Powered By Blogger

Saturday, April 6, 2024

প্রবন্ধঃ নায়ক ও মহানায়ক উত্তমকুমার।

উত্তমকুমার বাঙ্গালী হ'য়ে জন্মেছিলেন এটাই তাঁর দুর্ভাগ্য।
এরকম অসাধারণ সৌন্দর্য, ভুবনভোলানো হাসি, অমায়িক ব্যবহার, চুম্বকীয় ব্যক্তিত্ব, হলিউডি স্টাইল, সর্বাঙ্গীন সুন্দর, আকর্ষণীয় মুখাবয়ব, উন্নত মানসিকতা, সীমাহীন মানবিক, চরম মূল্যবোধ, নম্রতা ও ভদ্রতার মূর্ত প্রতীক, অনুভূতিসম্পন্ন প্রাণ, নীরব প্রচারবিহীন দাতা , শক্তিমান অভিনেতা, সুরকার, পরিচালক, প্রখর ও গভীর বোধ ও সূক্ষ্ম রসবোধ, শিশুর মতো সহজ ও সরল ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় গুণসম্পন্ন অভূতপূর্ব মানুষ বাংলা্র চলচিত্র জগতে জন্মেছিলেন ব'লে ভারত তথা বিশ্ব চিনলো না।
আর বাংলাও সেই সম্মান তাঁকে দেয়নি। তাঁর মতো মানুষকেও অপমান, লাঞ্ছনা, বদনাম, কুৎসা, নিন্দা সহ্য করতে হয়েছে, হ'তে হয়েছে ষড়যন্ত্রের শিকার আর তা এই বাংলাতেই বাঙ্গালীর সাহায্যে। সেই সময়ের কলকাতার বিখ্যাত ডনকেও লাগানো হয়েছিল তাঁকে অপদস্ত ও হেনস্থা করার জন্য। বোম্বেতেও তিনি সেই সময়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালীদের কারও সাহায্য পাননি যখন তিনি 'ছোটি সি মুলাকাত' ছবি করতে গেছিলেন। শেষের দিকে পড়ন্ত বিকেলে তাঁকে নিয়ে তৈরি শক্তি সামন্তের দ্বিভাষিক ছবি কিছুটা তাঁকে সর্বভারতীয় হ'তে সাহায্য করেছিল।
যার ওপর বিশ্বাস ক'রে তিনি 'ছোটি সি মুলাকাৎ' ফিল্ম তৈরীর ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনিও ছিলেন বেঈমান বিশ্বাসঘাতক বাঙালি। তিনিও ছিলেন উত্তমকুমারের বোম্বেতে মুখ থুবড়ে পড়ার প্রধান কারিগর, উত্তমকুমারের সেই করুণ পতনের বেঈমান বাঙালি মিরজাফর। অবাঙালি বিখ্যাত প্রতিষ্ঠিত চলচিত্র ব্যক্তিত্বরা তাঁর সেই সময়ের অবস্থা দেখে হেসেছিলেন ও উপভোগ করেছিলেন তাঁর করুণ অবস্থা। তাঁর প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের অভাবে ও বেঈমান মীরজাফরের ওপরে তাঁর অত্যাধিক বিশ্বাস ও নির্ভরতার কারণে তাঁর যে ভরাডুবি হয়, তিনি যে গভীর আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন সেই কঠিন দুঃসময়ে তাঁর প্রধান সহ শিল্পীরা তাঁকে ব্যতিব্যস্ত ক'রে তুলেছিলেন তাদের আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে।
আশ্চর্যের ব্যাপার বোম্বের যে ফিল্ম অভিনেতা-অভিনেত্রী, নায়ক-নায়িকাদের নিয়ে, তাদের ফিল্মের ভালোমানুষির রোল দেখে দর্শককুল পাগল হয়, বক্স অফিসে উন্মাদনা সৃষ্টি ক'রে সেই সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রী, নায়ক-নায়িকাদের কেউই সেই সময় বোম্বেতে মানবিক হাত বাড়িয়ে দেয়নি অসহায়গ্রস্থ বাংলা তথা ভারতের চলচিত্র জগতের এক ও অদ্বিতীয় মহানায়কের দিকে। অনেক কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য ক'রে তিনি শেষে ভরাডুবি অবস্থায় বাংলায় ফিরে এসেছিলেন বোম্বে থেকে প্রতারিত হ'য়ে।
উত্তমকুমার শেষ হ'য়ে যেতেন সেই সময় ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে যদি না সেই ভরাডুবির সময় বাংলার আর এক কিংবদন্তী নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী পরিত্রাতার ভুমিকায় তাঁর পাশে এসে না দাঁড়াতেন। আমরা উত্তমকুমারকে সেই সময়ই চিরতরে হারাতাম। পরিচর্যা, সাহস, সহানুভূতি, উৎসাহ, প্রেরণা, বুদ্ধি ও অর্থ সাহায্য দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সামনে দাঁড়িয়ে সক্রিয় হয়ে সেই বিপদের দিনে ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা চিরতরে নিভে যাবার হাত থেকে উত্তমকুমারকে রক্ষা করেছিলেন। এর জন্যে উত্তমকুমারের পাশে চিরদিন অম্লান হ'য়ে থাকবে সুপ্রিয়া দেবীর নাম; উত্তমকুমারের সাথে সাথে তাঁকেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে উত্তম অনুরাগীবৃন্দ।
যদিও এই ভরাডুবি, এই অপমান, এই লাঞ্ছনা, এই পরাজয় তাঁকে অসুস্থ করেছিল। বোম্বেতে তাঁর ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা পরিকল্পিত পরাজয় তাঁকে প্রচন্ড আঘাত করেছিল। বোম্বের ফিল্মজগতে তাঁর উপস্থিতি ঘুম কেড়ে নিয়েছিল সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত নায়কদের। পেশাগত লড়াইয়ে তিনি চলচিত্র জগতের একমেবাদ্বিতীয়ম হ'য়ে ওঠার কারণেই ব্যাক স্ট্যাব হয়েছিলেন।
যাই হ'ক, বিস্তৃত লিখতে গেলে লেখা দীর্ঘ হ'য়ে যাবে। পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে। পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতির কথা ভেবেই লেখায় লাগাম টানছি। উত্তমকুমার এমন একটা অভূতপূর্ব ও আশ্চর্যময় মানুষ যিনি ভগবান, শয়তান, পাগল, বোকা, হাবা, ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, গুন্ডা, গোয়েন্দা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি যে কোনও চরিত্রে ছিলেন সাবলীল।
আর নায়ক অর্থে নায়ক তিনিই। তার প্রমাণ স্বয়ং বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় দিয়ে গেছেন। যে রোলে বিশ্ববিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁকে ছাড়া আর কাঊকেই ভাবতে পারেননি। একমাত্র উত্তমকুমারের কথা ভেবেই সত্যজিৎ রায় 'নায়ক'-এর স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন। উত্তমকুমার না হ'লে সত্যজিৎ রায়ের 'নায়ক' চলচিত্র কোনওদিনই চিত্রায়ণ হত না। আর সেই ছবি আর কেউ করতে সাহস করেন ও করে না। তিনি নায়ক ও মহানায়ক।
( লেখা ২৬ষে ণোভেম্বোড়, ২০২৩)

No comments:

Post a Comment