পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীঅবিনদাদার পরিচালনায় বর্তমানে ঈশ্বর আরাধনায় সৎসঙ্গের সঙ্গীতের যে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, আধ্যাত্মিক জগতে যে বিপ্লব ঘটেছে তা' নিয়ে সৎসঙ্গ জগত ও আধ্যাত্মিক জগতে ভালোমন্দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য ক'রে চলেছি। আর, এর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি সোশ্যাল মিডিয়ার নানা প্ল্যাটফর্মে।
সঙ্গীত ঈশ্বর আরাধনার, ঈশ্বর সাধনার, ঈশ্বরের সঙ্গে যোগসূত্র রচনা করার, ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ করার, ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভব করার, ঈশ্বর ধ্যানে মগ্ন থাকার, ঈশ্বর উপলব্ধি ও ঈশ্বর দর্শন লাভ করার এক ও একমাত্র সহজ উপায় ও মাধ্যম। সঙ্গীতের মধ্যে ঈশ্বর অবস্থান করেন। যে সঙ্গীতে ঈশ্বরের মূর্চ্ছনা আসে না, সৃষ্টি সুরের সুমধুর কম্পনবিশেষ অনুভূত হয় না শরীরে-মনে- প্রাণে-হৃদয়ে, শরীরের শিরায় শিরায়, রুধিরাতে সৃষ্টির নাম তরঙ্গ ব'য়ে না যায় সেই সঙ্গীত, সঙ্গীত নয়। সঙ্গীতের অসীম শক্তি যে কি তা আমরা সঙ্গীত সম্রাট তানসেনের সঙ্গীত ইতিহাস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আছি। সম্রাট তানসেনের সঙ্গীত প্রকৃতিকে বাধ্য করতো তাঁর ইচ্ছার দাস হ'তে, এতটাই ছিল তানসেনের তীব্র প্রকৃতি প্রেম অর্থাৎ ঈশ্বর প্রেম। তানসেন যেমন দীপক রাগ গেয়ে বহ্নিশিখা ছড়িয়ে দিতেন প্রকৃতির বুকে ঠিক তেমনি যথাসময়ে মেঘমল্লার গেয়ে আকাশের বুক থেকে বৃষ্টি ঝড়িয়ে সব শান্ত ক'রে দিতে ভুলতেন না। এতটাই ছিল তাঁর সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগের ওপর অভূতপূর্ব অকল্পনীয় নিয়ন্ত্রণ। তাঁর সঙ্গীতের প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমপর্ণে ঈশ্বর নিজেই তাঁর সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্প সঁপে দিয়েছিল তাঁর কন্ঠে, মা সরস্বতী তাঁর কন্ঠে আশ্রয় নিয়েছিল ঈশ্বরের আদেশে। এর থেকে প্রমাণ হয় ঈশ্বর আরাধনার জন্য সঙ্গীত এক মোক্ষম অস্ত্র।
আমরা যুগ যুগ ধ'রে ঈশ্বর আরাধনার সঙ্গীত শুনে এসেছি। তা'তে মুগ্ধ হয়েছি, মোহিত হয়েছি, ঈশ্বর আরাধনায় মগ্ন হয়েছি। আমরা যুগ যুগ ধ'রে কত রকমের গানের সঙ্গে কিংবা এককভাবে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে কত রকমের নৃত্য পরিবেশন হ'তে দেখেছি। ভারতীয় নৃত্য সাধারণত ধ্রুপদী এবং লোক নৃত্যের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে আধা ধ্রুপদী ও উপজাতীয় নৃত্যে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়। ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকারের নৃত্যের উদ্ভব হয়েছে। আমরা সেই নৃত্য দেখে বিহ্বল হয়েছি, উদ্বেলিত হয়েছি।
