একজন ঠুনকো ভিত্তিহীন অত্যন্ত নিম্ন রুচিসম্পন্ন লোকদেখানো তথাকথিত মাতৃভক্ত হিন্দু ধর্মপ্রেমীর উক্তিঃ "আমার ধর্ম আমার কাছে মা, অন্য ধর্ম আমার কাছে কিছুই নয়"। এই উক্তিটি একজন অজ্ঞ ও দাম্ভিক মুসলিমভাইয়ের নিজের মিষ্টি মা অর্থাৎ নিজের ধর্মের প্রতি প্রশংসার কারণে প্রতিবাদ স্বরুপ ঐ হিন্দু ভাই করেছিলেন।
মন্তব্য বা মন্তব্যের উত্তরে জবাবটা ততক্ষণই ভালো যতক্ষণ অন্যে আঘাত না পায়। খুব সুন্দর উত্তর হয়েছিল প্রতিবাদী ধর্মপ্রেমী হিন্দু ভাইটির। কিন্তু কোথায় যেন শেষে এসে "আমার ধর্ম আমার কাছে মা, অন্য ধর্ম আমার কাছে কিছুই নয়" এবং “কেমন দিলাম জবাবটা?” এই কথায় সুরটা কেটে গিয়ে একটা আত্মশ্লাঘার কালির ছিটে লেগে গেল। আর ‘জবাবটা কেমন হয়েছে’ জানতে চাওয়া ও বলার মধ্যে একটা মিথ্যে অহঙ্কারের ছোঁয়া আছে যা অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণার মনোভাব প্রকাশ করে।
মুসলিমভাইটি ওর জ্ঞান আর বোধ অনুযায়ী যা মনে হয়েছে তাই বলেছে। ও যা জেনে এসেছে ওর পারিপার্শ্বিক থেকে ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত, যে শিক্ষা পরিসরে ও বড় হয়েছে তাই ওর মাথায় গেঁথে আছে আর তাই ও সব জায়গায় ওর মিষ্টি মায়ের প্রশংসা ক'রে এসেছে ও আসছে। কিন্তু ওকে কেউ শেখায়নি বা নিজেও বৃহত্তর পরিবেশে গিয়ে শেখার চেষ্টা করেনি যে ওর মার মত আরও মা আছে যারা ওর মায়ের মতই মিষ্টি ও সুন্দর আর এখানেই যত গন্ডগোল ও ভুলবোঝাবুঝি। তাই ঐ প্রতিবাদী হিন্দু ভাইটির নিজের মা অর্থাৎ নিজের ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে বলাটাও অপূর্ব ছিল যদি শেষটা ওরকম খোঁচা মারা না হ'তো আর সংগে কোথায় ভুল সেই ভুলটাও যদি ধরিয়ে দিতেন তাহ’লে ঐ মুসলিম ভাইটি তার অসম্পূর্ণ জ্ঞানকে সম্পূর্ণ করার ও ভুলকে শুধরে নেবার সুযোগ পেত। ঐ মুসলিম ভাইটির ও প্রতিবাদী হিন্দু ভাইটির বলার মধ্যে নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসার বহির্প্রকাশ ছিল তীব্র। ভালোবাসা ভালো কিন্তু তীব্র ভালোবাসার অর্থ এই নয় যে অন্যের গায়ে ফোসকা পড়া। আর মা মা-ই-ই। নিজের গর্ভধারিণী মা আমার মা হ'তে পারে কিন্তু অন্যের মাও মা; এই বোধ যদি না থাকে তাহ'লে নিজের মাকে ভালবাসি কথাটার মধ্যে কপটতা লুকিয়ে রয়েছে। মায়েদের কোনও জাত হয় না। