Powered By Blogger

Thursday, December 26, 2024

প্রবন্ধঃ নিজের মুখোমুখি।

যেটা সবাই জানি সেটা নিয়ে আলোচনা ক'রে মানসিক যন্ত্রণা আরও বাড়িয়ে দেওয়ার কোনও মানে হয়? নারীপুরুষ সবাই গল্প করে আনন্দে থাকার জন্য। কিন্তু যখনই এক জায়গায় নারীপুরুষ জড়ো হয়, গল্প শুরু করে তখনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই কলুর বলদের চাক্কি পেষার মতো ঘুরেঘুরে ফিরে চলে আসে সেই এক জায়গায় টাকার আলোচনায়। টাকা থাকলে তুমি অমুক, টাকা থাকলে তুমি তমুক ইত্যাদি বলতে বলতে শুরু হ'য়ে যায়,

টাকা থাকলে তুমি বাবামায়ের যোগ্য ছেলে,
টাকা থাকলে তুমি যোগ্য স্বামী,
টাকা থাকলে যোগ্য পিতা,
টাকা থাকলে যোগ্য ভাই বা দাদা,
টাকা থাকলে সেরা যোগ্য বন্ধু,
টাকা থাকলে যোগ্য প্রতিবেশী,
টাকা থাকলে তুমি দেশের যোগ্য নাগরিক,
টাকা থাকলে যোগ্য নেতা,
টাকা থাকলে তুমি গ্রামের মোড়ল,
টাকা থাকলে তুমি পাড়ার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট,
টাকা থাকলে শ্বশুরবাড়িতে আদরের বড়লোক জামাই,
টাকা থাকলে তুমি গরীবের মসীহা,
টাকা থাকলে তুমি পরিবারের যোগ্য সেরা সদস্য।

এই এক কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ে যায় কিশোর কুমারের বিখ্যাত সেই গানের লাইন,
" না বিবি, না বাচ্চা, না বাপ বড়া, না ভাইয়া
The whole thing is that কে ভাইয়া সবসে বড়া রপাইয়া।"
এই যে দিনরাত এক আলোচনা ঘরেবাইরে উঠতে বসতে শোতে জাগতে টাকা-টাকা আর টাকা! এতে কি লাভ হয়? একটা নেগেটিভ অরবিট সবসময় ঘিরে রাখে ঘরের পরিবেশে, নিজের জীবনে, শরীরে-মনে-আত্মায়।

এই যে সবসময় টাকা সংক্রান্ত বিষাক্ত আলোচনা যা' খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছোটো থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত অন্যের জোর ক'রে চাপিয়ে দেওয়া নিজের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা মিথ্যে এক অপদার্থতাকে মনে পড়িয়ে দেয়। মনে করিয়ে দিয়ে সেই অপদার্থতার ঘা-র অসহ্য যন্ত্রণাকে দ্বিগুণ ফিরিয়ে আ্নে; এ ছাড়া আর কিছুই হয় না। আড্ডার গল্পের মাঝে আনন্দের বদলে হতাশার দীর্ঘশ্বাস পড়ে। মনে হয় আবার, আমি একটা অপদার্থ। ফলে পরিবারে ও সমাজে অর্থাৎ ঘরে-বাইরে পরস্পরের মধ্যে ভালো সম্পর্ক নষ্ট হয়, ভেঙে যায়। কিন্তু কেউই ভেবে দেখে না, দেখার প্রয়োজন বোধ করে না কেন পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কগুলো ভেঙে যাচ্ছে।

আসলে আমরা কেউই অপদার্থ নই, কেউ নই। একেবারে ছোটো থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে মানুষ শুনে এসেছে মা-বাবা, ভাই-বোন, দাদা-দিদি, আত্মীস্বজন, বন্ধুবান্ধব, সহপাঠী, মাস্টারমশাই, অফিসের বস, কলিগ থেকে শুরু ক'রে ঘরে নিজের একেবারে আপনজন বউ ও পরবর্তী সময়ে ছেলেমেয়ে সবার কাছে 'তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না ছাগল, আপনি একটা ওয়ার্থলেস অপদার্থ, তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবার নয়, একেবারে ফালতু' এমন আরও অপমানজনক অনেক কিছু, সেই মানুষ প্রতিনিয়ত ঘরে-বাইরে শুনতে শুনতে নিজের অজান্তে কখন যে মানসিকভাবে সত্যি সত্যিই ছাগল, মূল্যহীন, অপদার্থ, একেবারে ফালতু হ'য়ে গেছে শরীরে-মনে-আত্মায় তা' সে নিজেই জানে না। আর সবচেয়ে বেশী ঘরের প্রিয়জনের কাছে শুনতে শুনতে আত্মবিশ্বাসশূন্য, হতাশা অবসাদে জর্জরতি এক তাল মাংসের একটা জড় পদার্থে পরিণত হয়েছে মানুষটা। দুনিয়ার রোগ এসে বাসা বেঁধেছে সমস্ত শরীর আর মন জুড়ে। ফলে হয়েছে আরও উপেক্ষা আর অবহেলার পাত্র আমৃত্যু।

