Powered By Blogger

Thursday, April 11, 2024

প্রবন্ধঃ ভগবান, দেবতা, ঈশ্বর, অবতার ও অবতারী ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য কি?

ভগবানঃ
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ভগবানের মধ্যে আছে ভগ শব্দ। ভগ এসেছে ভজ-ধাতু থেকে, ভজ ধাতুর একটা প্রধান অর্থ হ'লো সেবা, তাই ভগবান মানে বলা যায় সেবাবান। সত্তাসম্বর্দ্ধনী সেবা অর্থাৎ আমার সত্ত্বা বা অস্তিত্বকে সম্মানের সঙ্গে অভ্যর্থনা করা অর্থাৎ পরিপালন, পরিপোষণ ও পরিরক্ষণই যাঁর জীবন-বৈশিষ্ট্য, তিনিই ভগবান। যিনি এই সেবা-বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন, তিনিই হ'লেন মানুষের মুখ্য সেবনীয়, অর্ঘ্যণীয় মানুষ-ভগবান। আবার যার ভজনা করা যায় তিনিই ভগবান। অর্থাৎ যার উপাসনা করা যায়, পূজা করা যায়, যার আরাধনা করা যায় তিনিই ভগবান। ভজনা করার মত গুণাবলী যার মধ্যে আছে সেই ভগবান। আপনারা যারা যারা শুনছেন আমার এই ভিডিও তাদের যার বা যাদের মধ্যে আছে এই গুণাবলী, যার বা যাদের মধ্যে আছে মানুষকে সেবা করার বৈশিষ্ট্য সে বা তিনিই ভগবান।

তাই ভগবান কোনও মূর্তিহীন, অবয়বহীন, শুধু মনে মনে ভাবা বা ভাবের ঘোরে বাস করা ভাবমূলক অস্তিত্বহীন কোনও কিছু নয়। ভগবান মানে একজন মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ । সেই মানুষ যার মধ্যে ষড়ৈশ্চর্য্য বর্তমান। অর্থাৎ ছটা ঐশ্বর্য্য আছে। ঐশ্বর্য, বীর্য, যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য-এই ছয়টি গুণ যার মধ্যে আছে তিনি মানুষের কাছে মানুষ রূপী ভগবান। এবার আপনারা নিজেরাই বিচার ক'রে দেখে নিন, এই জীবনে যাদের যাদের সংস্পর্শে আপনি এসেছেন তারা কারা কারা এই ছটা গুণের অধিকারী দেখে নিন তাহ'লেই হবে। সহজ ক'রে বললে বলতে হয় ঐশ্বর্য অর্থাৎ যার মধ্যে প্রভুত্ব করার শক্তি আছে, আছে রাজকীয় ভাব। বীর্য অর্থাৎ এককথায় বললে যা বোঝায় তা হ'লো শক্তিশালী মানুষের অবস্থা।


