Powered By Blogger

Wednesday, May 10, 2023

খোলা চিঠিঃ কবি অতনু ভট্টাচার্যদাকে।

খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। ২৪-২৫ বছরের ছেলেটার কথায় নিজের যৌবনের সেইদিনগুলি মনে পড়ে গেল। বাংলার বুকে নকশাল আন্দোলনের উদ্দামতা সবে স্তিমিত হয়েছে। আন্দোলনের পাগলামোর ফলে বিপুল যুব শক্তি ও অসাধারণ মেধা শক্তির ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে দিয়ে সবে রাজ্যে বাম জমানার শুরু হয়েছে। বাংলা তথা দেশের বিরাট মানব সম্পদ হারানোর মধ্যে দিয়ে সাম্যবাদের হাত ধ'রে শুরু হ'লো বাংলায় নোতুন পথ চলা। নোতুন সূর্যের আলোয় আলোকিত সকাল। সালটা ৭৭সাল। বাম আন্দোলনের পারস্পরিক মতভেদের দ্বন্ধে বুঝতে চেষ্টা করেছি মৌলিক তফাৎ। সেই সময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত প্রচুর বন্ধু বান্ধব, প্রিয়জন ও তাত্ত্বিক নেতাদের মুখোমুখি হয়েছি। বাম আন্দোলনের সময় রাজ্যজুড়ে মিছিল, মিটিং, পথসভা, পথনাটক করেছি। যুক্ত থেকেছি গণনাট্য আন্দোলনের সঙ্গে। যুক্ত থেকেছি লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে। নোতুন নোতুন কবি, লেখক প্রতিভাদের দেখেছি কাছ থেকে। তখন নাট্য আন্দোলনের সেরা যুগ। কংগ্রেসি আমল তখন। তখন ৭৭ এর আগে এবং পরে রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন জায়গায় নাটকের কম্পিটিশান হ'তো। সে কি উন্মাদনা! কত ঘটনা মনে পড়ে। কত ছবি ওঠে ভেসে মনের ক্যানভাসে। লিখতে গেলে চিঠি দীর্ঘ হ'য়ে যাবে। তবুও লোভ সামলাতে পারলাম না ব'লে লিখছি।

সেইসময় জর্জ ফার্নান্ডেজ এর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক রেল ধর্মঘটের যুগ। সারা দেশ জুড়ে রেল পরিষেবা বন্ধ। সালটা সম্ভবত ১৯৭৪। পথেঘাটে, মাঠেময়দানে চলছে মিটিং, মিছিল, পথসভা, পথনাটিকা ইত্যাদি প্রায় প্রতিদিনই বাম আন্দোলনের অংশ হিসেবে। পথনাটকের নাম 'রেলকি ভেলকি'। নাট্যকার অনামী অদামী অখ্যাত অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন অরুণ চক্রবর্তী। একাধারে নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা ছিলেন অরুণ চক্রবর্তী। একের পর এক কালজয়ী নাটক লিখেছিলেন অরুণ চক্রবর্তী। আজ জানি না সেই নাটকগুলি আছে কিনা। সংগ্রহ ক'রে রাখার অভ্যাস ছিল না তাঁর। একটু বোহেমিয়ান টাইপের ছিলেন তিনি। কি অসাধারণ প্রতিভা ছিল তাঁর! জানি না তাঁর নাম আজ কেউ জানে কিনা বামপন্থী মহলে বা নাট্যজগতে। অসামান্য শক্তিমান নাট্যকার, পরিচালক ও অভিনেতা ছিলেন তিনি। নাটকে তাঁর সেন্স অফ হিউমার ছিল সাংঘাতিক! একবার নাটক করতে গেছি। কল শো ছিল। নাটকের নাম 'হচ্ছেটা কি?' ৭০দশকের নাট্যকার অরুণ চক্রবর্তীর 'হচ্ছেটা কি?' নাটকের কথা আজ আর কারু মনে নেই। কিন্তু সেই থেকে বিভিন্ন জায়গায় আজও দেখতে পাই 'হচ্ছেটা কী?' নামে অন্য কিছুর বিজ্ঞাপন! অথচ কালজয়ী 'হচ্ছেটা কি?' নাটক ও নাটকের স্রষ্টা আজ বিলুপ্ত।

