"যাকে দান ক'রবে, তা'র দুঃখ অনুভব ক'রে সহানুভূতি প্রকাশ কর, সাহস দাও, সান্ত্বনা দাও; পরে যা' সাধ্য, যত্ন-সহকারে দাও; প্রেমের অধিকারী হবে-------দান সিদ্ধ হবে।"------শ্রীশ্রীঠাকুর।
করোনা মহামারী রূপে ছড়িয়ে পড়েছে দেশ জুড়ে। রাজ্যে রাজ্যে চলেছে করোনার বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই।
সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যষ্টি থেকে সমষ্টি, রাজনৈতিক দল থেকে নানা প্রতিষ্ঠান যার যা সামর্থ্য বা ক্ষমতা অনুযায়ী। আর সেই সাহায্যের নমুনা দেখতে পায় ফেসবুক-এ। সাহায্যের কত রকমের ছবি! সাহায্য দিচ্ছে ক্যামেরার দিকে পোজ দিয়ে, সাহায্য দিচ্ছে ১-২কেজি চাল বা গম আর সেই সাহায্য হাত দিয়ে ছুঁয়ে ক্যামেরার দিকে হাসি মুখে ফটো তুলছে একসঙ্গে পাঁচ-ছ'জন লোক! যেন বিরাট একটা দয়ার জোয়ার ব'য়ে যাচ্ছে দেশজুড়ে!
এসব দেখে মনে হ'লো এমন কেন বারবার আসে না!? আর যাই-ই হ'ক না খেয়ে খেয়ে মরার চেয়ে করোনার কারনে মরার আগে দু'টো খেয়ে মরা ভালো! তাই নয় কি? এরকম নিশ্চিন্ত সাহায্যের রাত কেন বারবার আসে না গরীব দিন আনা দিন খায় প্রান্তিক মানুষদের জন্য!? করোনার কারণে এমন করুনার নমুনা যেন ফিরে ফিরে আসে গরীব প্রান্তিক মানুষের কাছে যাতে মরার আগে অন্ততঃ দু'মুঠো খেয়ে যেতে পারে তারা আর পাপ ধুয়ে পূণ্য করার সুযোগ পায় সাহায্যকারী দাতারা! তাই গরীব মানুষ মনে মনে গাইছে,
এসো মা করোনা, বসো মা করোনা
থাকো মা করোনা আমার ঘরে!
থাকো আমাদের সাথে, দু'মুঠো অন্ন
পড়িবে গরীবের পাতে, নইলে এমনিতেই
তো আছি মরে, গেছে কত প্রিয়জন
না খেয়ে খেয়ে মরে, তুমি আসিলে তাই
দু'মুঠো অন্ন জুটিল যে হায়! তোমারি তরে!
তুমি এসো, বসো, থাকো মোদের ঘরে ঘরে!!
যাই হ'ক, ঠাকুরের দৃষ্টিতে দেখা যাক বিষয়টা!
১) যারা দান করছি তারা কি তার দুঃখ অনুভব করতে পারছি?
২) দুঃখ অনুভব ক'রে তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করি?
৩) সাহায্যপ্রার্থীকে কি সাহস দিচ্ছি এই ঘোর বিপদের দিনে?
৪) সাহায্যদানকারী সাহায্যপ্রার্থীকে এই কষ্টের সময়ে সান্তনা দিয়েছে?
৫) সাধ্যানুযায়ী দিচ্ছি? দেওয়ার সময় যত্ন ক'রে দিচ্ছি?
