Powered By Blogger

Saturday, April 27, 2024

প্রবন্ধঃ প্রফুল্লদার 'স্মৃতি তীর্থে' বইয়ের লেখা প্রসঙ্গে।

শ্রদ্ধেয় প্রফুল্লদা তাঁর 'স্মৃতি তীর্থে' বইয়ে ১১০ নম্বর পাতার ১২৯ নম্বর সংখ্যার 'চাই একজন বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন মানুষ' শিরোনামে লিখেছেন,

"ঠাকুরের একদিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা আমার রোজই মনে পড়ে। আমার অবর্তমানে মানুষ আমাকে পাবে বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন ভক্তের মধ্যে। আমার যা দেওয়া থাকলো সেইটের উপর দাঁড়িয়ে একজন মানুষ যদি কাজ করে সেই কিন্তু দুনিয়া ওলট পালোট ক'রে দিতে পারে।
আমি জিজ্ঞেস ক'রেছিলাম, আপনি সেই ধরণের মানুষ কাউকে পেয়েছেন?
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, না।


অনেকের সম্বন্ধে যেমন তিনি উচ্ছসিত প্রশংসা ক'রে গেলেন তেমনি উপযুক্ত মানুষ না পাওয়ার জন্য তিনি দুঃখ ক'রে গেলেন আজীবন। এ সত্যকে যারা অস্বীকার করেন, তাঁরা নিজেদেরকে এবং ঠাকুরকে প্রতারণা করেন। টাকা সৎসঙ্গে যতই আসুক না কেন তা কিন্তু ঠাকুরের দৃষ্টিতে মূল্যবান নয়কো। টাকায় হাত লাগার ফলে ঠাকুরের একদিন দারুণ অস্বস্তি হ'তে থাকে। বারবার হাত ধোন আর বলেন, এ হ'লো Devil's dung, শয়তানের বিষ্ঠা।


এই হ'লো প্রফুল্লদার লেখা 'স্মৃতি তীর্থে' বইয়ের শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখনিঃসৃত কথামৃত।


এই যে বিষয়বস্তু এ সবই প্রফুল্লদার মাথার মধ্যে যা জমা ছিল সেখান থেকে একটা একটা ক'রে তথ্য বের ক'রে এনে এই বই ছাপা হয়েছে। ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর ১৫ বছর আগে ১৯৯১ সালে। আর, শ্রীশ্রীঠাকুরের দেহ রাখার ২২ বছর পরে। আর, তখন শ্রীশ্রীবড়দা ছিলেন। ১৯৯৪ সালে শ্রীশ্রীবড়দা দেহ রাখেন। অর্থাৎ প্রফুল্লদা শ্রীশ্রীঠাকুর থাকাকালীন এই বিযয় নিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে কখনো কোনদিনই আলোচনা করেননি এবং শ্রীশ্রীবড়দা বই প্রকাশের সময় ও তারও পরে ৪ বছর সশরীরে থাকা সত্বেও তাঁব সঙ্গে কোনদিনই আলোচনা করেননি।