যশ অর্থাৎ মহিমা, খ্যাতি ইত্যাদি। জ্ঞান অর্থাৎ কোন বিষয় সম্পর্কে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা অধিকারী। বৈরাগ্য অর্থাৎ এককথায় এই পৃথিবীতে সবকিছুই অস্থায়ী, অনিত্য। এই অস্থায়ী অনিত্য যে জগত সেই জগতের যা কিছু আনন্দ ও বেদনা সবকিছুর মধ্যে মগ্ন থেকেও ত্রর উর্ধ্বে থাকা। সমস্ত রঙ বা বর্ণের মধ্যে থেকে রঙহীন বা বর্ণহীন থাকা। সহজভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলেম। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা আরও পরিষ্কার হবে।
রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে যেমন আমরা তাঁর কবিত্ব বুঝি না, বুঝি কি? আগে রবীন্দ্রনাথ তারপর তাঁর কবিত্ব। দয়াবান ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে কি আমরা দয়া বুঝি? বুঝি না। যেমন আমরা দয়া বুঝি না। আগে দয়াবান ব্যক্তি তারপর তাঁর দয়া, ঠিক তেমনি ষড়ৈশ্চর্য্যবান মানুষ অর্থাৎ এই ছটা ঐশ্বর্য আছে এমন মানুষ ছাড়া আমরা কোনও ভগবান বুঝি না। এই ছটা গুণ যার মধ্যে প্রকট হয়েছে তিনিই ভগবান। তাহ'লে যারা সমাজে ভগবান সেজে বসে আছে তাদের মধ্যে এই ছটা গুণ জ্বলজ্বল করছে কিনা দেখে নিলেই আর আমাদের ঠকতে হয় না। তাই কথায় আছে ভক্তই ভগবান। এবার যারা গেরুয়া কাপড়ে রংচঙ মেখে সাধু সেজে, বা সাদা পোশাকে ভক্তপ্রবর ইষ্টপ্রাণ সৎসঙ্গী সেজে, ভালোমানুষ বা প্রেমিক মানুষ সেজে আমাদের চারপাশে বিচরণ করছে তাদের মধ্যে দেখে নিন এই ছটা গুণ তাদের জীবনে, আচারে আচরণে, কথায় বার্তায়, চোখেমুখে, শরীরী ভাষায়, অঙ্গভঙ্গীতে, চাউনিতে, চলনে বলনে অর্থাৎ কথায় আর কাজে মিল আছে কিনা, এককথায় সমগ্র চরিত্রে পাওয়া যাচ্ছে কিনা।
আবার পরমপিতাও ভগবান। তাঁর মধ্যে এইগুঙুলি আছেই। ভগবান বা পরমপিতা আমার আপনার সবার মধ্যে জীবন স্বরূপ হ'য়ে আছেন। আমার আপনার মধ্যে ভগবান বা পরমপিতা জীবন-স্বরূপ আছেন বলেই আমাদের এত প্রাণশক্তি, আমরা সেই জীবন-স্বরূপ ভগবানের উপস্থিতির কারণেই আমরা চলি ফিরি, হেকমতি দেখাই। যদি আমার মধ্যে জীবন-স্বরূপ তিনি না থাকতেন আমরা কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু আমরা তা উপলব্ধি করতে পারি না। আর, পারি না বলেই তাঁকে বারবার মানুষের রূপ ধ'রে মানুষের মাঝে নেমে আসতে হয়। কিন্তু আমরা তাঁকে চিনতে পারি না।