নাকি শুধু চাল, ডাল, আলু, সবজি দিচ্ছি আর হাসি মুখে পোজ দিয়ে ফটো তুলছি? আর ফটো তোলার পরে তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিচ্ছি? কিসের জন্য? কিসের মোহে? শ্রীশ্রীঠাকুর আমাদের সৎসঙ্গীদের সারাজীবন তাঁর চলন দিয়ে কি শিক্ষা দিয়ে গেছেন? তা কি আমরা জানি? আমরা কি জানি তিনি তাঁর শৈশব থেকে শেষদিন পর্যন্ত যে বি-শা-ল কর্মকান্ড ক'রে গেছেন তা কি কি? এবং সেই বি-শা-ল কর্মকান্ড কি জনসমক্ষে কোনদিনও তিনি প্রচার করেছেন? সেইসময় এই বি-শা-ল কর্মযজ্ঞ কেউ জানতে না পারার জন্য দেশের কোন কোন অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা ঠাকুরকে অভিযোগ করেছিলেন এবং তার উত্তরে ঠাকুর কি বলেছিলেন তাও নিশ্চয়ই সৎসঙ্গী গুরুভাইবোনেরা জানেন। জানেন না কি!? তাহ'লে আজ এই করোনার কারণে গরীবদের সাহায্যের ছবি তুলে কেন সৎসঙ্গীদের এত প্রচার!? কিসের সাহায্য!? কে কাকে সাহায্য করে!? গরীব গুরুভাইবোন হ'ক আর না-ই হ'ক যাদের আমরা সাহায্য করছি তারা কি আমার পর!? তারা কি আপন কেউ নয়!? আমরা কি পরোপকার করছি!? ঠাকুর যেখানে আফসোস ক'রে গেলেন 'এই জীবনে তাঁর আর পরোপকার করা হ'লো না, কারণ তিনি পর-ই পেলেন না এ জনমে, সবাই তাঁর আপনজন'---এই কথা বলে; সেখানে তাঁর সন্তান আমরা, তাঁর শিষ্য, অনুগামী আমরা এত পরোপকার করছি কিভাবে!? প্রচার করছি কিভাবে!? ছবি তুলছি কিভাবে!? এর মধ্যে কোনটা ঠাকুর করেছেন!? 'সৎসঙ্গ' প্রতিষ্ঠান ঠাকুরের সময় থেকে আজ পর্যন্ত সরকারী-বেসরকারি কত প্রতিষ্ঠানকে যে সাহায্য করেছে ও ক'রে চলেছে তার কোনও হিসাব জানা আছে সৎসঙ্গীদের? আমরা কি ঠাকুরের ইচ্ছেমত চলবো নাকি নিজেদের ইচ্ছেমত চলবো!? ঠাকুর যা পছন্দ করতেন তা যদি আমরা না করি, আর যা অপছন্দ করতেন তা করি তাহ'লে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে তাও ঠাকুর বলে দিয়ে গেছেন। ঠাকুর বললেন, "ইচ্ছেমত ভজলি গুরু হ'তে মানুষ হ'লি গরু।"
আর, করোনার কারণে যখন চতুর্দিকে সাহায্যের হাত এগিয়ে এসেছে তখন 'সৎসঙ্গ' কি করছে না করছে সেই প্রশ্নে কি আমাদের বিশ্বাস টলে যাবে!? আমরা নিজেদের সৎসঙ্গী দাবী করছি আবার আমাদের ঠাকুরের প্রতি বিশ্বাস, নির্ভরতা ভেঙে যাচ্ছে বিরুদ্ধবাদীদের বালখিল্য প্রশ্নবাণে!? কেন বিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে!? কেন ঠাকুরের প্রতি, ঠাকুর পরিবারের প্রতি, 'সৎসঙ্গ' প্রতিষ্ঠানের প্রতি সন্দেহ এসে বাসা বাঁধছে মনের কোণে!? এর পরেও আমরা বলবো আমরা সৎসঙ্গী? এর পরেও বলবো আমরা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বিস্ময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের শিষ্য!? এইজন্যই ঠাকুর আগাম বলেছিলেন, "বিশ্বাস বিরুদ্ধ ভাব দ্বারা আক্রান্ত হ'লেই