স্মৃতির ঘর থেকে বের ক'রে আনা গয়না সব সময় খাঁটি সোনার গয়না হয়না। সবসময় দোষমুক্ত বা ত্রুটিমুক্তো সঠিক ঘটনা হয় না। মস্তিষ্কে ধ'রে রাখা তথ্য অর্থাৎ স্মৃতি সবসময় ত্রুটিমুক্ত হয় না, কিছু না কিছু মূল ঘটনার থেকে তফাৎ থাকে। আর সেই সামান্য তফাৎ-ই বিশাল সমস্যার সৃষ্টি করে, পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি ঘটায়, ইতিহাস বিকৃত হ'য়ে যায়। উদাহরণস্বরুপ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত শ্রীম অর্থাৎ মহেন্দ্রলাল গুপ্তের লেখা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত ৫ খন্ড বই। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে দেখা হওয়া ও কথাবার্তার পর বাড়ি ফিরে এসে রাতে স্মৃতি থেকে আহরণ ক'রে ক'রে সব ডায়েরিতে লিখে রাখতেন। তাঁর নিজের কথায় আমরা জানতে পারি, "বাড়ি ফেরার পর স্মৃতি থেকে সব কিছু লিখে রাখতাম। মাঝে মাঝে সারা রাতও জেগে থাকতে হত...মাঝে মাঝে টানা সাত দিন বসে থেকে লিখতে হত। গানগুলিকে স্মরণে আনতে হত, কোন ক্রমে সেগুলি গাওয়া হয়েছিল, সেগুলিও মনে করতে হত, সমাধি ও অন্যান্য সব ঘটনার কথা মনে করতে হত।" এর থেকে 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত' গ্রন্থের জন্ম রহস্য বোঝা যায়। তাই সেখানে কিছু কিছু অসঙ্গতি থাকলেও থাকতে পারে। এছাড়া আরও অনেকের অনেক গ্রন্থ আছে শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের ওপরে। যেগুলির বক্তব্য সম্পর্কেও প্রামাণিকতা দাবী করে। যেমন শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের বাউল বেশে বর্ধমানের রাস্তায় ঘুরে বেড়াবার কথা আছে যা ঠাকুর রামকৃষ্ণ কখনোই বলেননি।

কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুলচন্দ্রের বেলায় আমরা দেখতে পাই, শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে বসেই তাঁর অনুলেখকরা তাঁর কথা সঙ্কলিত ক'রে রেখেছেন। তাই সেখানে কোনও প্রশ্ন নেই। আর তর্কের খাতিরে সবাই সব জায়গায় সব বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারে। এটা সবার গণতান্ত্রিক বাক স্বাধীনতা। তাই শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের রচনার ক্ষেত্রেও তুলেছে নানা অশ্লীল বিতর্ক।

এখন আসুন একটু দেখে নিই শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রফুল্লদা কি বলতে চেয়েছেন তাঁর এই গ্রন্থে।


প্রফুল্লদার কথানুযায়ী, উপযুক্ত মানুষ না পাওয়ার জন্য শ্রীশ্রীঠাকুর যে দুঃখ ক'রে গেছেন আজীবন এ কথা সত্যি। শ্রদ্ধেয় কেষ্টদা সম্পর্কে ঠাকুর বলেছেন, আপনার মত একটা ভাঙাচোরা মানুষ নিয়ে এত কান্ড করলেম, একটা গোটা মানুষ পেলে আমি গোটা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে পারতেম। তাঁর দেহরূপে থাকাকালীন একবার বিজ্ঞানের ওপরে একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারের ঘটনায় রাশিয়ার ৫ বিজ্ঞানীর বিরাট অবদানের কথা পত্রিকা পড়ে ঠাকুরকে জানানো হ'লে তিনি দুঃখ ক'রে উদাস সুরে বলেছিলেন, আমি যদি পেতেম বিজ্ঞানীদের------। এইসব কথা থেকে বোঝা যায় তাঁর মনের অভ্যন্তরে গভীরে মানুষের অভাবে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ের বহু স্বপ্ন পূরণ না হবার অসহনীয় যন্ত্রনা চাপা ছিল। সারাজীবন তিনি মানুষ ভিক্ষা করেছিলেন।