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান ইত্যাদি তকমা লাগিয়ে মায়েদের জাতের বিচার হয় না। মা মা-ই-ই!!!! এক হিন্দু শিশু মুসলিম মা বা খ্রিষ্টান মায়ের বুকের দুধ খেয়ে, কিম্বা মুসলিম শিশু হিন্দু মা বা খ্রিষ্টান মায়ের বুকের দুধ খেয়ে কিম্বা কোনও খ্রীষ্টান শিশু হিন্দু বা মুসলিম মায়ের বুকের দুধ খেয়ে বা যে কোনও শিশু যে কোনও মায়ের দুধ খেয়েই বাঁচতে পারে বা বেঁচে থাকতে পারে এ ছাড়া বাঁচার দ্বিতীয় কোনও উপায় নেই। কালো মায়ের দুধ খেয়ে ফর্সা শিশু আর ফর্সা মায়ের দুধ খেয়ে কালো শিশু বেঁচে থাকে বা বাঁচতে পারে। ফর্সা মায়ের দুধ যেমন সাদা হয় ঠিক তেমনি কালো মায়ের দুধও সাদা হয় ও একই গুণ সমৃদ্ধ হয়। মায়ের বুকের দুধের কোনও আলাদা আলাদা রসায়ন হয় না; মাতৃদুগ্ধের রসায়ন এক সে পৃথিবীর যে প্রান্তের যে মা-ই হ’ক না কেন! যে মুহূর্তে শিশুর--সে যে শিশুই হ’ক না কেন-- বাঁচার জন্য মাতৃদুগ্ধের প্রয়োজন হবে সেখানে যে মা উপস্থিত থাকবে সেই মায়ের বুকের দুধ সেই শিশুর বাঁচার এক ও একমাত্র পথ্য; জাতের, ধর্মের, সম্প্রদায়ের কোনও গুরুত্ব, কোনও মূল্য সেখানে নেই। সব বকোয়াস, ফালতু, তুচ্ছ ও মূল্যহীন হ’য়ে যায়। মা ছাড়া কোনও শিশু সে পৃথিবীর যে প্রান্তের হ’ক না কেন মাথার ছাদ পায় না। নারীই একমাত্র মা হ’য়ে মানুষের সে নারীশিশুই হ’ক হ’ক আর পুরুষশিশুই হ’ক তাকে বুকের দুধ দিয়ে, আঁচল দিয়ে আগলে রেখে তাকে বাঁচাতে পারে, রক্ষা করতে পারে, পারে তাকে নিরাপদে বড় ক’রে তুলতে। এক মা হয়তো জন্ম দিল দেখা গেছে আর এক মা বুকের দুধ দিয়ে সেই বাচ্চাকে বাঁচিয়ে বড় ক'রে তুলেছে। ঐ প্রতিবাদী হিন্দু ভাইটি তার বক্তব্য শেষে যেমন ‘হরে কৃষ্ণ’ ব’লে গর্ব বোধ করেছিলেন সেই ভগবান কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। আর ঐ মুসলিম ভাইটি তার মিষ্টি মা অর্থাৎ তার ধর্ম নিয়ে যে প্রশংসা করেছিল সেই ধর্মমতের যিনি প্রবক্তা সেই বিশ্বনবী পুরুষোত্তম হজরত মহম্মদও নিজ জন্মদাত্রীকে জন্মের কিছুদিন পরেই হারিয়েছিলেন। পরমপ্রেমময় পুরুষোত্তম দু’জনেই অন্য মায়ের কোলে, অন্য মায়ের দুধ খেয়ে বড় হয়েছিলেন। তাই মায়ের রূপ আলাদা হ'তে পারে কিন্তু মায়ের সংজ্ঞা একই আর মায়ের দুধ দুধ-ই যা নারীপুরুষ সব শিশুর বাঁচার এক ও একমাত্র আধার।
ঠিক তেমনি ঐ মুসলিম ভাইয়ের নিজ মা অর্থাৎ নিজ ধর্মের পক্ষে প্রশংসাসূচক তীব্র অভিব্যক্তি প্রকাশ ও ঐ প্রতিবাদী হিন্দু ভাইয়ের বলা "আমার ধর্ম আমার কাছে মা, অন্য ধর্ম আমার কাছে কিছুই নয়" কথাটার মধ্যে নিজের মায়ের প্রতি বা ধর্মের প্রতি তীব্র ভালোবাসা প্রকাশের আড়ালে অন্য মায়ের প্রতি অর্থাৎ অন্য ধর্মের প্রতি একটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ঘৃণার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, এই পাওয়াটা জ্ঞাতসারেও হ'তে পারে আবার অজ্ঞাতসারেও হ'তে পারে। সেটা