দেবতাঃ
দেবতা মানে যিনি দীপ্তি পান। বলা হয় দেবতারা দেবলোকে বাস করেন। দেবলোক মানে? দেবতাদের লোক অর্থাৎ দেবতারা যে লোকে বাস করেন। দেবলোক ভাঙ্গলে পাই দেব ও লোক, দুটো শব্দ। দেব মানে দেবতা অর্থাৎ যিনি দীপ্তি পান অর্থাৎ যার জীবন জ্যোতিঃ; প্রভা; আলোক; তেজ ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ। যার চরিত্রে জ্যোতি, প্রভা, আলোক ও তেজের বিচ্ছুরণ ঘটে, আলোকিত হয় মনুষ্যসমাজ। আর লোক মানে স্বর্গলোক। অর্থাৎ উচ্চতর স্থান। তাহ'লে আমরা কি পেলাম? দেবতা মানে যিনি দীপ্তি পান আর দেবলোক মানে দেবতাদের লোক। যাঁদের জীবন, যাঁদের চরিত্র মানবতায় পরিপূর্ণ অর্থাৎ দয়া, মায়া, স্নেহ, মমতা, প্রেম, ভালোবাসা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, সম্মান, জ্ঞান, কর্ম্ম ইত্যাদি সমস্ত গুণাবলী, সুসংস্কারে পরিপূর্ণ তারাই দেবতা আর তাদের থাকবার জায়গা বা বাসস্থান হ'লো দেবলোক। আবার মানুষের জীবনের একটা বিশেষ স্তরকে দেবলোক বলে। এই উচ্চ আই কিউ লেবেল বা স্তরের কথায় সেদিন আলিপুরের অনুষ্ঠানে শ্রীশ্রীঅবিনদাদা উপস্থিত সৎসঙ্গীদের বলতে চেয়েছিলেন। এই বিশেষ উচ্চ স্তরে বা উচ্চ লেবেলে যখন মানুষ বিচরণ করে তখন সে তাঁর জীবনের সব কিছু দিয়ে তাঁর পারপার্শ্বিকের সবকিছুর সেবা করে। পারিপার্শ্বিক ছাড়া তাঁর আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই। পারিপার্শ্বিকের উন্নতিই তাঁর উন্নতি। পারিপার্শ্বিক যদি না বাঁচে, না বেড়ে ওঠে সবদিক দিয়ে তাহ'লে বাঁচা হয় না, তাঁর বেড়ে ওঠা হয় না। পারিপার্শ্বিক ছাড়া যে সে বাঁচতে পারে না, তাঁর অস্তিত্বকেই টিকিয়ে রাখতে পারে না এই যে সহজ সরল বোধ, এই বোধই তাঁকে সকলের কাছে দেবোপম চরিত্রের ক'রে তোলে। এই যে দেবোপম চরিত্রের অধিকারী হ'লো মানুষটা তাঁর মানেই হচ্ছে সে দেবলোকে বাস করছে অর্থাৎ ঐ উন্নত পবিত্র সুন্দর মানসিকতার লেবেলে বা স্তরে বাস করছে। এই উন্নত মানসিকতার স্তরে যে বাস করে সেই দেবতা। শ্রীশ্রীঠাকুর খুব সুন্দর ক'রে বলেছেন, "দেবতা মানে যিনি দীপ্তি পান। দেবলোক মানুষের জীবনে একটা plane বা স্তর বিশেষ। মানুষ যখন with all his characteristic (তার সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে) পারিপার্শ্বিকের fulfillment(পরিপূরণের)-এর ভিতর দিয়ে তাদের প্রত্যেকের object of regards and interest (শ্রদ্ধা ও অন্তরাসের) হ'য়ে দাঁড়ায়, মানুষের ইষ্টানুগ সেবায় (অর্থাৎ মানুষ যাতে ইষ্টকে অনুসরণ ক'রে চলে, ইষ্ট বা মঙ্গলের পথে চলে সেরকম সেবা দিতে দিতে) তার জীবন যখন দীপ্তি পেতে পেতে এগিয়ে চলে----স্বতস্ফুর্ত চারিত্রিক অভিব্যাক্তি ও অনুরঞ্জনায়,---তখন সে দেবলোকে বাস করে। ঐ active characteristics (সক্রিয় বৈশিষ্ট্যগুলি) -ই হয় তার plane বা স্তর।




