তাই, গুরুভাইকে বললাম, তাহ'লে কলকে পাবো কি করে? কি উপায়? সবাই যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহ' লে কি নিয়ে বা কাকে নিয়ে বাঁচবো। কার কাছে দেব বাড়িয়ে হাত আশায়-ভরসায়? গুরুভাই এইকথা শুনে চুপ ক'রে রইলো। আর এক গুরুভাই সংগীত শিল্পী জয়ন্তদা গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে বললো, প্রকাশদা, বাইরে এই ভয়ঙ্কর গরম, গা জ্বলে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে এখুনি বুঝি ফেটে যাবে মাথার চাঁদি তবুও সহ্য ক'রে বেঁচে আছি! কিন্তু মানুষের লোভের গরম তাপ লোভের থার্মোমিটারের সর্বোচ্চ পারা ছাড়িয়ে গোটা পৃথিবীর চাঁদি ফাটিয়ে দিয়েছে! লোভের গরম ফুটন্ত লাভা গলে গলে ছড়িয়ে পড়ছে গ্রাম শহরের জনপদ ছাড়িয়ে আর গোটা পৃথিবীকে জড়িয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে আষ্টেপৃষ্টে! চোরের দেশে আর কলকে পেতে হবে না! এর থেকে বরং কলকে-কে চিরদিনের সাথী ক'রে নিন! আর গেয়ে উঠুন, এক টানেতে যেমন তেমন দুই টানেতে সুখী, তিন টানেতে রাজউজির, চার টানেতে রুগী! আমি হাসতে হাসতে গেয়ে উঠলাম এক কলি। তারপর পরিবেশের গরম হওয়া একটু হালকা করার জন্য গাইলাম, "দম মারো দম, মিট জায়ে হাম; বোলো সুবা শাম হরে কৃষ্ণ হরে রাম"। তারপর বললাম, সে তো সত্য কথা। মানুষের লোভের শেষ নেই, অন্তহীন লাগামহীন লোভ! জয়ন্তদা বললো, কত টাকা দরকার মানুষের!? থরে থরে টাকা সাজিয়ে রেখে দিয়েছে ঘরের আলমারিতে, ব্যাংকে, দেশের ব্যাংক ছাড়িয়ে বিদেশের ব্যাংকে! কি অদ্ভুত অদ্ভুত দেশ পৃথিবীর বুকে আছে যারা অন্য দেশের অসৎ লোকেদের দ্বারা দেশকে নাঙ্গা, লুলা, ল্যাংড়া ক'রে দিয়ে রোজগার করা অসৎ পথের টাকা সযত্নে বুক দিয়ে আগলে রাখার, রক্ষা করার ব্রত নিয়েছে! লোক অসৎ হয় একটা দেশ অসৎ হয়! আমি বললাম, দেশ চালায় কারা? মানুষ! সেই মানুষই যদি অসৎ হয়, দেশের প্রথম সারির মানুষ যারা দেশকে পরিচালনা করে, দেশের মানুষকে দিশা দেখায় তারা যদি মানুষ না হয়, আদর্শবান না হয়, আদর্শ কেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত না হয়, ঈশ্বরপ্রেমী না হয় তাহ'লে আপনি তাদের কাছ থেকে ত্রুটি হীন কাজ, চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টি পাবেন কি করে? আপনি কি জানেন ঠাকুর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসকে কি বলেছিলেন? বলেছিলেন, দাস দা, স্বরাজ স্বরাজ করছেন, দাশ স্বাধীন হ'লে কাদের উপর দেশের দায়িত্ব দেবেন? ঘোড়া গাড়ি টানে নাকি গাড়ি ঘোড়া টানে? ঠিক তেমনি দেশ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় নাকি মানুষ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়? এই কথায় জয়ন্তদা বললেন, তাই বলে দেশের সমস্ত মানুষতো আর অসৎ নয়! সে ঠিক কথা, আমি বললাম। কিন্তু দেশ পরিচালনার সঙ্গে যারা যুক্ত, যারা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করেন তারা যদি আপাদমস্তক শরীরে-মনে-আত্মায় সৎ না হয়, তারা যদি অসৎ-এর পূজারী হয় তাহ'লে যা হবার তাই-ই হয়! মহাভারতের পুনরাবৃত্তি হয়! ঐ যে আপনি প্রথমে বললেন, পড়েছো মোগলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে! ঐটাই ঠিক কথা!
জয়ন্তদা বললেন, কত টাকা দরকার একজনের!? এত টাকা-আ-আ-আ! ইচ্ছা করলেই কত মঙ্গলব্রত করতে পারে! মানুষের জন্য, মানুষের বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য কত ভালো ভালো কাজ করতে পারে! টাকাগুলো কাগজ হ'য়ে পড়ে থাকে ঘরে, আলমারিতে, ব্যাংকে! কত বড় মাছ খাবে!? ১০০গ্রাম, ২০০গ্রাম, ৫০০গ্রাম ওজনের মাছ খাবে! আর কতবড় খাবে!? হতাশায় রাগে বিরক্তি ঝরে পড়লো জয়ন্তদার চোখে মুখে। শিল্পী মানুষ, এমনিতেই শান্ত, রাগটাগ নেই বললেই চলে আর থাকলেও সহজে প্রকাশ পায় না আর পেলেও বলার মধ্যে থাকে না কোনও উত্তেজনা, কোন আক্রোশ! সেই মানুষও যখন এমন কথা বলে তখন ভাবি, কেমন ক'রে বোঝায় তারে! এ ভারী কঠিন কাজ। এর থেকে বরং সোজা তাকে গানের কথা বলে ঠান্ডা করা। তাই হেসে বললাম, আচ্ছা আমি যদি বলি আপনাকে, 'কেমন ক'রে গান করো হে গুণী! আমি শুনি!" তারপর একটু পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম, আপনি বিয়ে বাড়িতে দেখেছেন কত লোক খাবার নষ্ট করে! কেন করে!? খেতে পারবে না জেনেও পাতে নেয় তারপর ফেলে রেখে উঠে পড়ে! কেন? আমিও দেখেছি, আপনিও দেখেছেন এ দৃশ্য নেমন্তন্ন বাড়িতে সবসময়! পরিবেশন করতে এলে পাতে জায়গা নেই, পেটে জায়গা নেই অথচ নিয়ে যাচ্ছে! পাত ভর্তি ক'রে নিচ্ছে কখনও বা পাশের জন জোর ক'রে নেওয়াচ্ছে আর তখন চুপ ক'রে থাকছে পরে অবহেলায় অবলীলায় পাত ভর্তি খাবার ফেলে দিয়ে উঠে যাচ্ছে নারী-পুরুষ, বাচ্চা-বুড়ো হাসতে হাসতে! এটা কেন হয়? কেমন ক'রে মন চায় এত খাবার নষ্ট করার!? বাড়িতে কি নষ্ট করে? করে না। কারণ বাড়িতে মাপা খাবার। আর নষ্ট করলেও অল্প বিস্তর, হঠাৎ বড়লোক হবার অহংকারে তা করে। ঠাকুর বলেছেন, যারা Upstartar অর্থাৎ হঠাৎ বড়লোক তারা হীনমন্যতায় ভোগে! তারা অতীতকে মনে রাখতে চায় না! তারা সবসময় আশঙ্কায় থাকে, এই বুঝি সবাই অতীত জেনে গেল! এটা একটা বিশৃঙ্খল অভ্যাস, নেওয়ার লোভ! নাও, নাও আরো নাও! গরীব বড়লোক সবারই এই রোগ আছে। যে যেমন সুযোগ পায় সে তেমন কোপ মারে! পুকুর চুরিও চুরি আবার স্কুলের চক চুরিও চুরি! তবে চুরির প্রকারভেদ অবশ্যই আছে। এই যে নেওয়ার অভ্যাস এই অভ্যাস জানতে-অজান্তেই ঘটে যাচ্ছে! অবশ্য বদমাশ মানুষও আছে যারা পাহাড় বানাবে ব'লে নেবে! তা' সে ভোগ হ'ক আর না হ'ক, নষ্ট হ'ক আর যাই হ'ক নেবে! আমার হকেরটা, হকের বাইরেটা সবটাই আমি নেব! কি করবেন আপনি? এ হ'লো আম আমাশা রোগ! পিচিত ক'রে বেরিয়ে পড়ে।
