গুরুভাই একটু চুপ ক'রে রইলো! মনে হ'লো কি বলবে তা যেন একটু গুছিয়ে নিতে চাইলো। এলোমেলো হ'য়ে যাচ্ছিলো কথাগুলি। উত্তেজনায় আর রাগে ক্ষোভে দুঃখে মিলেমিশে একাকার হ'য়ে যাচ্ছিল সব। কিন্তু 'কেন এমন হ'লো' প্রশ্নের উত্তরে এলোমেলো কথাগুলি পরপর সাজালে যা দাঁড়ায় তা হ'লো অনিয়ন্ত্রিত অপরিকল্পিত সমাজ ব্যবস্থায় কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! তা পৌষ মাস কাদের হ'লো আর কাদেরই বা সর্বনাশ হ'লো তা বুঝতে একটু অপেক্ষা করতে হ'লো।
ব্যাপারটা হ'লো, আজ মা-ও নেই, নেই ছোটবেলার সেই দিনগুলিও আর! ছোটবেলায় মায়ের বকা মনে পড়ে যায়! মা বলতো, "সারাদিন টো টো ক'রে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কোন কাজ নেই? পড়াশুনা নেই?" আর এখন ছেলে বলে, "এই টোটো ক'রে এলাম, বাবা তুমিও টোটো ক'রে একটু ঘুরে এসো! বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে! ভালো লাগবে!" সেই টোটো-ই হ'লো গুরুভাইয়ের সর্বনাশের অন্যতম প্রধান কারণ! অন্যতম কেন বললাম সেটাও পরে বলছি। এখন পশ্চিমবঙ্গে নতুন পরিবহন যান-এর নাম 'টোটো'। বড় রাস্তা জিটি রোডে, পাড়ায় পাড়ায়, এলাকার ছোটো রাস্তা, অলিতে-গলিতে সর্বত্র টোটোর জয় জয়কার! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টো টো ক'রে ঘুরে বেড়াচ্ছে টোটো! একদিন যেখানে রিকশাস্ট্যান্ড ছিল তা আজ টোটো স্ট্যান্ড! প্রায় সব রিক্সাচালকই আজ টোটো চালক! যদিও কিছু রিকশাচালক আজও রিকশা চালায় কারণ তাদের না আছে কেনার সামর্থ্য, না আছে সুযোগ, সাহায্য, সহযোগিতা! এছাড়া এলাকায় এলাকায় পড়াশুনাজানা-নাজানা আজ সমস্ত বেকার যুবক, কল-কারখানা বন্ধের শ্রমিক সবাই আজ নেবে পড়েছে টোটো নিয়ে টো টো ক'রে রোজগারের জন্য। এখন টো টো ক'রে ঘুরে বেড়ানোর মানে গিয়েছে বদলে, টো টো শব্দের মান গিয়েছে বেড়ে কিন্তু অন্যদিকে যে অন্যের জীবন ধারণের মান নেবে গিয়ে তলানিতে ঠেকেছে সেদিকে কারও হুঁশ নেই, নেই ভ্রূক্ষেপ! আর থাকার কথাও না। এখন ঘোর কলি! কলি যুগের প্রমাণ কি? দুনিয়া ভাঁড় মে যায়, আমার গায়ে আচঁ না লাগে ফুরিয়ে যাবে মামলা----এই হ'লো কলি যুগের নিদর্শন!
এই কলি যুগের ছোবল খেয়েছে আমার গুরুভাই! অটোর পর টোটোর সীমাহীন বাড়বাড়ন্ত রিকশা চালকদের জীবনে নিয়ে এসেছে দুঃখের কালো মেঘ! এমনিতেই দুঃখ ছিল, ছিল কষ্ট কিন্তু তার মধ্যেও রিকশা চালকদের ছিল বাড়বাড়ন্ত! আর সেই বাড়বাড়ন্তের সময় তাদের অনেকের মেজাজও ছিল জমিদারী! কিন্তু আজ রিকশাচালকের সংখ্যা কমে গেছে কিন্তু যারা আছে তাদের অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবার মত! এই কঠিন পরিস্থিতিতে সাইকেল রিকশা সারাবার দোকানদারদের অবস্থা তথৈবচ! বড় বড় দোকানগুলো আজ কেমন জানি জৌলুস হারিয়ে বিবর্ণ হ'য়ে ঝোড়ো কাকের মত দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারে! আর ছোট দোকানগুলো যারা শুধুই রিকশা, সাইকেল সারাতো তারা পথ চেয়ে বসে থাকে কখন একটা রিক্সা বা সাইকেল আসবে! সাইকেল এলেও রিকশা আর আসে না! দোকানে বসে থাকে দোকানদার আর মিস্ত্রি! যেন দিনগত পাপক্ষয়!