ঈশ্বরঃ ঈশ্বর শব্দের মধ্যে ঈশ শব্দ। আর ঈশ মানে হ'লো আধিপত্য। আধিপত্য শব্দের মধ্যে আছে অধিপতি। আবার অধিপতি শব্দের মধ্যে দু'টো শব্দ আছে। অধি ও পতি। অধি শব্দের মধ্যে আছে পা ধাতু, আর পতি শব্দের মধ্যে আছে পা ধাতু। ধা মানে ধারণ। আর, পা মানে পালন। অর্থাৎ যিনি ধারণ ও পালন করেন তিনিই অধিপতি। আর যিনি অধিপতি তাঁর মধ্যে সব কিছুর ওপর আধিপত্য বিস্তার করার স্বাভাবিক ক্ষমতা আছে। যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সব কিছুর ওপর আধিপত্য বিস্তার করেন ও বজায় রাখেন তিনিই ঈশ্বর। যেমন গণেশ। গণেশ শব্দের মধ্যেও দু'টো শব্দ আছে। গণ ও ঈশ= গণেশ। অর্থাৎ গণ মানে শুধু মানুষ নয়, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে যা কিছু আছে সমস্ত কিছু। এই সমস্ত কিছুর ওপর আধিপত্য বিস্তার করার ক্ষমতা যাঁর তিনিই ঈশ্বর। কোনও মানুষের নেই সেই ক্ষমতা তা' সে যতবড় মহাপন্ডিত, জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, মহাক্ষমতাবান মহাপুরুষ অসীম লৌকিক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হ'ক না কেন। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির সেই সমস্ত কারণের কারণ পরমকারণ, সমস্ত সৃষ্টির উৎসের উৎস পরম উৎস, সৃষ্টির সমস্ত অস্তিত্বের পরম অস্তিত্ব, সৃষ্টির সমস্ত সত্ত্বার সত্ত্বা পরম সত্ত্বা (Supreme cause, Supreme source, Supreme existence, Supreme being) আমার আপনার সবার জীবনে জ্জীবন-স্বরূপ হ'য়ে থাকেন, তিনিই যে আমার অস্তিত্বের মূল উপাদান তা আমরা উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা উপলব্ধি করতে পারি না তার কারণ আমরা তাঁর অস্তিত্বকে স্বীকার করি না ও আমার মধ্যে তিনি অস্তিত্ব স্বরূপ যে বিরাজমান তা জানি না। যতদিন না আমার তরফ থেকে তাঁকে বরণ ক'রে নিই ততদিন তাঁকে আমার ভিতরে উপলব্ধি করতে পারি না। আমি প্রথমে একটা ছোট্ট zygote ছাড়া কিছুই ছিলাম না। যখন কিছুই ছিল না তখনও তিনিই ছিলেন আর ঐ তিনি ছোট্ট zygote হ'য়ে 'ছিল-না'-র বুকে আত্মপ্রকাশ করলেন। আর ঐ ছোট্ট zygote-এর মধ্যে ক্রমশ ধীরে ধীরে বড় হওয়ার যে সম্ভাব্যতা ছিল, যে শক্তি ছিল যার ফলে আমরা এত বড় হয়েছি তাই-ই, সেই শক্তিই এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের সবকিছুর মূল, তিনিই ঈশ্বর। সেই মূল শক্তি, সেই সর্ব্বকারণের কারণ, বিদেহী ঈশ্বর নর বিগ্রহ রূপে মানুষী তনু ধ'রে অর্থাৎ মানুষ মায়ের গর্ভে রক্তমাংসের মানুষ ঈশ্বর হ'য়ে নেমে আসেন। সেই মানুষ রূপী ঈশ্বর হ'লেন একমাত্র শ্রীশ্রীরাম, শ্রীশ্রীকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীবুদ্ধ, শ্রীশ্রীযীশু, শ্রীশ্রীমহম্মদ, শ্রীশ্রীমহাপ্রভু, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও সর্ব্বশেষ The greatest phenomenon of the world, wonder of the world SriSriThakur AnukulChandra.


অবতারঃ আর অবতার মানে যিনি অবতরণ করেছেন। যে বা যিনি বা যা কিছু এই মর্ত্যধামে নেমে এসেছে বা এসেছেন অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার প্রতিটি সৃষ্টিই অবতার। আমি আপনি আমরা সবাই সেই অর্থে অবতার। আবার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং নেমে এসেছেন তাই তিনিও অবতার। শ্রীশ্রীরাম, শ্রীশ্রীকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীবুদ্ধ, শ্রীশ্রীযীশু, শ্রীশ্রীমহম্মদ, শ্রীশ্রীমহাপ্রভু, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ও সর্ব্বশেষ SriSriThakur AnukulChandra-কে অবতার বলা হয়।
অবতারীঃ
কিন্তু তাঁরা নিজেরা মর্তে নেমে এলেও অর্থাৎ অবতরণ করেন বলেই তাঁদেরও অবতার বলা হ'লেও তাঁরা অবতারী। অবতারী মানে? অবতারদের যিনি পৃথিবীতে অবতরণ করান অর্থাৎ মর্তধামে পাঠান। অবতারী তাঁর সৃষ্ট সবাইকেই পাঠান আবার তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করতে নিজেকেও আমাদের মাঝে পাঠান। তাই তিনি একাধারে অবতার আবার তিনিই অবতারী।


আজ এই পর্যন্ত। চেষ্টা করলাম ভগবান, দেবতা ও ঈশ্বরের মধ্যে তফাৎ বা পার্থক্য বোঝাবার। প্রশ্নকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আজকের মত বিদায় নিচ্ছি। আপনাদের প্রশ্ন নিয়ে পরবর্তী ভিডিওতে আবার আসবো। জয়গুরু।

No comments:

Post a Comment