Powered By Blogger

Sunday, May 7, 2023

প্রবন্ধঃ করোনা মহামারী ও আচার্য্য পরম্পরা। ১

করোনার আক্রমণে গোটা পৃথিবীতে মানুষের ব্যবহারিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে আর সেই পরিবর্তন আমাদের সৎসঙ্গীদের মধ্যেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। করোনার প্রভাবে মানুষের পৃথিবীতে আজ মানুষ যে মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে আর মানুষ আপন টাকা যে পর....... এই লোকসেবার ছবি আজ যেদিকে তাকাই সেদিকেই সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আর সেই ছবি প্রকাশের গতির যে তীব্রতা বিভিন্ন মিডিয়ায় সেই তীব্রতা করোনার অগ্রগতির তীব্রতাকেও হার মানিয়ে দিয়েছে! সেই যে গান "একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না, ও বন্ধু------" সেই সহানুভূতি প্রদর্শনের ঢেউ দেশের দ্বীপপাল থেকে পঙ্গপাল আর জমিদার থেকে জমাদার সবার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে!

এরই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হ'লো মহামারী (করোনা) বা বিপর্যয় ও আচার্য্য পরম্পরার সম্পর্কের কথা! এই নিয়ে ঘনিষ্ঠ সৎসঙ্গীদের সঙ্গে যখন আলোচনা করলাম, তখন তারা হাসতে হাসতে পরস্পর পরস্পরকে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে ফুৎকারে আমার কথাকে উড়িয়ে দিয়ে বললো, যত্তসব পাগলের প্রলাপ!!!!!

কিছুক্ষণ চুপ ক'রে গেলাম, তারপরে ভাবলাম দেখা যাক এই পাগলের প্রলাপ নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। দেখা যাক সত্যি সত্যিই পাগলের প্রলাপ কিনা। আসুন একটু দেখে নিই এই করোনার কারণে বিভিন্ন কেন্দ্র-মন্দিরে লোকসেবার্থে সৎসঙ্গীদের গৃহীত পদক্ষেপের সঙ্গে আচার্য্য উপস্থিতি ও আচার্য পরম্পরার কি সম্পর্ক!!!!!!!!!!

করোনা মহামারীর প্রকোপ যে এতটা ভয়ঙ্কর হবে কোনও দেশের প্রধান, রাজ্যের প্রধান থেকে শুরু ক'রে দেশের আমজনতা আরো সহজ ক'রে বললে ভালো হয় দেশের দ্বীপপাল থেকে পঙ্গপাল, জমিদার থেকে জমাদার কেউ কল্পনা করতে পারেনি! এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে কল্পনা করার শক্তিই নেই, নেই বায়োলজিক্যালি ভাবেই!! এই কল্পনা শক্তি হারিয়ে গেছে সব ক্ষেত্রেই বহু বহু বছর আগেই যেদিন থেকে জন্মবিজ্ঞান আর্য্যকৃষ্টি বহির্ভূত প্রকৃতির নিয়ম উল্লঙ্ঘনীয় মিলন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল!

এই করোনার ভয়ঙ্কর থাবা যে এত দ্রুত ও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে তার আগাম কল্পনা করতে না পারার কারণে সারা পৃথিবীতে বিজ্ঞানে উন্নত, অতি উন্নত দেশগুলি করোনার ভয়ঙ্কর আক্রমণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার! আমরা আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে এক নজরে দেখে নিই বিশ্বে মোট কত করোনায় আক্রান্ত, কত সুস্থ আর কত লোক মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে! আর দেখে নিই ভারতের ছবিটাই বা কি! তারপরে দেখবো এই করোনার কারণে সৎসঙ্গীদের দুর্গতদের জন্য সেবাকার্য্যে অংশগ্রহণ কতটা ত্রুটিমুক্ত!

আর্টিকেল প্রকাশের (৭ইমে' ২০২০) তারিখ পর্যন্ত সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা বিশ্বে আক্রান্ত: ৩৬ লক্ষ ৮২ হাজার ৯৬৮ জন।
সুস্থ: ১২ লক্ষ ০৭ হাজার ৫৪৮ জন।
মৃত্যু: ২ লক্ষ ৫৭ হাজার ৯০৬ জন।
ভারত: জনসংখ্যা ১৩৫কোটি ২৬ লক্ষ।
আক্রান্ত: ৩৭, ৩৩৬ জন,
সুস্থ: ৯, ৯৫১জন,
মৃত্যু: ১,২১৮ জন।

চীন দ্রুত নিজেকে এই ভয়াবহ মহামারীর হাত থেকে সামলে নিয়েছে ও নিচ্ছে। এই করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনের সম্পর্কে অনেক কিছুই শোনা যায় সেগুলি এখানে আলোচ্যের বিষয় নয়। আলোচ্য এই, করোনা মহামারী যখন উন্নত অতি উন্নত দেশগুলির উপর তার ভয়াবহ থাবা বসিয়ে শেষ ক'রে দিচ্ছে তখন ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশে এর প্রভাব কতটা ও তার কার্যকারিতা কি তাই নিয়ে। আলোচ্য বিষয়, এর মোকাবিলায় প্রশাসন ও জনগণের ভূমিকা।

ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে করোনা মোকাবিলায় প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়া হয় ২০২০ সালের ২২শে মার্চ ১৪ ঘন্টা জনতা কারফিউ পালনের মধ্যে দিয়ে। পরে ২৪শে মার্চ দেশজুড়ে ২১দিনের লক ডাউন ঘোষণা করেন। আর বর্তমানে লক ডাউন ১৭মে পর্যন্ত এক্সটেন্ড করা হয়েছে। ভারতে প্রথম করোনা ধরা পরে ২০২০ সালের ৩০শে জানুয়ারি। এই ৩০শে জানুয়ারী থেকে ২৪শে মার্চ পর্যন্ত সামান্য দীর্ঘ সময় নষ্ট কতটা ভয়াবহ হ'তে পারে তা দেখিয়ে দিল করোনা নামক এক ছোট্ট পোকা!

দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যখন যে পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটারই সমালোচনা ব্যঙ্গ বিদ্রুপ হয়েছে ভারতে বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের পবিত্র মাটিতে। তদ্রুপ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়েও তাই হয়েছে! আবার যখন এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা চলছে দেশে দেশে আর তার ঢেউ এসে আছড়ে পড়তে চলেছে ভারতের মাটিতে আর সরকার, সরকারি প্রশাসন, জনগণ যখন ভীত সন্ত্রস্ত তখনও রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতির পাশার দান চেলে গেছে খোদ দেশের রাজধানী দিল্লিতে ও পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে করোনা মহামারীকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! গণ্ডিস্বার্থ কাকে বলে, গন্ডিস্বার্থী নেতা কেমন, লোকপূরণ স্বভাবহারা নেতা কিরকম নেতা, মানুষকে সইতে না পারার মানসিকতা কেমন এই সমস্ত কিছু করোনার এক ঝটকায় আমাদের কাছে উন্মোচিত হ'য়ে গেল!!!

এইসমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী দেশকে, দেশের জনগণকে, সভ্যতাকে, দেশ ও জনগণের মঙ্গলকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর হাতছানির সময়ে নতুনভাবে প্রমাণ করলো শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণী কতটা জীবন্ত ও এইসময়ে প্রাসঙ্গিক!
শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছিলেন,
"ইষ্ট নাই নেতা যেই, যমের দালাল কিন্তু সেই!
গন্ডীস্বার্থী হবে যে নকল নেতা জানিস সে।
লোকপূরণ উপেক্ষি যে গন্ডীস্বার্থী ধরে,
শিষ্ট নেতা নয়কো সে-জন নকল হ'য়েই মরে।
মানুষকে যে সইতে নারে যে-জন তাদের বয় না,
লাখ মোড়লি ঝাঁকুক না সে নেতা তা'রে কয় না।"

কি অদ্ভুত এই বাণীর অন্তর্নিহিত অর্থ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দিল্লীর শাহীনবাগ ও নিজামুদ্দিন, কলকাতার রাজারহাট, মহারাষ্ট্র রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদির বর্তমান ঘটনা প্রমাণ করলো!

আর এই কঠিন সময়েও রাষ্ট্রের শাসনদন্ড যাদের হাতে তাদেরও দেখলাম কতটা দুর্বল, কতটা অসহায়, কতটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়!!!!
দেশের স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও দেশের শাসনব্যবস্থা ল্যাংড়া হ'য়েই রইলো!! দুর্বল হাতে দেশের শাসনদন্ড ধরিয়ে দিয়ে সেই যে ব্রিটিশ যাবার সময় দু'টুকরো ক'রে ল্যাংড়া ক'রে দিয়ে গেল ভারতকে আজও এত বছর পরেও ভাঙা পা জোড়া লাগলো না, ল্যাংড়া আর সোজা হ'য়ে দাঁড়ালো না, হাঁটা তো দূরের কথা!!! উল্টে আমরা কি দেখতে পেয়েছি এতবছর বা কি দেখছি!? শ্রীশ্রীঠাকুরের বাণীতে তার নিদর্শন আমরা খুঁজে পাবো।
শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন,
"রাষ্ট্রশাসনদন্ড দেশের চললে শিথিল পায়,
শিষ্ট দলি' অজ্ঞ বেকুব লোকশাসনে ধায়।"