কিন্তু এই যে প্রফুল্লদা আরও লিখলেন, "এ সত্যকে অর্থাৎ বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন মানুষ ঠাকুর পাননি এই সত্য যারা অস্বীকার করেন, তাঁরা নিজেদেরকে এবং ঠাকুরকে প্রতারণা করেন।" এই কথা কারা অস্বীকার করেছেন? শ্রীশ্রীঠাকুরের কোনও প্রধান ভক্ত মন্ডলী কি অস্বীকার করেছেন? তাহ'লে এই কথা ভরা যৌবনে না ব'লে শেষ বয়সে এসে তাঁর মতন ঋষিতুল্য মানুষের একথা অযথা বলার কারণটা কি ছিল? যদি অস্বীকার ক'রে থাকেন কেউ তাহ'লে তিনি সীমাহীন ভাঙাচোরা মানুষ। তাঁব পরিচিত কেউ অস্বীকার করেছেন কি? আর ঠাকুরের সঙ্গে প্রতারণা করার যে কথাটা তিনি বলেছেন সেটা ঠিক। তিনি দীর্ঘ সময় ঠাকুরের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সাল থেকে তিনি আশ্রমে স্থায়ীভাবে বাস করতে থাকেন এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের তিরোধান ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঠাকুরের লীলাসঙ্গী। এই দীর্ঘসময় পর্যন্ত তিনি এই প্রতারণার বিষয়টি চাক্ষুস করেছেন, বহু অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, করেছেন অনুভব, হয়েছে চূড়ান্ত উপলব্ধি। কিন্তু সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে শ্রীশ্রীঠাকুরের সঙ্গে সৎসঙ্গীদের যন্ত্রণাময় প্রতারণা করার চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও উপলব্ধি তিনি প্রকাশ ক'রে যাননি বলিষ্ঠভাবে কোথাও। কিন্তু জীবনের শেষ সময়ে এসে তিনি ঠাকুর যে একটাও বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন মানুষ পাননি সেই কথা ব'লে গেলেন দৃঢ় চিত্তে। কিসের তিনি ইংগিত দিয়ে গেলেন?

আর, টাকা যে Devil's dung, শয়তানের বিষ্ঠা এ কথা তো শ্রীশ্রীঠাকুরের ক্ষেত্রে সত্যি। এই যে তিনি হাত পেতে টাকা ভিক্ষে করতেন, এই আমাকে দিতে পারিস ব'লে, কিন্তু সেই টাকা তিনি নিজের হাত দিয়ে কোনওদিন ছুঁয়েও দেখেননি। কিন্তু এই যে সৎসঙ্গের আজ বিশ্বজুড়ে বিশাল ব্যাপ্তি সেই বিশাল ব্যাপ্তির পিছনে টাকা ছাড়া কিছুই হ'তো না। টাকা অর্থাৎ অর্থ তখনই Devil's dung, শয়তানের বিষ্ঠা হয় যখন অর্থ তার অর্থ ও উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে। অর্থ শক্তিহীন হ'য়ে পড়ে ও অনর্থের কারণ হয় তখনি। এইটাও ঠাকুরেরই কথা। অর্থ আমার ও আমার পারিপার্শ্বিকের বাঁচা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক হ'য়ে উঠুক। অর্থ যেন জীবনকে ও পরিবেশকে কলুষিত করতে না পারে, বিষাক্ত করতে না পারে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের বাঁচা ও বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, রাজনীতি, ধর্ম ও ইশ্বর সাধনা ইত্যাদি কোনও ক্ষেত্রেই টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। জন্ম নিতেও টাকা লাগে, বাঁচার জন্যও টাকা লাগে এবং মৃত্যুতেও টাকা লাগে। সবেতেই টাকা অপরিহার্য, টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল। আবার টাকায় সমাজ ও সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম মূল কারণ। সেইজন্যই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, কামিনী কাঞ্চন থেকে তফাৎ তফাৎ থাক। তফাৎ থাকতে বলা মানে কামিনী-কাঞ্চনকে জীবন থেকে ছেঁটে ফেলে দিতে বলেননি। বলেছেন, কচু পাতায় টলটলে জল ও পাঁকাল মাছের মত চকচকে থাকতে ঐ কচু পাতা ও পাঁকে থাকা সত্ত্বেও। জীবন ও পৃথিবীকে সুন্দর স্বর্গ ক'রে তোলার এক ও অদ্বিতীয় হাতিয়ার হ'ক কামিনী-কাঞ্চন। আর এই-ই হ'ল জ্ঞান।