আবার যখন আমরা নটরাজের নৃত্য দেখেছি। ঐশ্বরিক মহাজাগতিক নর্তক, নৃত্যের ঈশ্বর নটরাজ শিবের তান্ডব নৃত্য দেখেছি। তার সঙ্গে দেখেছি নটরাজের লাস্য নৃত্য। ঈশ্বর কাল-মহাকাল বেশে বিশ্বধ্বংসের জন্য এই নাচ নাচেন। লাস্য হল মধুর ও সুচারু নৃত্যকলা। লাস্যকে তাণ্ডবের নারীসুলভ বিকল্প বলে ধরা হয়। নটরাজের মূর্তির মধ্যে এই দুই রূপই বিদ্যমান। এই নাচ দেখতে দেখতে আমরা আবেগে ভাবাবেশে ডুবে গেছি, আচ্ছন্ন হয়েছি, আসক্তি-অনুরাগ আমাদের নৃত্যের উৎসের প্রতি অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি সমাধিস্থ করেছে। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে তাঁতে বিলীন হয়েছি।
ঠিক তেমনি, বর্তমান সৎসঙ্গের সঙ্গীতের ধারা আমাদের, বিশেষ ক'রে পথহারা, হতাশাগ্রস্থ, ক্ষতবিক্ষত, অবসাদগ্রস্থ, দিশেহারা, বিষাক্ত সমাজ ব্যবস্থার শিকার লক্ষ লক্ষ যুবসমাজের কাছে এক নুতন ভাবে বাঁচার, জীবন খুঁজে পাবার, ঘরে ফেরার, ভালোবাসার দিশা দেখায়, রক্তে উত্তেজনার সৃষ্টি ক'রে ঐশ্বরিক প্রকৃত বাঁচা-বাড়ার এক বৈপ্লবিক মানসিকতায় উত্তীর্ণ করে।
এই সঙ্গীতধারা সম্পর্কে আমার প্রশ্নদাতাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই এককথায় সংক্ষেপে এই ট্রেন্ড অভূতপূর্ব! অভূতপূর্ব!!
এটি প্রথম দর্শনে বিতর্কিত বলে মনে হবে। এর গভীরতা বিশাল। সাধারণভাবে দেখলে মনে হবে ভক্তিমূলক গানে এসব কি হচ্ছে!? কিন্তু আপনাকে গানের সমুদ্রের গভীরে ডুব দিয়ে মুক্তো তুলে আনতে হবে। গানের কথায় ঢুকতে হবে। গানের কথার সাথে সুর সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা দেখতে হবে। উপরি ভাসা ভাসা ভাবে ভাবলে, শুনলে হবে না। সমালোচনা করার মানসিকতা নিয়ে, ত্রুটি খোঁজার প্রবণতা নিয়ে, দোষ দর্শন দৃষ্টি দিয়ে, সংকীর্ণ মনোভাব ও একচক্ষু হরিণের দৃষ্টি দিয়ে বর্তমান সঙ্গীতের ট্রেন্ড বোঝা যাবে না; এর জন্য আপনি অযোগ্য ও অদক্ষ। উপরে বর্ণিত প্রচলিত ও নানা ধারার সঙ্গীতের সঙ্গে তানসেনের সঙ্গীতের এবং ভারতীয় নানা ধ্রুপদী নৃত্য, লোকনৃত্য ইত্যাদির সঙ্গে নটরাজের নৃত্যের যে উপমা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি আশা করি পাঠকের কাছে বোধগম্য ও হৃদয়ঙ্গম হবে।
প্রচলিত ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষ মনের সঙ্কীর্ণতার কারণে নতুন জিনিস নিতে পারে না। তাই, বিশ্বকবি বলেছিলেন, "মনের চর্চা যাদের কম, গোঁড়ামি তাদের বেশী, সামান্যতম নতুনত্বে তাদের বাধে।" পরমদয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলেছেন,
"যদি এমনতর কোন নবীন অনুশাসন/ দেখতে পাও, যা' প্রাচীন অনুশাসন-উদ্দেশ্যকে আপূরিত ক'রে জীবনকে আরো অগ্রগতিতে অনুপ্রেরিত ক'রে তোলে- প্রাচীনের যুগোপযোগী রদবদলের ভিতর-দিয়ে, বুঝে নিও- ঐ অনুশাসন প্রাচীনেরই আপূরয়মান নবীন অবতারণা; ঐ নবীন অনুশাসনের মানে কিন্তু এ নয়কো যে প্রাচীন অনুশাসনের সাথে তার দ্বন্দ্ব বা ভেদ আছে, বরং তা' প্রাচীনেরই নবীন প্রেরণা- আরোতরের দিকে, -------- ঐ অনুশাসনে অনুশাসিত না হওয়াই কিন্তু অপরাধের, যে-অপরাধ তোমার সত্তাকে------- আরোতর প্রগতি হ'তে বঞ্চিত ক'রে তুলবে; সাবধান! বিহিত ধী নিয়ে বোঝ, দেখ, চল। "--- শ্রীশ্রীঠাকুর। (আর্য্যপ্রাতিমোক্ষ- ১৫ ; ৫৭৮৯)