সন্দেহ আসে।" কখন আমাকে বিরুদ্ধ ভাব আক্রমণ করে? কখন সন্দেহ আসে? এককথায় বলা যেতে পারে, আমরা প্রকৃত বিশ্বাসী বা পাকা বিশ্বাসী ন'ই! এর উত্তরও দিয়ে গেছেন ঠাকুর। ঠাকুর তাঁর সত্যানুসরণ গ্রন্থে বললেন, "বিশ্বাস পেকে গেলে কোন বিরুদ্ধ ভাবই তাকে টলাতে পারে না। তুমি যদি পাকা বিশ্বাসী হও, বিশ্বাস-অনুযায়ী ভাব ছাড়া জগতে কোন বিরুদ্ধ ভাব, কোন মন্ত্র, কোন শক্তি তোমাকে অভিভূত বা জাদু ক'রতে পারবে না, নিশ্চয় জেনো"।
কিন্তু আমরা কি দেখছি? করোনার আক্রমণে যখন গোটা দেশ টালমাটাল, দেশের মানুষ, দেশের প্রশাসন কিংকর্তব্যবিমূঢ় তখন একশ্রেনীর মানুষ এই অবস্থাকে ঠাট্টা তামাশার পর্যায়ে নাবিয়ে নিয়ে এসেছে! করোনার মাঝেও রাজনীতি, বাদবিতণ্ডা, মানা ও না-মানা নিয়ে তর্ক, মজা, ঠাট্টা-তামাশা করতে ছাড়ছে না! এর মধ্যে কিছু লোক যাদের বাপ আর স্বামীর হোটেলে পায়ের উপর পা তুলে খেয়ে, বউয়ের রোজগারে পেট ভরিয়ে, বাপের রেখে যাওয়া ধনে জীবন চালিয়ে যাওয়া কিম্বা বাঁহাতি টান মেরে খাওয়া আর মোড়ে মোড়ে, চায়ের দোকানে দোকানে, বটতলায়, রাস্তায়-রকে, ঘরের কোণে বসে অন্যকে চুলকে আনন্দ পাওয়া ছাড়া আর কোনও কাজ ছিল না, উপরন্ত এই লক ডাউনে ঘরবন্দি থাকার কারণে তাদের চুলকুনি রোগের মাত্রাটা বেড়ে গেছে! আর এই বিষাক্ত চুলকুনির মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে এই বিষ বুমেরাং হ'য়ে গিয়ে পড়ছে ঘরের স্বামীস্ত্রী, পুত্রকন্যা ও অন্যান্য সদস্যদের উপর; ফলে বিষের তীব্র জ্বালায় জ্বলে খাক হ'য়ে যাচ্ছে তাদের জীবন আর অশান্তিতে ভ'রে উঠেছে সংসার!
এইসমস্ত বিষাক্ত কাজ নেই তো চুলকে দিই গোছের মানুষেরা নেবে পড়েছে কোমর কষে 'সৎসঙ্গ' প্রতিষ্ঠান ও ঠাকুর পরিবারের লোকজনকে স্বভাবগতভাবেই চুলকোবে ব'লে। তাই তারা বেছে নিয়েছে ফেসবুকের মত স্ট্রং মিডিয়াকে। আর চুলকে চলেছে দিনের পর দিন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে বা যারা চুলকোচ্ছে তাদের কাজই এটা, কিন্তু প্রকৃত সৎসঙ্গীদের কেন এতে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে!? কেন সৎসঙ্গীরা এদের মেরুদন্ডহীন কোমর ভাঙা লোকেদের কথায় অভিভূত হ'য়ে যাচ্ছে!? কেন অসংস্কৃত লোকেরা তাদের ভাগারের দুর্গন্ধে ভরা কথা দিয়ে সৎসঙ্গীদের জাদু করে!? এতে সৎসঙ্গীদের স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়! এই ব্যাপারে কেন সৎসঙ্গীরা সতর্ক থাকে না!? কেন তারা এদের বালখিল্য প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে বা 'সৎসঙ্গ কি সাহায্য করছে না করছে তার জন্য উতলা হ'য়ে একে ওকে তাকে প্রশ্ন ক'রে এদের অক্সিজেন যোগাচ্ছে কেন? আর কেনই বা তাদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে? কারণ আমাদের ঠাকুর, ঠাকুরের জীবন, ঠাকুরের মিশন, ঠাকুর সৃষ্ট 'সৎসঙ্গ' প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোনও বিন্দুমাত্র ধ্যানধারণা নেই! আর ধ্যানধারণা নেই বলেই আমরা এই করোনা বিপর্যয়ে গরীব দুঃস্থদের সাহায্য করছি ঢাকঢোল পিটিয়ে আর তার ফটো তুলে চিপকে দিচ্ছি ফেসবুকে বিরোধী তথা আম আদমিকে জানান দিতে যে আমরা বি-রা-ট ঠাকুরের কাজ করছি! ঠাকুর কি তাই চাইতেন? আজ যে ঠাকুরকে গালিগালাজ করছে এ তো আজকের গালিগালাজ নয়, এ তো ঠাকুরের জীবদ্দশায় স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল আর এই গালিগালাজ তো তাঁকে না জানার জন্য, তাঁর বি-শা-ল কর্মকান্ড সম্পর্কে, তাঁর বি-রা-ট জীবনের গভীরতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল না থাকার জন্যে আর ঠিক একই কারণে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠান 'সৎসঙ্গ' ও তাঁর পরিবার সম্পর্কে গালিগালাজ ক'রে চলেছে ঐ সমস্ত জন্মবিকৃত জনগোষ্ঠী, দুঃখের বিষয় কিছু অল্পবয়সী ছেলেমেয়ে, কিছু মানুষ না জেনে, না বুঝে এদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছে।
তাই বলি, এদের দিকে তাকাবার, এদের নিয়ে ভাবার, এদের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে লড়াই করার ও সাহায্যের বিনিময়ে ফটো তুলে প্রচার করার মত আমাদের সময় নেই, আর আমাদের ঠাকুরবাড়ি থেকে কোনও নির্দেশও দেয়নি এসব করার জন্য। আসুন ঠাকুর যা চেয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ি যেমন যেমন ক'রে চলে আমাদের পথ দেখাচ্ছে আমরা তাই করি। যতক্ষণ এদের নিয়ে ভাববো, এদের নিয়ে কথা বলবো ততক্ষণই ঠাকুর থেকে দূরে সরে থাকবো, ঠাকুর প্রতিষ্ঠা থেকে দূরে সরে যাবো আর তত দ্রুত শয়তান এই সুন্দর পৃথিবীতে তার ধ্বংসলীলা চালাবার সুযোগ পেয়ে যাবে!
তাই স্যবধান! আসুন ওদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই এইভেবে যে তারা আমাদের থেকেও বেশি সমালোচনা আর গালাগালির মধ্যে দিয়ে প্রকারান্তরে ঠাকুরের প্রচার ক'রে চলেছে! আমরা ঠাকুরের দীক্ষিতরা সেই তুলনায় কিছুই করছি না, শুধু তাত্ত্বিক আমেজে ডুবে থেকে ডুডু তামাক খেয়ে তথাকথিত ঠাকুর প্রতিষ্ঠার ঢেঁকুর তুলে যাচ্ছি!
তাই আসুন, আমরা যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছি গরীব মানুষদের জন্য সেই হাত যেন কেউ দেখতে না পায়!! একথা যেন আমরা মনে রাখি ঠাকুর বলেছেন, "দান ক'রে প্রকাশ যত না কর ততই ভাল, অহংকার থেকে রক্ষা পাবে।" কারণ,
"চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়
আজকে যে রাজাধিরাজ কালকে সে ভিক্ষা চায়!"
সমঝদার কে লিয়ে ইশারা কাফি হোতা হ্যায়!
( লেখা ১৪ই এপ্রিল,২০২০ )
No comments:
Post a Comment