৩
সেই সাইকেল-রিকশার দোকানে দোকানে অল্পবিস্তর যন্ত্রাংশ সাপ্লাই দিত আমার গুরুভাই! কিন্তু টোটোর দাপটে আজ রিক্সা গিয়েছে প্রায় উঠে! ক'দিন পর কলকাতার টানারিকশার মত অবস্থা হবে সাইকেলরিক্সার! যেমন একদিনের এশিয়ার বিখ্যাত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মোটরগাড়ি তৈরীর কারখানা হিন্দমোটরের আম্বাসাডার গাড়ি আজ বিলুপ্ত! কারখানা পুরোপুরি বন্ধ! কোনও সম্ভাবনাই নেই আর খোলার! সব সেট আপ আজ ধ্বংস! কলকাতার রাস্তায় পুরোনো কিছু গাড়ি আজও চলছে। যতদিন সেইগাড়িগুলির আয়ু আছে ততদিনই চোখে পড়বে তারপর ইতিহাসের পাতায় চলে যাবে সেই গাড়ি আর গাড়ির কারখানা 'হিন্দমোটর'!!!!!! রয়ে যাবে হয়তো হিন্দমোটর স্টেশনের নাম! তাও কালের নিয়মে নতুন প্রজন্মের হাত ধ'রে হয়তো স্টেশনের নাম পাল্টে হ'য়ে যাবে নতুন নাম!
যাই হ'ক, যা বলছিলাম সেই কথায় আসি। আমার গুরুভাই যে দোকানগুলিতে সাপ্লাই দিত সাইকেল, রিকশার যন্ত্রাংশ সেই দোকানগুলোর প্রায় অনেক দোকান আজ অতীত হ'য়ে গেছে আর যে ক'টা দোকান আছে সেগুলো অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে আগামী সুন্দর ভবিষ্যতের আশায়! কথায় আছে, আশায় মরে চাষা। কোন চাষা? ছোট চাষা! অন্যের জমিতে চাষ ক'রে খায়, দিন গুজরান করে যে চাষা সেই চাষা! আর আমি বলি, দিন গুজরানী চাষা, শ্মশান তোর বাসা! তা আমার গুরুভাই সেই 'দিন গুজরান ক'রে খায়' চাষার এক চাষা! টোটোর এক টোটকায় সব ধরাশায়ী! দোকানগুলোতে আর তেমন রিকশা বিক্রি হয়না, হয়না আর সারাইয়ের কাজ! টিমটিম ক'রে জ্বলতে থাকা আলো অন্যকে কি আলো দেখাবে!? যার নিজের দোকানেই লালবাতি জ্বলে গেছে সে আমার গুরুভাইয়ের মত ছোট চাষাকে কি অর্ডার দেবে!? নিজের অস্তিত্ব যেখানে বিপন্ন সেখানে অন্যের অস্তিত্বকে রক্ষা করার কথা বলা আর "আপনি শুতে ঠাঁই পায় না, শংকরাকে ডাকে" প্রবাদ একই! এই অবস্থায় আমার গুরুভাইয়ের যন্ত্রাংশ সাপ্লাইয়ের কাজ এখন বন্ধ! ২৫ জন দোকানদারের মধ্যে এখন ২ জন দোকানদার টিকে আছে আর টিকে আছে নুন আনতে পান্তা ফুরোনো অবস্থায়! সেই অবস্থায় যন্ত্রাংশ সাপ্লাই দিলে পেমেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হয় ২/৩ মাস! তাও আবার অর্ডার পেলে তবে পয়সা আনতে যায় নতুবা ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি করতে হবে! ১০০টাকা খরচা ক'রে ১০টাকা আনতে যাবার মত!! এই অবস্থা যেখানে সেখানে মনে পড়ে যায় আবার বারবার সেই প্রবাদ! কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ! আমার গুরুভাইয়ের এখন সর্বনাশের পর্ব চলছে! এরকম উন্নয়ন কি আমরা চেয়েছিলাম!? এরকম সমাজ ব্যবস্থা কি আমরা চাই!? এরকম 'সমাজ কো বদল ডালো'-র আন্দোলন আমরা চেয়েছিলাম নাকি!? এ কি ধরণের গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা!? এ কি রকম সরকার বদলের নির্বাচন!? এক এক সরকার আসবে আর নতুন নতুন উন্নয়নের সমীকরণ আসবে ধ্বংসের আড়ালে!? কোথায় যাবে আম আদমী!? অবশ্য আম আদমির সংজ্ঞা এখন বদলে গেছে রাজনীতিবিদদের কাছে! আম আদমিকে তারা আর গরীব গুর্ব ভাবে না! তাদের ধারণা সবাই দু'মুঠো ভালো মন্দ খেয়েই বেঁচে থাকে! তাই হে আমার গুরুভাই! তুমি তো আম আদমি! তোমার কথা ভাবার সময় সরকার আর তার পরিচালক ও রাজনীতিবিদদের নেই! তাদের মতে তোমার ভরসা এখন শুধুই তুমি!
অনেকক্ষন দুঃখের কথা বলার পর গুরুভাই আমায় বললো, আচ্ছা দাদা, কি করা যায় বলুন তো? আর যে পারি না। আমি বললাম, আচ্ছা, রিকশার ব্যবসা নাহয় টোটোর জন্য মার খেয়েছে সাইকেল তো বাজারে চলছে রমরমিয়ে! তাহ'লে সাইকেল পার্টসের সাপ্লাই তো করতেই পারেন! তা কেন করছেন না!? গুরুভাই ম্লান হেসে বললো, দাদা পড়েছো মোগলের হাতে খানা খেতে হবে একসাথে! আমার/আমাদের অবস্থা তাই!
কি অবস্থা!? প্রশ্ন করলাম আমি।
ক্রমশ:
( ১০ই মে' ২০১৯ )
No comments:
Post a Comment