যাই হ'ক, এই যে ঠাকুর যে একটাও বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন মানুষ পাননি সেই কথা প্রফুল্লদা ব'লে গেলেন তা এই কথা ঠাকুর তাঁর সমগ্র জীবনে ২৪ হাজার বাণী ও অসংখ্য কথোপকথন সমৃদ্ধ বইয়ের কোথাও ব'লে গেছেন? কেন প্রফুল্লদাকে আলাদা ক'রে শেষ বয়সে এসে এই কথাটা ব'লে বই ছাপাতে হ'লো? তাঁর 'আলোচনা প্রসঙ্গে'-র ২৩ খন্ডের কোনও খন্ডের কোথাও বা অন্য কোনও বইয়ে বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন মানুষ না পাওয়ার কথা ব'লে গেছেন? যদি ব'লে গিয়ে থাকেন তাহ'লে শেষ বয়সে এসে আলাদা ক'রে এই কথা আবার বলার কি দরকার ছিল? এই প্রশ্ন কি তিনি তাঁর দীর্ঘ ৩৯ বছর ধ'রে ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গ
করা কালীন কখনও করেছিলেন? করলে সেটা 'আলোচনা প্রসঙ্গে' ২৩ খন্ডের কোন খন্ডে আছে? আর না করলে কেন করেননি? আর আজই বা সেটা কেন তুলে ধরলেন আবার? কিসের ও কার উদ্দেশ্যে?

আর বলি, বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন মানুষ যদি ঠাকুর না পেয়ে থাকেন তাহ'লে ঠাকুরই বা কেন শ্রীশ্রীবড়দা সম্পর্কে এত কথা ব'লে গেলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত?


শ্রীশ্রীঠাকুর শেষ বয়সে একদিন মানিকপুর থেকে ঘুরে এসে তাঁর শুভ্র শয্যার ওপর বসেছেন। মনটা বেশ ফুরফুরে তাঁর। বেশ আনন্দ হাসিখুশী লাগছে তাঁকে। একজন তাঁকে তামাক সেজে এনে দিলেন। তিনি খোশ মেজাজে তামাক টানছেন। বড়দা ও কাজলদাদাও এসে বসলেন ঠাকুরের চৌকির সামনে। তামাক টানতে টানতে ঠাকুর চারিদিকে তাকাচ্ছেন আর কি যেন খুঁজছেন। দেওয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে ক্যালেন্ডার আর তাঁর কয়েকটা ফটো। সেই ফটোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঠাকুর তন্ময় হ'য়ে গেলেন। ঘরে তখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পর তন্ময়তার ঘোর কাটিয়ে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ ক'রে ফটোর দিকে তাকিয়ে চিনতে না পেরে ধরা গলায় শ্রীশ্রীবড়দাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ ফটোটা কার রে? শ্রীশ্রীবড়দা বলেছিলেন, ওটা আপনার ফটো, আপনার যৌবনের ফটো। শ্রীশ্রীঠাকুর অস্বীকার ক'রে ব'লে উঠেছিলেন, না, এটা তো আমার ফটো নয়, এটা তোর ফটো মনে হয়। শ্রীশ্রীবড়দা আপত্তি করলেন, ঠাকুরকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে ঐটা ঠাকুরেরই ফটো। কিন্তু ঠাকুরকে বোঝানো গেল না, ঠাকুর ফটোর দিকে তাকিয়ে পুনরায় জোর দিয়ে ব'লে উঠেছিলেন, উঁহু, না, না, এটা তো তোরই ফটো। শ্রীশ্রীবড়দা ঠাকুরের জোর দিয়ে বলার ধরণ, দৃঢ়তা দেখেই চুপ ক'রে গেলেন, আর কোনও কথা বললেন না। শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখের ওপর কখনোই শ্রীশ্রীবড়দা দু'বার কথা বলতেন না। শ্রীশ্রীঠাকুর যা বলতেন, সেইসময় চুপ ক'রে থাকতেন। মুখের ওপর কখনোই কোনোদিন কথা বলেননি শ্রীশ্রীবড়দা।


