Powered By Blogger

Friday, May 12, 2023

প্রবন্ধঃ সমাজ কো বদল ডালো!! (১)

আজ এক চরম সত্যের মুখোমুখি হ'লাম! হ'লাম মুখোমুখি নির্ম্মম কষ্টের! আজ এক গুরুভাই এসেছিল আমার বাড়ি। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আসেই। তাদের সঙ্গে হয় নানা আলোচনা। সেই আলোচনায় থাকে ধর্ম, রাজনীতি, খেলা, সিনেমা, সাহিত্য ও দেশের ও বিশ্বের নানা বর্তমান পরিস্থিতি ও ঘটনা। সেই আলোচনা শেষে উপসংহার শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন দর্শনে এসে নোঙ্গর ফেলে।

যাই হ'ক গুরুভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিলো বাইরের প্রচন্ড দাবদাহ নিয়ে। আগুনের হলকা যেন বইয়ে চলেছে বাইরে। এই অবস্থায় কোথাও আর যেতে ইচ্ছে করেনি তার। তাছাড়া এখন আর বেরিয়েও লাভ নেই। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসতে হয়! আর বয়সও ৫০ হ'য়ে গেছে, আর আগের মত পরিশ্রম করতেও পারে না। সারাদিন সাইকেল নিয়ে ছুটে বেড়িয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত হ'য়ে যখন বাড়ি ফেরে তখন মনে পড়ে কয়েক বছর আগের কথা। সেদিনের অমানুষিক পরিশ্রমের কথা মনে পড়লে আজ অবাক হ'য়ে যায় গুরুভাই! গুরুভাই সামান্য অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করে। সাইকেলের দোকানে দোকানে সাইকেল, রিক্সার অল্পবিস্তর পার্টস সাপ্লাই দেয়। দেয় বললে এখন ভুল হবে, বরং বলা উচিত দিত। কেন এমন কথা বললাম? তাহ'লে কি এখন অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজ করে না?

তাহ'লে একটু বিশদে আলোচনা করা যেতে পারে। গুরুভাইকে জিজ্ঞেস করায় কথায় কথায় সে যা বললো তা নিম্নরূপ।

একটা সময় ছিল যখন সকাল বেলা বেড়িয়ে পড়তো সকালের টিফিন খেয়ে তারপর সারাদিন সাইকেলে উত্তরপাড়া, বালি, বেলুড়, লিলুয়া আবার উল্টোদিকে হিন্দমোটর, কোন্নগর, রিষড়া, শ্রীরামপুর ইত্যাদি কোথায় না কোথায় চলে যেত অর্ডার নেওয়ার জন্যে! কখনো কখনো আরো দূরে ট্রেনে ক'রে চলে যেত সিউড়ির মতো বিভিন্ন স্থানে অর্ডারের জন্যে। তারপর সেই অর্ডার নিয়ে চলে যেত মার্কেটে অর্ডার মত মাল আনতে। দু'হাতে ব্যাগ ভর্তি ক'রে, কাঁধে ক'রে নিয়ে আসতো সেই অর্ডার মাফিক সাইকেল, রিকশার বিভিন্ন ছোটবড় পার্টস। সে একটা দিন গেছে। অমানুষিক পরিশ্রম করেছে হাসিমুখে আনন্দ ভরা হৃদয় নিয়ে! তখন দোকানদাররা ভালোবেসে গুরুভাইকে বলতো, আপনি দু'হাতে ব্যাগে ক'রে যতটা পারবেন মাল দিয়ে যান! সেদিনের কথা বলতে বলতে আনন্দে চোখে জল এসে গেল গুরুভাইয়ের! বলতে লাগলো, "বুঝলেন দাদা, পুজোর সময় সপ্তমীর দিন পর্যন্ত কাজ করেছি! তারপর পুজো শেষ হ'তেই আবার বেরিয়ে পড়েছি বাইরে, নেবে পড়েছি রাস্তায় সাইকেল নিয়ে। দৌড়ে বেড়িয়েছি এ মাথা থেকে ও মাথা! রোদ, জল, ঝড়, বৃষ্টি কোনোকিছুই গায়ে লাগতো না, পরিশ্রমকে পরিশ্রম ব'লে মনে হতো না। শুধু মনে হ'তো একটু কষ্ট ক'রে সাইকেলে কিংবা ঘাড়ে কাঁধে ক'রে দোকানে মালটা পৌঁছে দিতে পারলেই হাতে সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রমের ফসল! ২৫টা দোকানে প্রতিনিয়ত মাল সাপ্লাই দিতাম দাদা। টাকা মার যাবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। এত বিশ্বাস ছিল! আজ না হয় কাল পেমেন্ট ছিল নিশ্চিত! আর তার পরেই আবার অর্ডার! অমানুষিক দিনরাত পরিশ্রম ক'রে দু'পয়সা রোজগার করতাম দাদা! কষ্ট হ'তো না যখন দেখতাম আমার এই পরিশ্রমে ঘরে আনন্দ ভরপুর! চিন্তা ছিল না খাওয়া পড়ার! কিন্তু এখন? কি যে হ'য়ে গেল দাদা! সেই "রামও নেই, সেই রাজ্যও নেই"-এর মত সেই সোনালী দিনগুলিও নেই আর সেই পরিশ্রম ক'রে রোজগারও নেই! দু'নম্বরী ক'রে, লোকের মাথায় টাক মেরে, বাঁ হাতি রোজগার ক'রে, দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে কামিয়ে, মানুষকে ঠকিয়ে, দাদাগিরি আর মস্তানী ক'রে, চিটিংবাজি ক'রে, নোংরা রাজনীতি ক'রে, নেতাগিরি ক'রে, সারদা-নারদা ক'রে, চিট ফান্ড ক'রে তো কামাইনি দাদা! সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘেমেনেয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অমানুষিক পরিশ্রম ক'রে একটু হাসি-আনন্দ এনে দিতাম ঘরে দাদা আজ আর সেই সুযোগ টুকুও নেই দাদা!!!!! পরিশ্রম করবো তারও সুযোগ নেই। যে কাজ ক'রে এসেছি এত বছর সেই কাজ ছেড়ে নতুন ক'রে আর কি কাজ করবো এই বয়সে দাদা! এই বয়সে নতুন ক'রে কিছু করা আর সম্ভব নয়! আর সম্ভব হ'লেও কে দেখাবে নতুন কাজ! কেউ নেই!"

আমি বললাম, কেন এমন হ'লো!? গুরুভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে যা বললো তা শুনে ভাবলাম, এ তো সেই প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন! "কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ!" কেন এমন হয়!? কেন কোনও নতুন পরিকল্পনা নেওয়ার সময় দূরদৃষ্টি দিয়ে চতুরতার সঙ্গে চার আল দেখে সবার সুবিধা-অসুবিধা দেখে নেয় না!? কেন যারা সমাজকে নেতৃত্ব দেবে, সমাজ কো বদল ডালো ব'লে মসিহা হ'য়ে ডাক দেবে তারা কেন আগাপাসতালা ভেবে দেখবে না!?

একটু সময় থেমে গুরুভাই আমার 'কেন এমন হ'লো' প্রশ্নের উত্তরে বলল,
ক্রমশঃ।
( লেখা ১০ই মে' ২০১৯)

No comments:

Post a Comment