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা ভয়ানক জটিল ও দুর্নীতিগ্রস্ত। তরুণদের এই ভয়ানক বিষাক্ত পরিবেশ থেকে বের করে আনতে হবে। কোন পথে? পথ দেখাবে কে? পৃথিবীতে কেউ আছে কি? আপনাকে নতুনভাবে ভাবতে হবে যা সমসাময়িক।
বর্তমান সময় স্পুটনিকের যুগ। গরুরগাড়ির যুগ নয় যে ধীরে ধীরে চলবো। তাই, বিশ্বজুড়ে বৃত্তি-প্রবৃত্তির তীব্র টানে উদ্দাম গতিতে উদোম হ'য়ে ছুটে চলা যুব সম্প্রদায়কে আকর্ষণ করার জন্য, পথ ভোলা, জীবন্রের মূল ধারা থেকে বিচ্যুত হওয়া, মিথ্যে রঙ্গীন দুনিয়ার হাতছানিতে ছুটে চলা, অলীক মায়ার মোহন বাঁশীর সুরে বিভ্রান্ত হ'য়ে আলো ভেবে আগুনে হাত দিয়ে হাত ঝলসে যাওয়া, সমাজের কুহেলিকাময় প্রহেলিকার আবর্তে জীবনের শুরুতেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়া, ঘরে-বাইরে কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিক্ষা, বিবাহ, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদির বিষাক্ত আবহাওয়ায় ভয়ংকর ভাবে সংক্রামিত, ক্ষতবিক্ষত জীবনকে জীবনের, বাঁচা-বাড়ার মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য বাস্তবভাবে যুবকদের সামনে সময়োচিত যুগপোযোগী স্পুটনিকের গতিতে ছুটে চলা একজন প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান, আকর্ষণীয় যুব আইকন থাকার দরকার, যিনি আবার গোঁড়া, কট্টর ইষ্টপ্রাণ, আচার্যপ্রাণ, আদর্শপ্রাণ, আচারবান, চরিত্রবান, জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান হবেন। ভারত তথা বিশ্বজুড়ে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্ব্বিশেষে যুবসমাজের কাছে পূজ্যপাদ শ্রীশ্রীঅবিনদাদার আকর্ষণ তীব্র বাঁধভাঙা জলের ঢেউ-এর মতন। তাই যুবসমাজের কাছে পূজ্যপাদ অবিনদাদার গ্রহণযোগ্যতা অসীম, অনন্ত। তাই তারা ভালোবেসে ফটো রাখে, রাখতে চায় যা আজ সাধারণ মানুষের কাছে, রাজনৈতিক দলের কাছে, অন্যান্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ও সৎসঙ্গ বিরোধীদের কাছে ইর্ষনীয়। যেখানেই অবিনদাদার আগমন হয় সেখানেই লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি যুবকযুবতী, কিশোরকিশোরী, প্রৌঢ়, বৃদ্ধা পঙ্গপালের মতো, আগুনে পোকার মতো নিজের থেকে ছুটে যায় বাড়ি ঘর সব কিছু পিছনে ফেলে রেখে, রোগ-শোক-বার্ধক্য উপেক্ষা ক'রে কারও তোয়াক্কা না ক'রে। শ্রীশ্রীঅবিনদাদার আগমন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের ময়দান ভরাবার জন্য কোনও এজেন্ট নিয়োগ করতে হয় না, সরকারি-বেসরকারি পরিবহন ব্যবস্থাকে অচল ক'রে রেল্ভাড়া, বাসভাড়া ফাঁকি দিতে হয় না অগণিত লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি সৎসঙ্গীকে। এটা সৎসঙ্গের প্রাণপুরুষ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিক্ষা, যে শিক্ষা রেত শরীরে সুপ্ত থেকে জ্যান্ত হ'য়ে ব'য়ে চলেছে বংশ পরম্পরায়।