যাই হ'ক গেছি নাটক করতে। জায়গার নাম আজ আর মনে নেই। গিয়ে শুনলাম নাটক করা যাবে না। কারণ 'হচ্ছেটা কি' নাটকের ওপর ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। অথচ প্রচুর লোক ও প্রচুর পুলিশ জমায়েত হয়েছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দর্শকেরা। পুলিশের সঙ্গে শুরু হ'লো কথাবার্তা। পুলিশের কর্মকর্তা 'হচ্ছেটা কী'? নাটক করা যাবে না বললেন। তবে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে প্রচুর লোকজনের উপস্থিতি দেখে তাঁরা বললেন, 'হচ্ছেটা কী?' করা যাবে না , অন্য কোনও নাটক করা যেতে পারে। আমরাও রাজী হ'য়ে গেলাম। তখন একসঙ্গে দু'তিনটে নাটক তোলা থাকতো। নাট্যকার অরুণদা বললেন, ঠিক আছে আমরা অন্য নাটক করবো। নাটকের নামঃ ছড়রা। সেই একাংক নাটক 'ছড়্ররা'র বিশেষত্ব ছিল সব চরিত্রের সংলাপ ছিল ছড়ার আকারে। পরবর্তীতে আমরা সত্যজিৎ রায়ের 'হীরক রাজার দেশে' সিনেমাতে (১৯৮০ সাল) এইরকম ছড়ার আকারে তৈরি সংলাপে অভিনেতাদের অভিনয় করতে দেখেছি। সেই সময় 'ছড়রা' নাটক যখন অনুষ্ঠিত হ'লো মাঠ ভেঙ্গে পড়েছিল সেই নাটকের নোতুন ধরণের ছড়ার আকারে সংলাপের মাধ্যমে সূক্ষ্ম রসবোধে পরিপূর্ণ হাসানো অভিনয় দেখে! প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়েছিল সেই নাটক! অসাধারণ চাহিদা ছিল সেই নাটকের। যদিও বলতে এতটুকু দ্বিধা নেই প্রতিটি নাটকই ছিল অভূতপূর্ব! একসে বড়কর এক! কেউ কারও থেকে কম না। এ বলে আমায় দ্যাখ, ও বলে আমায় দ্যাখ! শুধু 'ছড়রা' নাটকের ক্ষেত্রে যেটা অভিনব ছিল তা হ'লো ছড়ার আকারে গোটা নাটকে নোতুন আঙ্গিকে অভূতপূর্ব উপস্থাপন ও অভিনয়! সবচেয়ে যেটা মজার ছিল তা হ'লো। পুলিশের ভূমিকা। উপস্থিত পুলিশ বাহিনী হাসতে হাসতে ভুলে গেছিল তাঁদের ভূমিকা। একাকার হ'য়ে গিয়েছিল তাঁরা জনতার সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করতে করতে। ভুলে গিয়েছিল তখন সেই মুহূর্তের জন্য তাঁরা পুলিশ! আজও ভাবলে অবাক হ'য়ে যায় এমনও সম্ভব!? কি ছিল সেই যাদুকরী ক্ষমতা নাটকের মধ্যে যা পক্ষ-বিপক্ষ সবাইকে এক ক'রে দিতে পারে!? পরে নাটক শেষে যখন তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে গিয়েছিলাম তখন তাঁরা বলেছিলেন, 'ছড়রা' যদি এমন বাঁধভাঙ্গা সিরিয়াস হাসির নাটক হয় তাহ'লে 'হচ্ছেটা কী?' নাটক না জানি কতটা সিরিয়াস হাস্য রসাত্মক! আরও কত এমন নাটক ছিল নাট্যকার অরুণ চক্রবর্তীর যা এখন স্মৃতি থেকে বের করতে কষ্ট হয়। আমাদের নাটকের দলের নাম ছিল 'পদক্ষেপ'।

আজ ভাবলে অবাক হ'য়ে যাই! কোথায় সেই মাঠে ঘাটে অজস্র নাটকের মেলা! কত নাটকের গ্রুপ যে তখন ছিল! কত নাটক যে রচনা হয়েছে সে সময় তা লিখে বা ব;লে বোঝানো যাবে না! সেই সময় ছিল নাটকের স্বর্ণযুগ! বড় বড় নাটকের হলে নাটক হবার কথা আমি বলছি না। আমি বলতে চাইছি গ্রামে গ্রামে শহরে-শহরতলিতে তখন কত নাটক প্রতিযোগিতার আয়োজন হ'তো তা কল্পনা করা যায় না! প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কম্পিটিশান কিম্বা কল শো ছিল। আর তা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। কত অসাধারণ প্রতিভাবান নাট্যকার, পরিচালক, অভিনেতাদের সঙ্গে তখন পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল। কিন্তু তাঁরা সব ছিলেন অনামি অদামী। বানের জলের মতো সময়ের স্রোতে এসেছিল ভেসে আবার ভেসে গেছে সময়ের স্রোতে ব্যর্থতার হাত ধ'রে। কেউ কেউ হয়তো বা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে নিজ যোগ্যতা বলে। তা আমি জানি না। কত অসাধারণ অসাধারণ মেধাকে দেখেছি নষ্ট হ'য়ে যেতে। আবার অনেককে দেখেছি সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে আদর্শকে শিকেয় তুলে রেখে প্রতিভাকে বলাৎকার ক'রে প্রতিষ্ঠিত হ'তে। তথাকথিত প্রতিষ্ঠার সুরা পান ক'রে বুঁদ হ'য়ে থেকেছে সত্যের থেকে মুখ ফিরিয়ে। সময় যত এগিয়েছে তত দেখেছি সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীদের গিরগিটির মতো দ্রুত বদলে যাওয়া রূপ! এত দ্রুততার সঙ্গে বদলে যেতে দেখেছি যে গিরগিটিও লজ্জা পেয়ে যাবে বুদ্ধিজীবীদের রূপ বদলানো দেখে। শুধু বোকার হদ্দ হ'য়ে বেঁচে থেকে দেখে গেছি সব। আর তাই আপনার লেখায় বর্ণিত আজকের যুবকের কথায় একটু নড়ে গেল মাথাটা। ভেসে উঠলো অনেক কিছু। তাঁর থেকে সামান্য তুলে ধরলাম এখানে।