আমার জানা নেই সেটা ঐ দু’জনেই ভালো বলতে পারবেন। তবে এই মনোভাব অজ্ঞানতার ফসল আর এই মনোভাবে সন্তান হিসাবে নিজের মায়ের প্রতিই অপমান, লাঞ্ছনাই করা হয় এবং অন্য মায়েদের সন্তানদের নিজের মায়ের প্রতি অপমান ও ঘৃণা ক'রে দেওয়ার অকারণ সুযোগ ক'রে দেওয়া হয় আর এই রকম পরমভক্ত সন্তানদের জন্য----সে যে মায়ের যে সন্তানই হ'ক না কেন----করুণ নির্মম ফল ভোগ করে মায়েরাই, ফল ভোগ করে গোটা মানবজাতি। আর তাই-ই ঘটছে চারপাশে আর এর জন্য দায়ী নিজের মায়ের প্রতি অর্থাৎ নিজের ধর্মের প্রতি আমাদের অপদার্থ সন্তানদের উগ্র, অন্ধ, অজ্ঞ, কপট, ধান্ধাবাজি, ল্যাংড়া ভালোবাসা। শুধরে নিলে ভালো কিন্তু যদি শুধরে না নেয় তাহ’লে এদের কি বলা উচিত? মায়ের সন্তান নাকি মাকে ধ্বংস করার কিলবিস শয়তান!? সেটা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ধর্মপ্রেমী ঈশ্বরপ্রেমী সন্তানরাই বিচার করুক।
আর এটা মাথায় রাখতে হবে আমার মা বা আমার ধর্ম, তোমার মা বা তোমার ধর্ম ইত্যাদি কথা ভুল। ধর্ম একটাই যা মানুষের বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠা ধ’রে রাখে এবং তা পারিপার্শ্বিক সহ সবাইকে নিয়ে; আর বাকী সব মত। তাই পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বললেন, “যার উপর যা’ কিছু সব দাঁড়িয়ে আছে তাই ধর্ম, আর তিনিই পরমপুরুষ। ধর্ম্ম কখনও বহু হয় না, ধর্ম্ম একই আর তার কোন প্রকার নেই। মত বহু হ’তে পারে, এমনকি যত মানুষ তত মত হ’তে পারে, কিন্তু তাই ব’লে ধর্ম্ম বহু হ’তে পারে না। হিন্দুধর্ম্ম, মুসলমানধর্ম্ম, খৃস্টানধর্ম্ম, বৌদ্ধধর্ম্ম ইত্যাদি কথা আমার মতে ভুল, বরং ও-সবগুলি মত। কোনও মতের সঙ্গে কোনও মতের প্রকৃতপক্ষে কোনও বিরোধ নেই, ভাবের বিভিন্নতা, রকমফের-----একটাকেই নানাপ্রকারে একরকম অনুভব। সব মতই সাধনা বিস্তারের জন্য, তবে তা’ নানাপ্রকারে হ’তে পারে; আর যতটুকু বিস্তারে যা’ হয় তাই অনুভূতি, জ্ঞান। তাই ধর্ম্ম অনুভূতির উপর।“
প্রত্যেকটি মতই একই ধর্ম ও এক ঈশ্বরের কথা বলেছে আর সম্প্রদায়কে ধর্মের সংগে ঘুলিয়ে যেন ঘোল ক'রে গোল বাধিয়ে না বসি। সম্প্রদায় ও ধর্ম্ম আলাদা আলাদা বিষয়, এটা যেন আমরা ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসীরা ভুলে না যাই।
যাই হ'ক এটা বোধের গভীরতার ব্যাপার যেখানে আমাদের সকলকে জাতি, বর্ণ ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে এক ও অদ্বিতীয় ধর্ম ও ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোবার লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করতে হবে।(লেখা ৬ই আগস্ট'২০১৮)