আজ ২৪শে সেপ্টেম্বর'২৩ (৭ই আশ্বিন'১৪৩০) রবিবার শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মতিথি।
গত ১৬ই সেপ্টেম্বর'২৩ (৩০শে ভাদ্র'১৪৩০) শনিবার আমরা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের ১৩৬ তম জন্মদিন পালন করেছিলাম। সেই জুন্মদিন উপলক্ষে এর আগের লেখা "শ্রীশ্রীঠাকুরের ১৩৬তম জন্মদিন ও আমরা সৎসঙ্গীরা ( ২ )" পর্বে লেখা শেষ করেছিলাম আমরা শ্রীশ্রীঠাকুরের ১৩৬তম জন্মদিন পালন করছি কিন্তু "আমরা কেন আমি জন্মেছি, কেন ঠাকুর জন্মেছিলেন, কেন ঈশ্বর সমস্ত কিছু সৃষ্টি ক'রেছিলেন তা আর জানা হ'লো না"। এবার আসুন দেখা যাক এই বিষয়ে কি আলোকপাত করা যায়।
প্রথমে আমরা ওই সব প্রশ্নে যাওয়ার আগে জেনে নিই একঝলকে যার জন্মদিন আমরা পালন করলাম তিনি কে?
আমরা যার ১৩৬তম জন্মদিন পালন করলাম তিনি একজন মানুষ। এককথায় যদি বলি, তিনি হ'লেন বর্তমানে সর্বশেষ যুগপুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তিনি হ'লেন সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের রক্তমাংসসঙ্কুল জীবন্ত রূপ। তিনি হ'লেন সদ্গুরু, পরম অস্তিত্ব, পরম কারণ, পরম সত্ত্বা, পরম জ্ঞান, পরম বিজ্ঞান, পরম প্রাণ, পরমপিতা, পরমপ্রেমময়। তিনি হলেন অস্বাভাবিকভাবে স্বাভাবিক, জাঁকজমকপূর্ণ সহজ ও বিজ্ঞভাবে বোকা একজন মানুষ। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র হ'লেন সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী, সর্বদর্শী, সর্বশক্তিমান এবং সর্বোত্তম একজন মানুষ।
আর, আমরা বাকী মানুষেরা? আমরা পৃথিবীর বাকী সাধারণ-অসাধারণ, মূর্খ-জ্ঞানী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, গরীব-বড়লোক ইত্যাদি শেষ গণনা অনুযায়ী ৭৮৮,৮৪ কোটি মানুষ হ;লাম হয় জীবকোটি নতুবা ঈশ্বরকোটি মানুষ।
জীবকোটি মানুষ অর্থাৎ রিপু তাড়িত বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তে আকন্ঠ ডুবে থাকা মানুষ। যার শরীর-মন-প্রাণ-হৃদয় রিপুর অধীন, রিপু দ্বারা চালিত অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (অহংকার) ও মাৎসর্য (পরশ্রীকাতরতা) এই ৬টা রিপু্র প্রবল টানের বৃত্তে অর্থাৎ গন্ডীতে আঠার মতো আষ্টেপৃষ্টে লেপটে থাকে ও ঘুরতে থাকে বৃত্তির বৃত্তে যার জীবন তার ভারসাম্য হারিয়ে, সেই ছোট্ট হৃদয় বা জীবনের অধিকারী মানুষকে বলা হয় জীবকোটি।
উদাহরণস্বরুপ, আমি ও আমার মতো মানুষেরা।
আর, যার শরীর-মন-প্রাণ-হৃদয় তার ইষ্টের টানে, তার প্রিয়পরম প্রেষ্ঠের প্রতি অটুট, অচ্যুত, অস্খলিত বৃত্তিভেদী টানে তাঁর স্বার্থে স্বার্থান্বিত হ'য়ে তাঁর প্রয়োজন পূরণে জীবন উৎসর্গ করে, তাঁরই কক্ষপথে ঘুরতে থাকে অর্থাৎ তাঁর জীবনকে কেন্দ্র ক'রে তাঁর চলনপুজায় মগ্ন হ'য়ে নেশারুর মতো চলতে থাকে ও জীবন উপভোগ করে পারিপার্শ্বিক সকলকে নিয়ে সেই মানুষই হ'লেন ঈশ্বরকোটি পুরুষ।
উদাহরণস্বরূপ, শ্রীশ্রীবড়দা, শ্রীশ্রীদাদা ও শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত এক ও অদ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান 'সৎসঙ্গ'-এর বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদা।
এই জীবকোটি ও ঈশ্বরকোটি মানুষ সম্পর্কে শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন,
১) "বৃত্তি-আঠায় লেপটে থাকে
ছোট্ট হৃদয়খান,
জীবকোটি তুই তা'রেই জানিস
অজানাতেই স্থান।"
২) "প্রেষ্ঠনেশার অটুট টানে
বৃত্তি-সমাহার,
ঈশ্বরকোটি তাঁ'কেই জানিস্
শ্রেষ্ঠ জনম তাঁ'র।"
এইবার এই ঈশ্বরকোটি ও জীবকোটি সৎসঙ্গীরা আমরা যারা শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মমাস ও জন্মদিন পালন করেছি আবার ২৪শে সেপ্টেম্বর জন্মতিথি পালন করবো তাঁরা একবার দেখে নিই যে এই যারা আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করেছি সেই তিনি ও আমরা কেন জন্মেছি?
এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখে নিই স্বয়ং জীবন্ত ঈশ্বর তিনি কি বলেছেন এই ব্যপারে।
তিনি বললেন,
" তুমি কেন জন্মেছ মোটাভাবেও কি দেখেছ ? থাকাটাকে কি উপভোগ ক'রতে নয় ---- চাহিদা ও কর্ম্মের ভিতর - দিয়ে পারস্পরিক সহবাসে ----- প্রত্যেকরকমে ?
আর, ভগবান কেন সৃষ্টি করেছেন সেই ব্যাপারেও তিনি স্পষ্টভাষায় পরিষ্কার সহজ সরল ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি বললেন,
"তেমনি বুঝছ না ভগবান কেন সৃষ্টি ক'রেছেন ? উত্তর কি এখন ?----- নিজেকে অনুভব ক'রতে , উপভোগ ক'রতে ---- বিশ্বে ,প্রত্যেক অনুপাতে --- দেওয়ায় , নেওয়ায় -- আলিঙ্গনে , গ্রহণে , কর্ম্মবৈচিত্রে , ----- নয় কি ? "
শ্রীশ্রীঠাকুরের এই বাণী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমরা কেন জন্মেছি আর কেনই তিনি সৃষ্টি করেছেন। আমাদের ঠাকুর সূক্ষ্মভাবে ভেবে দেখতে বলেননি। আমাদের বলেছেন আমরা কেন জন্মেছি সেটা মোটাভাবে অন্তত ভেবে দেখতে। তিনি বললেন, আমরা প্রত্যেকেই জন্মেছি আমাদের এই জন্মটাকে অর্থাৎ আমার এই অস্তিত্ব বা থাকাটাকে উপভোগ করবার জন্য। কিভাবে উপভোগ করবো? আমাদের নারীপুরুষের প্রত্যেকের নানারকম চাহিদা আছে। পুরুষের চাহিদা হচ্ছে অর্থ, মান, যশ, ক্ষমতা, বাড়ি, গাড়ি, নারী ইত্যাদি। আবার নারীরও চাহিদা প্রায় সেই একই অর্থ, মান, যশ, সোনা-গয়না, পুরুষ, বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সমস্ত চাহিদা পূরণ করতে হ'লে চাই কর্ম। কর্ম ছাড়া কোনও চাহিদাই পূরণ করতে পারবে না, হবে না। ফোকটে কিছু পাওয়া যাবে না আর আকাশ থেকেও কোনও ভগবান কিছু আমার চাওয়া মত ফেলবে না। আমি যা কিছুই চাই না কেন তার জন্য আমাকে করতে হবে। দু'নাম্বারি বা একনাম্বারি যে কোনও একটা পথে কর্ম করতে হবে আমাকে। তবে এই কর্ম করার সঙ্গে উপভোগ ও প্রকৃত উপভোগ আলাদা বিষয়। দু'নাম্বারি পথে ভোগ বা উপভোগ কোনওটাই প্রকৃতপক্ষে হ'য়ে ওঠে না। হ'লেও তা সাময়িক মদের তীব্র নেশার মতো। কেটে গেলেই অবসাদ, আর অবসাদ কাটাতে আবার পান। আর শেষের সেদিন হয় ভয়ংকর।
আর, একনাম্বারি পথেও ভোগ, উপভোগ কোনওটাই প্রকৃত অর্থে হ'য়ে ওঠে না। লোকে যেটাকে সুখ মনে করে আজ, কাল রোগ, শোক, গ্রহদোষ, বুদ্ধিবিপর্যয় ও দরিদ্রতা কোনও একটার আচমকা আক্রমণে বা ছোবলে মানুষের জীবন, পরিবার ধ্বংস হ'য়ে যেতে পারে। তখন জীবনে আর ভোগ বা উপভোগ হয় না। ভোগ বা উপভোগের মধ্যে আছে চাহিদা ও কর্মের যৌথ উপস্থিতি। চাহিদা ও কর্মের পারস্পরিক মিলন, পরিবারের প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের মধুর সম্পর্ক, আমার পরিবেশ পারিপার্শ্বিকের প্রত্যেকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিখুশি সম্পর্ক ইত্যাদি সবরকমভাবে সহবাস বা মিলনের মাধ্যমে মানসিক শান্তি ও সুখ লাভ ক'রে আমি জীবনকে, আমার থাকাটাকে প্রকৃত উপভোগ করতে পারি।
ঠিক তেমনি, মা যেমন সন্তানকে জন্ম দেওয়ার মধ্যে দিয়ে নিজেকে অনুভব করে, উপভোগ করে ঈশ্বরও সৃষ্টি করেছেন নিজেকে এই সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে অনুভব করতে, উপভোগ করতে। আর এই অনুভব বা উপভোগ করে বিভিন্ন রকম ভাবে নানা বৈচিত্রের মধ্যে দিয়ে তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি অস্তিত্বের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে দেওয়া নেওয়া ও আলিঙ্গন-গ্রহণের মধ্যে দিয়ে।
শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের অল্প সময়ের জন্য পৃথিবীতে আসাকে চুটিয়ে নিংড়ে ভোগ করার জন্য আমাদের প্রকৃষ্ট পথের কথা বলবার জন্যই তিনি জন্মেছিলেন।
প্রকাশ বিশ্বাস।
উত্তরপাড়া, ভদ্রকালী।
(২৪শে সেপ্টেম্বর'২০২৩)