যাই হ'ক লম্বা হ'য়ে যাচ্ছে লেখাটা। কিছু মনে করবেন না। ফেলে আসা জীবনের অপ্রিয় সত্যের কথা মনে পড়ে যায় প্রায়শই। আর আপনার লেখায় ২৪-২৫ বছরের যুবকের কথায় নিজের যৌবনের দিনগুলি একঝলক উঁকি মেরে গেল মনের আঙিনায়। তাই লিখলাম। একটা ছোট্ট সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তুলে এই লেখা শেষ করবো।

সাম্প্রতিক কালের এক নাট্যকারের কথা বলি। নাম তাঁর ব্রাত্য বসু। বর্তমানে সরকারের কিছু একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আছেন এটুকু জানি। তিনি নাট্যকার ও অভিনেতা। যদিও তাঁর একটা নাটকও দেখা হয়নি। পথে ঘাটে মাঠে ময়দানে ৭০দশকের গণনাট্য আন্দোলনের সময় কল শো ও নাট্য প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করা লোক পরবর্তীতে মানসিক ক্লান্তির কারণে আর নাটক দেখার ইচ্ছা ছিল না। তবে বাম জমানায় শেষের দিকে ব্রাত্য বসুর নাটকের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেবে এসেছিল জেনে খারাপ লেগেছিল। তখন নিয়মিত টিভিতে সান্ধ্য আলোচনায় অংশ নিতেন নাট্যকার ও অভিনেতা ব্রাত্য বসু। সেইসময় টিভিতে তাঁর প্রত্যেকটি ইন্টারভিউ শুনতাম। ভীষণ ভালো লাগতো। ভালোবেসে ফেলেছিলাম তাঁকে। নিজের অজান্তে তাঁর কথায় মুগ্ধ হ'য়ে তাঁর ফ্যান হ''য়ে গিয়েছিলাম। যেমন হয়েছিলাম কুণাল ঘোষের তীব্র ধারালো যুক্তি তত্ত্ব দিয়ে সাজানো পত্রিকার প্রতিবেদনগুলি পড়ে। দু'জনের কথাগুলি সংগ্রহ ক'রে রাখতাম। কুণাল ঘোষের পেপার কাটিং রেখে দিতাম। রাজনৈতিক ও নাট্য জগতের অপরিচিত অখ্যাত অনামী প্রবীণ কর্মীদের নিঃস্বার্থ শ্রমদান সম্পর্কে ব্রাত্য বসুর বলা কথাগুলি আমি টিভির সামনে বসে শুনতে শুনতে ডাইরিতে লিখে রাখতাম। অনেকদিন যত্ন ক'রে রেখেছিলাম। তারপর একদিন সব কেমন ক'রে কেন জানি হারিয়ে গেল! সেইদিনের সংগ্রহ করা পেপার কাটিং বা লিখে রাখা ইন্টারভিউর কথাগুলি আজ আর আমার কাছে নেই।

সেই যে কবে পড়েছিলাম এস ওয়াজেদ আলির চিরন্তন সত্য কথা, "সেই Tradition সমানে চলেছে" আজও তা প্রমাণিত সত্য। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা সব রাজনীতির ঘোলা জলে কেমন জানি মিলেমিশে ঘোলাটে হ'য়ে গেল। শুধু রইলো বেঁচে ছানাকাটা বেদনাদায়ক স্মৃতিগুলি।
আজ মনে হয় সব সব সব ইউটোপিয়া।

আমার বুকভরা ভালোবাসা নেবেন।
ইতি,
প্রবি।
(লেখা ২৬শে এপ্রিল'২০২৩)

No comments:

Post a Comment