এ তো গেল দেশের স্টিয়ারিং যাদের হাতে ছিল তাদের কথা। কিন্তু এই করোনা মহামারীর ভয়াবহতার সময়ে দুর্গত মানুষদের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তাদের কর্মীবৃন্দ, বিভিন্ন ক্লাব, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগেও যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের সাহায্যের বহর দেখে মনে হয়েছিল সত্যি সত্যি বুঝি সত্য যুগ ফিরে এলো!!!! করোনা এসে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে জাগিয়ে দিয়ে এক ক'রে দিয়ে গেল এই বোধে, "মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য...."। কিন্তু তার মধ্যে যেটা খারাপ লাগতো তা হ'লো এই সাহায্যের সময় ফটো তোলার হিড়িক দেখে! দিকে দিকে গরিব মানুষ আর প্রশাসনের হাতে সামান্য সাহায্য তুলে দিচ্ছে এইসমস্ত সাহায্যকারী দল আর সেই সাহায্যে একসঙ্গে ১০টা হাত ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে গরীব অসহায় মানুষগুলোর হাতে ধরিয়ে দেওয়া সামগ্রী আর প্রশাসনের হাতে ধরিয়ে দেওয়া চেকেতে আর তা ফটো হ'য়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়!!!!!!! চতুর্দিকে দয়ার বান ডেকেছে! প্রত্যেকেই নেবে পড়েছে সাহায্যের ঝোলা নিয়ে! খুব আনন্দ হচ্ছিল এইভেবে যাক দুর্গত মানুষদের জন্য প্রাণ কাঁদে কিছু মানুষের! যাক দুটো খেয়ে বাঁচুক দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ! আবার মনে হ'লো যখন করোনা মুক্ত হ'য়ে যাবে পৃথিবী তখন তো আর এই সাহায্য থাকবে না, অদৃশ্য হ'য়ে যাবে এই হাত! যেমন হঠাৎ এসেছিল মা লক্ষী হ'য়ে আবার হঠাৎ উধাও হ'য়ে যাবে, গায়েব হ'য়ে যাবে ঐ হাত! তখন কি হবে!? মন বললো, যাক যা হবার হবে। এখন তো দুটো খেয়ে বাঁচুক! এখনও মরতো তখনও মরবে। না খেয়ে মরার চেয়ে দুটো খেয়ে মরুক হাভাতের দল! বরং করোনা মায়ের পুজোর প্রচলন হ'ক! গরিবের কাছে, দুর্গত মানুষের কাছে করোনা 'জাগ্রত মা করোনা দেবী' হ'য়ে আবির্ভুত হ'ক প্রতিবছর এইদিনগুলিতে! নতুন এক জাগ্রত দেবতার প্রচলন হ'ক গরিব মানুষ, দিন আনা দিন খাওয়া দুর্গত মানুষের কাছে! আর শুরু হ'য়ে যাক ব্যবসার উপকরণ হিসেবে ধান্দাবাজ ধার্মিক আর ব্যবসায়ীদের কাছে আর এক দেবতা মা করোনার পুজো!

আর এই ঘোর কলিযুগে দয়ার বান ডাকা মৃত্যু ভয় দেখানো ছাড়া সম্ভব নয়! ভয়ে ভক্তি এই ঘোর কলিযুগে দয়ার বন্ধ দরজা খুলে যাবার চাবিকাঠি! দানের মাধ্যমে যদি ঈশ্বরের দয়া পাওয়া যায়, পাপ মুক্ত হওয়া যায়, করোনার হাত থেকে বাঁচা যায়! ব্যতিক্রম অবশ্য অবশ্যই আছে। আর মুষ্টিমেয় তাদের জন্য আজও সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে আর পশ্চিমদিকে অস্ত যায়! আর তাছাড়া এর থেকে আরো বোঝা যায় আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি পর্ব শুরু হ'য়ে গেলো! যেন, কারো সর্বনাশ আর কারো পৌষ মাস-এর কাউন্ট ডাউন শুরু হ'য়ে গেছে!

আর ভাবলাম কোথায় গেল এই কঠিন সময়ে সাম্যবাদী, সমাজ কো বদল ডালো, গরিবের মসিহা কমিউনিষ্টরা!? হা কমিউনিস্ট! যখন সবচেয়ে বেশি তোমাদের দরকার গরীবদের তখন কোথায় তোমরা!? কোথায় পাড়ি জমিয়েছো পরিযায়ী পাখির মতন এই সময়ে!!!!?
যাই হ'ক এসব দানের ছবি দেখতে দেখতে মনের মধ্যে কে যেন অশ্রুসজল কণ্ঠে গুনগুন ক'রে গেয়ে উঠলো:

"চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়
আজিকে যে রাজাধিরাজ কা'ল সে ভিক্ষা চায়।
অবতার শ্রীরামচন্দ্র যে জানকীর পতি
তারও হলো বনবাস রাবণ করে দুর্গতি।
আগুনেও পুড়িল না ললাটের লেখা হায়।।
স্বামী পঞ্চ পাণ্ডব, সখা কৃষ্ণ ভগবান
দুঃশাসন করে তবু দ্রৌপদীর অপমান,
পুত্র তার হলো হত যদুপতি যার সহায়।।
মহারাজ হরিশচন্দ্র, রাজ্য দান ক'রে শেষ
শ্মশান-রক্ষী হয়ে লভিল চণ্ডাল-বেশ
বিষ্ণু-বুকে চরণ-চিহ্ন, ললাট-লেখা কে খণ্ডায়।।"

ক্রমশঃ
(লেখা ৭ই মে' ২০২০)


No comments:

Post a Comment