তাই এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝতে পারলাম, শ্রীশ্রীঠাকুর সেদিন গভীর তন্ময়তার মধ্যে ডুবে গিয়ে কথা বলার মধ্যে দিয়ে উপস্থিত সকলকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি ও তাঁর জেষ্ঠ্য পুত্র ও পরম ভক্ত শ্রীশ্রীবড়দা এক ও অভিন্ন।


আর একবার, শ্রীশ্রীঠাকুর বাণী দিচ্ছেন হঠাৎ একজন প্রশ্ন করলেন, এত বাণী ব'লে লাভ কি? কেউ তো কিছু পালনই করে না। কার জন্য এসব? এই কথা শুনেই ঠাকুর চুপ ক'রে গেলেন। মনটা তাঁর খারাপ হ'য়ে গেল। ভারাক্রান্ত হ'য়ে উঠলো পরিবেশ। যিনি বাণী লিখছিলেন তাঁকে ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, "আমি যে এতসব কথা কই কার জন্য?" ঠাকুরের প্রশ্ন শুনে অনুলেখক উত্তর দিলেন, "আজ্ঞে মানবজাতির কল্যাণের জন্য।" তারপর যে আসে তাকেই জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কেউ বলে জগতের কল্যানের জন্য। কেউ বা বলে মানুষকে উদ্ধারের জন্য। কিন্তু কোনও উত্তরই ঠাকুরকে খুশী করতে পারলো না। এই ঘটনার অনেক পরে যখন শ্রীশ্রীবড়দা ঠাকুরকে রোজকার প্রণাম করতে এলেন তখন ঠাকুরকে বড়দা প্রণাম নিবেদন করতেই ঠাকুর শ্রীশ্রীবড়দাকে জিজ্ঞেস করলেন, "হ্যাঁরে বড় খোকা, এরা কি কয়? শ্রীশ্রীবড়দা উৎসুক কন্ঠে বললেন, কি বাবা? শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, আমি যে এত কথা কই কার জন্যে?" শোনা মাত্রই শ্রীশ্রীবড়দা বললেন, "আজ্ঞে, আমার জন্যে।" মুহুর্তে শ্রীশ্রীঠাকুরের মুখ চোখ আনন্দে ঝলমল ক'রে উঠলো। হাসি ছড়িয়ে পড়লো তাঁর সারা মুখে। এক অনির্বচনীয় আনন্দ তাঁকে সুখ সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আনন্দে তাঁর বরতনু কাঁপতে লাগলো। এক স্বর্গীয় সুখে ব'লে উঠলেন দয়াল, ঐ দ্যাখ বড়খোকা কি কয়। বড়খোকা কি কয়?


শ্রীশ্রীবড়দাই একমাত্র দয়াল ঠাকুরের মনের কথা বুঝতে পারতেন।


শ্রীশ্রীঠাকুর দেহ রাখার এক বছর আগে 1968 সালের শেষ বসন্তের এক বিকেলে শ্রীশ্রীবড়দা শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে এলে ঠাকুর তাকে বললেন, বড়খোকা তুই এখানে আমার বিছানায় ব'স, আমি পেছনের ঘরে যাব।
শ্রীশ্রীবড়দা তখনই প্রতিবাদ ক'রে ব'লে উঠেছিলেন। "না, না বাবা! এটা তোমার বিছানা আর তুমি এখানেই থাকো। শ্রীশ্রীঠাকুর এর উত্তরে সেদিন শ্রীশ্রীবড়দাকে বলেছিলেন, "না, তুই এখানে ব'স। তারপর অশ্রুসজল চোখে আদরসোহাগ কন্ঠে জোর ক'রে বলেছিলেন, তুই-ই তো আমি। আমি এখন পেছনের ঘরে যাব। আমি আর শারীরিকভাবে সামলাতে পারছি না।

