এর আগের সমাজ কো বদল ডালো(২)-এ লিখেছিলাম 'কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ'! টোটো চালকদের পৌষ মাস হ'লেও রিক্সা চালক, সাইকেল, রিক্সা রিপেয়ারিং-এর দোকানগুলোর অবস্থা সর্বনাশ। সেখানে লিখেছিলাম সর্বনাশের অন্যতম প্রধান কারণ টোটো অর্থাৎ টোটো ছাড়াও আরও কারণ আছে। কি সেই কারণ? রিক্সার ব্যবসার বারোটা বাজার পেছনে যেমন টোটো টোটকা কাজ করেছে ঠিক তেমনি সাইকেল দোকানেরও সাইকেল বিক্রির ব্যবসায় নেবে আসা অন্ধকার, ঘন অন্ধকারের পেছনে আছে সরকারী উন্নয়নের পরিকল্পনা! গুরুভাইকে জিজ্ঞেস করলাম কেন আপনি অন্ধকার বলছেন? আপনার কোথায় অসুবিধা? গুরুভাই বললেন, সাইকেল বিক্রি একেবারে কমে গেছে। কেউ আর সাইকেল কিনছে না। তাই সাইকেল পার্টসের প্রয়োজনও কমে গেছে। অর্ডার আর দেয় না আগের মত। আমি বললাম, কেন? কেন কিনছে না?
এই কথায় যা জানা গেল তা'তে বিস্মিত হ'য়ে গেলাম এই ভেবে যে সরকারী সিদ্ধান্ত যদি এমন হয় তাহ'লে ছোট মাছেদের পক্ষে বড় মাছেদের মাঝে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা শুধু কঠিন নয়, একেবারেই অসম্ভব! বড় বড় মাছেদের পেটে যেতেই হবে ছোট মাছেদের যদি তাদের সুরক্ষিত পুকুরে স্থানান্তরিত করা না হয়! বড় মাছ আর ছোট মাছেদের একসঙ্গে একই পুকুরে রাখলে অস্তিত্বের সংকট অনিবার্য! দু'জনকেই রাখতে হবে দু'জনের থাকার মত ক'রে উপযুক্ত জায়গায়!
সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সমস্ত স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনা পয়সায় সাইকেল দেবে। সেই সাইকেল সরাসরি অর্ডার দেওয়া হয়েছিল সাইকেল কোম্পানিকে আর কোম্পানি থেকে সাইকেল স্কুলের মাধ্যমে তুলে দেওয়া হয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের হাতে। ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েরা সাইকেল কেনার জন্য যে দোকানে যেত তার আর দরকার হ'লো না। হাজার হাজার সাইকেল বিক্রি হ'লো কিন্তু তার প্রভাব পড়লো না দোকানদারদের উপর। দোকানদার বসে রইল দোকান খুলে আর উন্নয়নের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে ব্যবসার লেনদেন হ'লো সরাসরি সাইকেল নির্মাতাদের সঙ্গে! যদি এলাকায় এলাকায় দোকানের মাধ্যমে সাইকেল কেনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হ'তো তাহ'লে আজ দোকানদারদের অবস্থা এত করুণ অবস্থায় নেবে আসতো না, ওষ্ঠাগত হ'তো না প্রাণ! আর দোকানদার অক্সিজেন পেলে আমার গুরুভাইয়ের জীবনে এবং গুরুভাইয়ের মত অনেক ছোট ছোট সাপ্লাইয়ারের জীবনে নেবে আসতো না অন্ধকার, ভরে যেত না কার্বনডাই-অক্সাইডে জীবনের আকাশ! সাইকেল পার্টসের সাপ্লাই অন্ততঃ জীবনকে সামান্য হ'লেও রসসিক্ত ক'রে রাখতো গুরুভাইয়ের!
এ কেমন নীতি গ্রহণ!? কেমন উন্নয়নের পরিকল্পনা!? এ কেমন গোড়া কেটে আগায় জল দেবার মত বেকুবি ভালোবাসা!? উন্নয়নের সুফল সরাসরি পৌঁছোয় না নীচের তলায়! শুধুই চকচকে ঝকঝকে বকবক! আরও গভীরে, আরও বিস্তারে গিয়ে ভাবার প্রয়োজন কবে হবে!? সার্বিক উন্নয়নের স্পর্শ যদি তৃণমূল স্তরে না পৌঁছোয় তেমন উন্নয়নে আমার কি লাভ!? চকচক করলেই সোনা হয় না এ তো সর্বজন বিদিত! নিচের তলার কান্নাকে কি এইভাবে উপরি কথার চাপান আর সস্তা প্রগতি দিয়ে চিরদিন ভুলিয়ে রাখা বা দাবিয়ে রাখা যায় নাকি রাখা গেছে কোনোদিন!?
অনেকক্ষন ধ'রে একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছিল গুরুভাই! তারপর ঠান্ডা শরবতে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির আওয়াজ দিয়ে বললো, যাক গিয়ে কি আর করা যাবে দাদা! মনে রাখতে হবে, পড়েছো মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে একসাথে! বললাম, সে তো না হয় বুঝলাম কিন্তু এখন কি করছেন? কি আর করবো দাদা! এই বয়সে নতুন কিছু করার মত মনের আর শরীরের জোর নেই, সুযোগও নেই, বললো গুরুভাই। আমি বললাম, যাই হ'ক একটা কিছু তো করতে হবে, খেয়ে পড়ে বাঁচতে তো হবে! এই শুনে গুরুভাই ঠাকুরের ফটোর দিকে তাকিয়ে বললো, যা ইচ্ছা দয়ালের! দয়াল ছাড়া, দয়ালের দয়া ছাড়া বাঁচার আর কোন উপায় নেই আমার, আমাদের মত মানুষদের দাদা! এ মাসে এখনও পর্যন্ত কোনও অর্ডার হাতে আসেনি! তাই এসব নিয়ে আর ভাবি না। আমাদের মত আম আদমিকে ভাবার কোনও অধিকার দেয়নি কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও সরকার।
ক্রমশ: ( লেখা ১১ই মে' ২০১৯ )
No comments:
Post a Comment