আমি কি শয়তান!? কিম্বা শয়তানের ছায়া, শয়তানের প্রতিনিধি!?
কথাটা মাথার মধ্যে হঠাৎ হুস ক'রে ভেসে উঠে ঘুরপাক খেতে লাগলো। শুয়েছিলাম চুপ ক'রে। অনেক কথা ভেসে আসছিল মনের আঙিনায়। করোনার ভয়াবহতা চারপাশের পরিবেশকে যেভাবে গ্রাস করেছে, মনের উপর যে ভয়ংকর প্রভাব পড়েছে কোনও ভালো কথা, কোনও নীতিকথা, ঈশ্বরের অভয় বাণী কোনও কিছুতেই আর কাজ হবার নয়। কেন এমন হয়? কেন এমন হ'লো? কে দায়ী? আমি কি দায়ী? আমি কি দায়ী নই? মনের মাঝে এমন অনেক প্রশ্ন একসঙ্গে জড়ো হ'য়ে হইমলে পড়লো। উঠে বসলাম বিছানার ওপর। ভাবলাম, চারপাশে যা হচ্ছে সত্যিই কি আমিও তার জন্যে দায়ী ন'ই।
এই যে ভোট হ'লো। আমিও তো ভোট দিয়েছি। এইসময় ভোট হওয়াটা কি ঠিক ছিল? এইসময় পাঁচ রাজ্যে কি রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে কিছুদিন রাজ্য চালানো যেত না? তারপর প্রায় নিয়ন্ত্রণে আসা করোনাকে জব্দ ক'রে আবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতে নির্বাচন করা যেত না? যেত; হয়তো যেত না। সেটা নির্ভর করে আমাদের দেশের অভিভাবকদের দেশের ও দশের স্বার্থে দূরদৃষ্টির ওপর। আমি শুধু দেশের কর্ণধারদের গৃহীত কর্মকান্ডের অংশীদার।
আচ্ছা এই যে চারদিকে করোনার ভয়াবহতার মাঝে করোনার মানুষের জীবন নিয়ে, ওষুধ নিয়ে, অক্সিজেন নিয়ে যে কালোবাজারি চলছে, নয়ছয় চলছে দেশের এই কঠিন ভয়াবহ সময়ে তখন এদের বিরুদ্ধে কোনও কঠিন নির্ম্মম ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হয় না যা দেখে শিউড়ে উঠবে মানুষের জীবন নিয়ে, অসহায়ত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অর্থলোলুপের দল!? সাধারণ মানুষ, গরীব মানুষ, অসহায় মানুষ, দু'মুঠো দিন আনে দিন খাওয়া মানুষ, নুন আনতে পান্তা ফুরোনো মানুষ কার কাছে যাবে? কে বাঁচাবে তাদের? এই শ্রেণীর হ'য়ে এই শ্রেণীরই মধ্যে থেকে উঠে আসা প্রতিনিধি যারা তারাই যখন এদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, বেইমানী, নমকহারামী করে তখন কাদের কাছে যাবে মানুষ? যখন দেশের লেখাপড়াজানা ইয়ং জেনারেশন তাদের শিক্ষাকে, তাদের জ্ঞানকে এদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কাজে লাগিয়ে এদের অজ্ঞানতাকে মই বানিয়ে উপরে উঠে আসে অর্থের প্রাসাদ বানায় তখন কাকে বিশ্বাস করবে মানুষ? প্রতিটি দলের প্রতিটি জনপ্রতিনিধি কি অস্বীকার করতে পারে এই অভিযোগ? ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। তারা চিরকালীন ভীষ্ম। মহাভারতের ভীষ্মরা আমাদের কাছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ! পৌরসভা থেকে শুরু ক'রে বিধানসভা, লোকসভা প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনপ্রতিনিধিদের প্রতিনিধি হবার ও প্রতিনিধি হ'য়ে ক্ষমতা দখল করার প্রতিযোগিতা, মারামারি শুধু কৌন বনেগা ক্রোড়পতি হবার তীব্র বাসনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অসহায় সাধারণ গরীব দূর্বল মানুষ যে তিমিরে সেই তিমিরে।