এই কথা ও দৃশ্যের মর্মবেদনা বোঝে সেই, প্রাণ বোঝে যার, অনুভব করতে পারে সেই, শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্য প্রাণ কাঁদে যার, শ্রীশ্রীঠাকুর আর তাঁর আদরের বড়খোকা শ্রীশ্রীবড়দার
গভীর সম্পর্ক বোঝে সেই উপলব্ধি হয় যার।

শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন,
"এই শোন মনি, বড়খোকা হল তোদের বড়দা। ওর কিছু হওয়া মানে তোদের হওয়া, নাকি কইস? ঐ যে কুকুর, বাড়ী, গাড়ী যা' যা' দেখিস, ও-সব কিছুই ও আমার কাছে চায় না। আমি ওকে কই রাখতি। আমার কথা শুনেই ও চলে। দ্যাখ, আমি যদি ওর উপর Sincere না হই, তবে তোদের উপর হই কেমন ক'রে? যারা শুনবার চাই, তুই ঠিকমত কইস।"
"পরমপিতা যদি বাঁচিয়ে জীইয়ে রাখেন, তবে বড় খোকাই সব দেখাশুনা করবে, সব কিছু পরিচালনা করবে, সে তোমাদের কমিটির ভিতর থেকে হউক, কিংবা বাইরে থেকেই হোক।"
"বড়খোকার বাইরের রূপ দেখে ওর স্বরূপ বোঝা কঠিন। ও বড় সাচ্চা। কেউ যদি ওর ভিতরে ঢুকতে পারে, বুঝে নেবে কেইসা মাল।"
"বড়খোকা শুধু যে আমার Son by birth(ঔরস জাত সন্তান)তাই নয়, Son by culture(কৃষ্টিজাত সন্তান)-ও বটে। সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।"
"যদি আমার কিছু হ'য়ে যায়, আমি না বাঁচি, তবে বড়খোকা রইল, তা'কে মাথায় নিয়ে তোরা সবাই চলিস। তা'র আদেশ ও নির্দ্দেশ মত সবাই যেন চলে"
"বড়খোকার সাথে সবাই'র যা' সম্বন্ধ, আমার সাথেও তাই। ওর সাথে থাকা মানেই আমার সাথে থাকা। আমার মনের কথা বললাম, অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে।"
"বড়খোকা যা' বলবে শুনবি, আমিই বড়খোকা। বড়খোকার সাথে থাকা মানেই আমার সাথে থাকা।"
"আমাকে প্রণাম ক'রে যে বড়খোকাকে প্রণাম করে না তার প্রণাম আমি নিই না।

তাই আবার বলি,
শ্রীশ্রীবড়দাকে তিনি নিজের বিছানায় বসতে ব'লে বলেছিলেন, "তুই এখানে আমার বিছানায় ব'স, আমি একটু পিছনের ঘরে গিয়ে বসি। বড়দা বসতে না চাইলে ঠাকুর তাঁকে জোর ক'রে বসতে ব'লে বলে উঠেছিলেন, না, তুই এখানে ব'স। তুই-ই তো আমি।"
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, "হনুমানজীর পূজা না করলে রামজীর পূজা সম্পূর্ণ হয় না।

ঠিক তেমনি আজ সৎসঙ্গীদের বুঝতে হবে শ্রীশ্রীবড়দার পূজা না করলে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের পূজা সম্পূর্ণ হয় না। শ্রীশ্রীঠাকুরের যে মন্দিরে ও বাড়িতে শ্রীশ্রীবড়দার মূর্তি বা ফটো নেই সেখানে শ্রীশ্রীঠাকুর নেই। যে মন্দিরে ও বাড়িতে শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রণাম ক'রে শ্রীশ্রীবড়দাকে প্রণাম করা যায় না সেখানে শ্রীশ্রীঠাকুর ভক্তের প্রণাম নেন না ও শ্রীশ্রীঠাকুর থাকেন না। কারণ যেখানে তাঁর পরম ভক্তের স্থান নেই, সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই সেখানে শ্রীশ্রীঠাকুরের স্থান নেই, সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই। সেখানে অপমানকারী অশ্রদ্ধাকারী ভন্ডদের ঘরে ও মূর্খদের ঘরে শ্রীশ্রীঠাকুর থাকেন না।




