগী, ধ্যানী, গোঁসাই, গোবিন্দ, সাধু, সন্ন্যাসী ও যত ছোটো বড়, নামকরা প্রতিষ্ঠিত, ভক্ত সৎসঙ্গী হও না কেন। কথায় আছে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।
তাই The greatest phenomenon of the world SriSri Thakur Anukul Chandra বলেছিলেন, "তুমি যা করছো বা ক'রে রেখেছো ভগবান তাই-ই গ্রাহ্য করবেন আর সেগুলির ফলও পাবে ঠিক তেমনি। যা ইচ্ছা তাই করবে তুমি তা করলে রে চলবে না, ভালো ছাড়া মন্দ করলে পরিস্থিতি ছাড়বে না।"
শ্রীশ্রীঠাকুরও সুখী ছিলেন না। শ্রীশ্রীঠাকুর সুখী ছিলেন না শারীরিক ও মানসিকভাবে; তার কারণ আমরাই। আমাদের জন্যই তিনি সুখী ছিলেন না। আমাদের প্রতিমুহূর্তের ভুল চলনার ফলে আগত ভয়ংকর বিপদের জন্য তিনি অস্থির হ'য়ে থাকতেন সবসময়। আমাদের কষ্ট যন্ত্রণার কথা ভেবে, ভবিষ্যত নিশ্চিত বিপদের কথা ভেবে তিনি ঘুমোতে পারতেন না। সবসময় দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় কাটতো তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত। তাঁর নিজের কোনও কারণের জন্য তিনি অসুখী ছিলেন না। তিনি জীবনে সুখ পাননি। তিনি বলতেন, আমি যদি জানতাম জগতে মানুষের এই সীমাহীন কষ্ট, যন্ত্রণা, দুঃখ দুর্দশার হাত থেকে নিরাময়যোগ্য সমাধান এমনকি অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনও সমাধান নেই তাহ'লে যত না কষ্ট আমার তার থেকে হাজার গুণ কষ্ট যন্ত্রণা আমার যে, মানুষের এই কষ্ট, যন্ত্রণা ও অকাল মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় আমার জানা থাকা সত্ত্বেও আমি রক্ষা করতে পারছি না। এ কষ্ট আমি কোথায় রাখবো, কাকে বলবো তা আমার জানা নেই। আমি আপনাদের যতটা দ্রুততার সঙ্গে এর থেকে উদ্ধার পাবার জন্য তৎপর হ'তে বলেছিলাম আপনারা ততটাই শিথিলতার সঙ্গে আমার কথা অমান্য করলেন।"
তিনি কষ্ট পেয়েছেন আজীবন আমাদের জন্য। আমাদের সৎসঙ্গীদের তিনি সোনার সৎসঙ্গী ব'লে মনে করতেন আর বলতেনও তাই। কিন্তু আমরা সোনার সৎসঙ্গী তো দূরের কথা সব গেরুয়াধারী ভন্ড সন্ন্যাসীর মতো সাদা রঙের সাজা সৎসঙ্গী। চলন আপাদমস্তক রিপুতাড়িত প্রবৃত্তিমুখী।
আর, শ্রীশ্রীঠাকুরের মতো এই একই কষ্ট পেয়েছেন ও পাচ্ছেন পূর্বের ও বর্তমানের শ্রীশ্রীআচার্যদেব।
আমরা সুখী ন'ই তাঁর কারণ আমরাই। আমাদের ভন্ডামী, কপট চলনের জন্যই আমরা তা সে দীক্ষিত অদীক্ষিত সে যেই হ'ক, যত বড় ভক্ত হ'ক আর যত বড় প্রতিষ্ঠিত মানুষ হ'ক না কেন পৃথিবীতে কেউ সুখী ন'ই। এ সত্য হ'লেও এ কথা ভন্ড ও কপট ব্যক্তিদের কাছে অপ্রিয়। অপ্রিয় সৎসঙ্গীদের কাছেও।
তাই পরমপিতা কাউকেও ভালো রাখতে পারেন না, আমরা কেউ সুখী হ'তে পারি না যদি না আমরা অকপট, সৎ, প্রকৃত ও ভালো মনের, ভালো হৃদয়ের সৎসঙ্গী না হ'ই, ঠাকুর ঠিক যেমনটি চান তেমনটি না হ'ই ও আমার পরিবার ও চারপাশ ভালো না হয়, ভালো না থাকে।
যৌবন চলে যাবে হয়তো রক্তের জোরে কিন্তু বার্ধ্যক্য বলছে, আমি আসছি, খুব শিগগিরই আসছি, বার্ধ্যক্যের দিনগুলি আর শেষের সেদিন তোমাদের প্রত্যেকের ভয়ংকর।
প্রকাশ বিশ্বাস।
ভদ্রকালী, উত্তরপাড়া।
#প্রকাশবিশ্বাস।
( লেখা ১৫ই অক্টোবর, ২০২৩ )

No comments:

Post a Comment