তাহ'লে এদের জন্য, আমাদের জন্য কি কেউ নেই? আগে যদি নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যেত আর এখন যদি পান্তা ভাতে নুন ছিটিয়ে দেওয়া হয় তাহ'লে সেটাই কি জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা কৃত উন্নতি? একবারও কি আমরা ভেবে দেখবো না আগে নুন আনতে পান্তাভাত কেন ফুরিয়ে যেত? আর কেনই বা এখন পান্তাভাতে নুন ছেটানো? অর্থাৎ নুন আনতে পান্তাভাত ফুরিয়ে যাবার অর্থ হ'লো জল মেশানো ভাত পরিমাণে এতটাই অল্প যে খাওয়ার স্থানের এক হাত দূর থেকে নুন আনতে না আনতেই জল মেশানো ভাত শেষ হ'য়ে যেত! নুন আনার সেই মুহূর্তের অবসরও পেত না অভুক্ত মানুষ! আর এখন উন্নতিটা কি হয়েছে? উন্নতি হয়েছে পান্তাভাতের পরিমাণ যেমন ছিল তেমনই আছে শুধু সেই হ্যান্ড টু মাউথ পান্তাভাতে সামান্য নুন ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে! আর তাতেই উন্নয়ন উন্নয়ন ব'লে চিল চিৎকার ক'রে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিচ্ছে সেই হ্যান্ড টু মাউথ পান্তাভাতের দল! যেমন শহরে ঠিক ঢোকার মুখে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিরাট তোরণ নির্মান আর আলোকসজ্জায় সাজানো অঞ্চল দেখে আমরা ভেবে নিলাম শহরের এই প্রবেশ দ্বার থেকে একেবারে আনাচে কানাচে শেষ পর্যন্ত গোটা শহরটাই বুঝি এমন ঐ দু'হাত অঞ্চলের মতো ঝাঁ চকচকে! একেই কি উন্নয়ন বলে? এতেই আমজনতার তৃপ্তি!!!!!
তাহ'লে আমাদের জন্য কেউ নেই? অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, নেই বাসস্থান!? রোগ, অসুখ বিসুখ হ'লে নেই হাসপাতাল, নেই চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসা কেন্দ্র থাকলেও নেই সুচিকিৎসা ও চিকিৎসাজনিত সুব্যবস্থা, আর সুচিকিৎসা ও চিকিৎসাজনিত সুব্যবস্থা থাকলেও তা আমার জন্য নয়। তাহ'লে আমার জন্য কে আছে?
শুনেছি যার কেউ নেই তার নাকি ঈশ্বর আছে। সেই ঈশ্বর যখন আমার জন্য যখন মাভৈ! ব'লে নেবে এলেন মানুষের রূপ ধ'রে তখন ঈশ্বর পুজারীরা এবং ঈশ্বর বিরোধীরা ঈশ্বরকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে রেখে দিলেন। দূরে সরিয়ে রেখে ঈশ্বরকে ব্যবসার উপকরণ বানিয়ে কুক্ষিগত ক'রে রাখলেন ঈশ্বর বিশ্বাসী ধর্ম ব্যবসায়ীরা। ধূপ, ধুনো, প্রদীপ, সিন্দুর, চন্দন, ফুল বেলপাতা, তাবিজ, মাদুলি, লোহালক্কড়, শেকড়বাকড়, লালনীলহলুদকালো নানা রঙের সুতো, নানা দেবদেবীর মূর্তি, ইটপাথর গাছপালা, বাবাজী মাতাজী ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের ডুবিয়ে রেখে মোহগ্রস্থ ক'রে রেখে নানা কঠিন কঠিন রঙবেরঙের তত্ত্ব কথার ফুলঝুড়িতে ভুলিয়ে রেখে মৌরসি পাট্টা জমিয়ে বসলেন চর্ব্য চোষ্য লেহ্য যোগে ঈশ্বর পুজারী ধর্ম্ম ব্যবসায়ীরা। এইসমস্ত ধর্ম্ম ব্যবসায়ীরা নিজেরাই ঈশ্বরের প্রতিনিধি সেজে স্বয়ং ঈশ্বরের আসনে বসে পড়েছে আর ঈশ্বর বিশ্বাসী ধর্মীয় মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ক'রে চলেছেন। ঈশ্বর স্বয়ং মানুষের রূপে মানুষের মাঝে মানুষ মায়ের কোলে আসার পরেও ঈশ্বরের পূজারীরা তাঁকে মানুষ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে পৃথক পৃথক ধর্ম্মের নামে বহু দল সৃষ্টি ক'রে মানুষকে বিভ্রান্ত ক'রে রেখেছেন। ক'রে রেখেছেন পরস্পরকে পরস্পরের শত্রু। কিছুতেই ঈশ্বর যে বারবার এসেছেন আমাদের মত অসহায় মানুষদের জন্য সেই কথা কিছুতেই যাতে বিশ্বাস না করে ধর্ম্মপ্রাণ ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষ তার চেষ্টা ক'রে চলেছেন তারা। কারণ তারা জানে সাধারণ মানুষ অসহায় মানুষ দূর্ব্বল ভীরু অজ্ঞ। আর সেটাই তাদের মূলধন।
আর ঈশ্বর বিরোধীরা? গরীব অসহায় সাধারণ মানুষের তথাকথিত কল্যাণকামী ঈশ্বর বিরোধীরা? তারা কি করলেন বা ক'রে চলেছেন গরীব দুখী মানুষের জন্য?