আর, এই যে শ্রদ্ধেয় প্রফুল্লদা 'স্মৃতি তীর্থে' বই ছাপিয়ে লিখে রেখে গেলেন, "আমার অবর্তমানে মানুষ আমাকে পাবে বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন ভক্তের মধ্যে। আমার যা দেওয়া থাকলো সেইটের উপর দাঁড়িয়ে একজন মানুষ যদি কাজ করে সেই কিন্তু দুনিয়া ওলোট পালোট ক'রে দিতে পারে।" এখান থেকে আমরা কি বুঝতে পারি?

এতক্ষণ আমি যে যে ঘটনাগুলি তুলে ধরলাম সেই ঘটনাগুলি থেকে কি আমরা বুঝতে পারি না শ্রীশ্রীঠাকুরের কথার সত্যতা? শ্রীশ্রীঠাকুর তো নিজের মুখেই "বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন ভক্ত" পাবার কথা বলে গেছেন ও ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন তাঁর কথা "আমার অবর্তমানে মানুষ আমাকে পাবে বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন ভক্তের মধ্যে"-এই কথার মধ্যে দিয়েই। তাহ'লে শ্রদ্ধেয় প্রফুল্লদার "আপনি সেই ধরণের মানুষ কাউকে পেয়েছেন?" এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, না। তাহ'লে কি শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই পরস্পর বিরোধী কথা বলেছিলেন? শ্রীশ্রী ঠাকুর বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন একটাও মানুষ খুঁজে পাননি অথচ তিনি এবার সাথীহীন এসেছিলেন ধরাধামে? শ্রীশ্রী ঠাকুর বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন একটাও মানুষ খুঁজে পাননি অথচ তিনি শ্রীশ্রীবড়দা সম্পর্কে নানা ঘটনা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে এতকিছু ইংগিতপূর্ণ কথা ব'লে গেলেন? কি উদ্দেশ্যে? সেই গবেষণাও কি সৎসঙ্গীদের করা উচিত নয়? শুধু শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিয়ে ভক্তিতে গদগদ হ'য়ে গবেষণা ক'রে গেলেই হবে? তাঁর প্রধান ও পরম ভক্ত সম্পর্কে কোনও গবেষণা হবে না? শ্রীশ্রীঠাকুরের যারা অনুলেখক ও বড় বড় প্রথিতযশা উচ্চশিক্ষিত পন্ডিত জ্ঞানী বিদগ্ধ ইষ্টপ্রাণ সৎসঙ্গীরা আছেন তাঁরা শুধু শ্রীশ্রীঠাকুরকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেবেন? তাঁরা কি শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রথম সন্তান, বড় আদরের বড়খোকা, শ্রীশ্রীঠাকুরের কুকুর, বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি সৎসঙ্গীদের বড়ভাই, ত্রেতা যুগের হনুমান, দ্বাপর যুগের অর্জুন, কলি যুগের আনন্দ, ম্যাগডালিন, আবুবকর, নিত্যানন্দ, বিবেকানন্দ ইত্যাদির সম্মিলিত রূপ শ্রীশ্রীবড়দা সম্পর্কে গবেষণা ক'রে দেখবেন না শ্রীশ্রীবড়দা সেই বৃত্তিভেদী টানসম্পন্ন মানুষ কিনা? আমি নাহয় ছেড়ে দিলাম শ্রীশ্রীবড়দার কথা কিন্তু কে সেই বৃত্তিভেদী টানসম্পন্ন মানুষ যার কথা শ্রীশ্রীঠাকুর ব'লে গেছিলেন, "আমার অবর্তমানে মানুষ আমাকে পাবে বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন ভক্তের মধ্যে" এই কথা তলিয়ে দেখবেন না শ্রীশ্রীঠাকুরের বড় বড় প্রতিষ্ঠিত প্রথিতযশা ভক্তেরা? তলিয়ে দেখবেন না এই কথার সত্যতা? তলিয়ে দেখবেন না আদৌ শ্রীশ্রীঠাকুর ব'লে গেছিলেন কিনা, যে তিনি একজনও বৃত্তিভেদী টান সম্পন্ন ভক্ত পাননি এই কথা সত্য কিনা?