এছাড়াও আপনি দেখবেন, বাড়িতে কেউ এলে তা সে আত্মীয়স্বজন, অতিথি বা বন্ধু বান্ধব যেই হ'ক তাদের অতিথি আপ্যায়নের জন্যে খাবার দিলে প্লেটের সেই খাবার অল্প খেয়ে এঁটো ক'রে বাকি খাবার ফেলে রেখে দেবে! এটা তাদের স্ট্যাটাস মেইন্টেনের মধ্যে পড়ে! একবারও ভাবে না তাদের মুখের এত এঁটো খাবার, এত মিষ্টি কে খাবে! কত কষ্ট ক'রে রোজগার করা পয়সায় খাবার কিনে এনেছে! এ বাঁহাতি টানা মালের পয়সায় কেনা খাবার নয়! এ তো জেনেবুঝেই পয়সার অপচয়! তারা কি ভাবে? তারা কি ভাবে অল্প খেয়ে, আধা খেয়ে গৃহকর্তাকে তারা ধন্য করেছে? তাদের এঁটো খাবার তারা চলে যাবার পরে বাড়ির লোকেরা খাবে? বিশেষ ক'রে তা হ'য়ে থাকে নিম্ন বিত্তের ঘরে উচ্চ বিত্তের আগমনের ঘটনায়!
যাই হ'ক ভাবার কথা নিয়ে শুরু হয়েছিল লেখাটা; এই ভাবার কথায় বলা যেতে পারে গরিবের কথা মুখে বলার জন্য বহু মানুষ আছে, এমনকি গরীব মানুষও আছে! কিন্তু গরীবের পাশে দাঁড়ানো বা গরীবের জন্য কিছু করার জন্য, নিদেন পক্ষে ভাবার জন্য তারা নয় বরং গরীবের গরীবি ভাঙিয়ে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে বড়লোক হবার জন্য তারা দিনরাত প্রাণপাত করে। 'ম'-কার সম্বন্ধীয় সব নেশার চেয়েও টাকা কমানো, ক্ষমতা দখল একটা তীব্র নেশা! যে নেশার উইথড্রয়াল-এর রূপ ধ্বংসাত্মক টাইফুন, আয়লা, ফণীর ভয়ঙ্কর রূপকেও হার মানায়! তাই আম আদমী, গরীব আদমী তোমার কথা ভাবার সময় কোন রাজনৈতিক দল, নেতা বা এলিট সম্প্রদায়ের নেয়!
হে গুরুভাই আমার! তোমার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা চলবে কি চলবে না এত পাতি ব্যাপার ভাববার সময় তথাকথিত 'সমাজ কো বদল ডালো' আন্দোলনের নেতাদের, সরকারের, সমাজপতিদের নেই। যদি কখনও ভাববার সময় হয় তবে জেনো নিশ্চিত ডাল মে কুচ কালা! তোমার ভাবনা তোমাকেই ভাবতে হবে গুরুভাই! এটাও মনে রেখো তোমার বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য এই যে ভাবার লড়াই এই লড়াইয়ে তোমার পাশে তোমার গুরুভাইয়েরাও নেই!!!!!!!
তাহ'লে কে আছে তোমার পাশে বন্ধু!? বন্ধু নেই, সরকার নেই, রাজনৈতিক দল নেই, নেতা নেই, সমাজপতি নেই, নেই কোনও বিদগ্ধ সমাজের প্রতিনিধি! গভীর অন্ধকারের মহাশূন্যতার মাঝে তুমি একা! একা!! একা!!! কে আছে!
ক্রমশঃ।
( লেখা ১২ই মে' ২০১৯ )
No comments:
Post a Comment