মানবদরদী কল্যানকামী মানুষের বাঁচাবাড়ার পিয়াসী সমাজ কো বদল ডালো তত্ত্বের রূপকার ঈশ্বর বিরোধীরা নানা তত্ত্বকথার জাল বুনে মানুষকে শোষন মুক্তির পথ দেখিয়ে চলেছেন। যে শোষন করেছে বা করছে আর যারা এর বিরুদ্ধে লড়েছে বা ল'ড়ে চলেছে তারা সকলেই রিপু তাড়িত বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধিকারী। রিপুগুলিই তাদের উভয়পক্ষের সকলের অভিভাবক। রিপুগুলি বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তের মধ্যে উভয়পক্ষের সকলকে পিষে চলেছে। আর এই পিষে চলা ব্যক্তিরা একপক্ষ যেমন অসহায় মানুষকে মারার দীক্ষা নিয়েছে ঠিক তেমনি অন্যপক্ষ মানুষকে বাঁচাবার নামে ছদ্মবেশে মেরে চলেছে সাধারণ অসহায় বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা মানুষকে তাদের ভাঙাচোরা জীবনের সুযোগ নিয়ে।
তাই কান্নাবিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত শরীরে-মনে প্রশ্ন জাগে তাহ'লে আমার কেউ নেই এই দুনিয়ায়?
ঠিক সেইসময় অন্তরের অন্তস্থল থেকে কে যেন ব'লে উঠলো-----
সেই যে কবে থেকে মানুষুকে তমসার পার অচ্ছেদ্যবর্ণ মহান পুরুষ ইষ্টপ্রতীকে আবির্ভূত পরমপিতা বারবার যুগে যুগে তার সন্তানদের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার কথা ব'লে চলেছেন, ব'লে চলেছেন আচার্য পরম্পরার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যৎ ভয়ংকর বিপদ থেকে, মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য "জাগার লগন এলো তোরা জাগনা ওরে" ব'লে, ব'লে চলেছেন নিরন্তর চেতনাবাহী স্মৃতি যুক্ত জীবন বৃদ্ধির কথা, সাবধান ক'রে চলেছেন মনুষ্যত্বের ভিত লুপ্ত হ'য়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা কিন্তু কেউই তাঁর অর্থাৎ জীবন্ত ঈশ্বরের কথা শুনছে না! কারোরই শোনার সময় নেই! সবাই দৌড়চ্ছে এক অলীক মায়ার মোহন বাঁশির পিছনে! তাই নিজের ও দশের ক্ষতির জন্য, নিজের ও দশের দুর্দশার জন্য নিজেই দায়ী।
এর থেকে নির্ম্মম যন্ত্রণা আর কি হ'তে পারে!?
অবশেষে মনে হ'লো হ্যাঁ! আমিও শয়তান! আমিও শয়তানের ছায়া!! শয়তানের প্রতিনিধি!!
(লেখা ১২ই মে' ২০২১)
No comments:
Post a Comment