কে সেই বৃত্তিভেদী টানসম্পন্ন মানুষ তা কি তিনি নিজের মুখে ব'লে যাবেন ঠাকুর নাকি ঘটনা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের নানা ইংগিতপূর্ণ কথার মধ্যে দিয়ে আমাদের খুঁজে নেওয়ার জ্ঞান, বোধ, বুদ্ধি, চেতনা জাগ্রত করার আজীবন যে শিক্ষা ও তুক দিয়ে গেছিলেন তার সাহায্যে আমাদেরই খুঁজে নিতে হবে? শ্রদ্ধেয় প্রফুল্লদা যে তাঁর পূর্ব গুরুদেব শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণকে শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তা'কি ঠাকুর সরাসরি তাঁকে বলেছিলেন, 'আমি রামকৃষ্ণ'? নাকি নানা রহস্যময় ঘটনা পরম্পরার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, নানা বিস্ময়কর ইংগিতপূর্ণ কথার মধ্যে দিয়ে তিনি শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণকে খুঁজে পেয়েছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে তাঁর অসীম তৃষ্ণা আর যোগসিদ্ধ বলে?


এরকমভাবেই শ্রীশ্রীঠাকুরের সব বড় বড় ভক্তেরা তাঁদের পূর্ব পূর্ব রূপের ইষ্টদেবতাদের শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁদের ইষ্টদেবতার প্রতি গভীর ভালোবাসা, টান ও যোগসিদ্ধির বলে। তাই বিশ্বের কোনা কোনা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে।

আর, যেখানে প্রফুল্লদা লিখেছেন 'স্মৃতি তীর্থে' গ্রন্থে শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন, "আমার যা দেওয়া থাকলো সেইটের উপর দাঁড়িয়ে একজন মানুষ যদি কাজ করে সেই কিন্তু দুনিয়া ওলট পালোট ক'রে দিতে পারে।" একজন মানুষ কি করতে পারে তারও প্রমাণ আমরা দেখতে পেয়েছি শ্রীশ্রীবড়দার জীবনে, পেয়েছি শ্রীশ্রীদাদার জীবনে, পাচ্ছি বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার জীবনে। শ্রীশ্রীঠাকুর যেন জীবন্ত খেলা করছেন বৃত্তিভেদীটানসম্পন্ন ভক্ত শ্রীশ্রীবাবাইদাদার চলা, বলা, আচার, আচরণ, কথাবার্তার ধরণ, চাউনি, অঙ্গুলি হেলন, শরীরীভঙ্গী ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে।


আর, শ্রীশ্রীঠাকুরের বলা "দুনিয়া ওলট পালোট ক'রে দিতে পারে" কথার প্রতিধ্বনি আমরা দেখতে পেয়েছি অভূতপূর্ব বিস্ময়কর যুবক শ্রীশ্রীঅবিনদাদার "কি করবো আর কতটুকু করতে পারবো তা জানি না কিন্তু যাবার আগে আর্ধেক পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়ে যেতে চাই" এই অপূর্ব বিস্ময়কর কথার মধ্যে। বাকী আর্ধেক পৃথিবী নাড়িয়ে দেওয়া না-হয় পরবর্তী সময়ের নেতৃত্বের উপর থাকবে।

যাই হ'ক, চেষ্টা করলাম শ্রদ্ধেয় শ্রী প্রফুল্লদার 'স্মৃতি তীর্থে' গ্রন্থের কথার ওপর দাঁড়িয়ে উত্তর দেবার। সঠিক বেঠিক সেটা বুঝে নেবার দায়িত্ব তামাম সৎসঙ্গীদের।

No comments:

Post a Comment