আর, যাদের টাকা আছে তাদের যাদের যাদের সঙ্গে কম বেশী পরিচয় ছিল ও এখনও আছে দেখেছি তাদের, তারা, যাদের টাকা নেই তাদের থেকে তারা অর্থাৎ টাকাওয়ালারা অন্তরে, কখনো কখনো বাইরে দুঃখী বেশী। তারা অনেকটা রোবোটে পরিণত এক কৃত্রিম মানুষ। কারণ তারা জানে তাদের টাকার জন্যেই ঘরে বাইরে সবাই তাদের খাতির করে, পাত্তা দেয়। নতুবা দেয় না। তারা এ অপমান না পারে গিলতে, না পারে উগলাতে। তাদের রোবোটিক মন বুঝতে পারে তাদের প্রশংসার মাখখন লাগাচ্ছে, তোয়াজ করছে, তেল দিচ্ছে। অথচ কিছুই করার নেই। এ সমস্ত খাতির যত্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে টাকার উগ্র সুমিষ্ট এক গন্ধ। যতক্ষণ এই উগ্র সুমিষ্ট গন্ধের যোগান দিতে পেরেছে ততক্ষণ মাথায় তুলে রেখেছে, যখনই যোগানে ভাঁটা পড়েছে তখনই দেখেছে কৃত্রিম ভালোবাসার, খাতির যত্নের আসল রূপ। বিশেষ ক'রে টাকাওয়ালার একেবারে আপনজন প্রিয়জন ও আত্মজনেরাই তাকে টেকেন ফর গ্রান্টেড ক'রে নেয়। ভাবখানা এমন, আগে ফেল কড়ি, তারপর মাখো তেল!

তখন তারা নির্বাক অসহায় দৃষ্টি মেলে ছলছল চোখে খামচে ধরা বুকে নোতুন করে উপলব্ধি করে একদিন হাসি মস্করাতে পার্টি পিকনিকে রঙিন জলে গলা ভিজিয়ে নেশাতুর চোখে গেয়ে ওঠা
"না বিবি, না বাচ্চা, না বাপ বড়া, না ভাইয়া
The whole thing is that কে ভাইয়া সবসে বড়া রপাইয়া।" গানের মর্মার্থ।

ফলে তারা যখন বাইরে বেরোয় গরীবের থেকে তারা বেশী গরীব হয়ে বেরোয়। রোবটের মধ্যে আগে থেকে প্রোগ্রাম ফিট ক'রে দেওয়ার মতো বাইরে বেরোবার আগে মুখে কৃত্রিম হাসি মেখে ও সুখী সুখী একটা ভাব চোখে মুখে মেখে নিয়ে বেরোয়।
কিন্তু এই কৃত্রিম হাসি হাসার ও চোখে মুখে সুখী সুখী ভাব মেখে নিয়ে বের হবার দরকার হয় না গরীবের। সে জানে সে গরীব। তার সঙ্গে কেউ মিশুক না মিশুক, কথা বলুক না বলুক কপট ভালোবাসার মানুষের ভিড়ে সে নেই, কপট মানুষের কপট খাতির যত্নের দমবন্ধ করা দূষিত বিষাক্ত আবহাওয়ায় তার প্রাণ ওষ্ঠাগত নয়, কিন্তু সেটা বোঝে না গরীবের পরিবারের আপনজন। পরিবারের লোকেদের কাছে এসব তাত্ত্বিক কথার কোনও মূল্য নেই। ভাঁড় মে যায় ইয়ে সব বেকার ফিলসফি।

তাই টাকা বিশেষ কিছু প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটায়, অবশ্যই মেটায়, হ্যাঁ নিশ্চয়ই মেটায়, তার জন্য টাকার দরকার। কিন্ত টাকা অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতার চাহিদাও মেটায়। সেই অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতার চাহিদা মেটাবার জন্য মানুষ টাকার পিছনে পাগলের মত ছুটে বেড়ায়, ছুটে বেড়ায় পরিবারের প্রিয়জনের চাহিদা মেটাবার তাগিদে অসৎ পথে, আর নিজের অজান্তে ধীরে ধীরে জীবন সূর্য অস্তাচলে ঢলে পড়ে। যেদিন জীবন সূর্য ডুবে যাবার সময় আসে তখন বোধের ঘরে ধরা পড়ে জীবন সূর্য ঢলে পড়েছে তখন ঢলে পড়া পশ্চিমাকাশে বসে বোধে আরও ধরা পড়ে কেউ কারও না, সব স্বার্থের সম্পর্কে বাঁধা। তখন বুঝতে পারে, উপলব্ধি হয় টাকা মূল্যবান হলেও টাকা সবকিছু না। আর, যখন বোঝে তখন আর কিছু করার থাকে না। প্রচুর টাকা তখন শুধুই কাগজ আর কাগজ, কাগজ আর কাগজ। তখন সে একা, নিঃসঙ্গ! ফাঁকা ঘরে অসহায়। আপনজনদের কারও সময় নেই পিছন ফিরে তাকাবার, থেমে যাওয়া ঘড়িকে আবার চালু ক'রে দেবার। তখন তার এতদিনের রোজগার করা গান্ধীর ছবি ছাপানো কাগজের বান্ডিলগুলো আর তার না, এখন বান্ডিলগুলো অন্যের। সব অন্যের। শুধু অসহায় চোখে চেয়ে থাকে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ফাঁকা ঘরে একা। একা ঘরে শুনতে পায় বহুদূর থেকে কে যেন ডাকছে, বলছে, আয়, সময় হ'য়ে গেছে যাবার।

তাই জীবনকে যে অল্পে বেঁধে রাখতে পারে আর যে বোঝে যা কিছুর তৃপ্তি ও আনন্দ সবই ঐ ভূমা র উপলব্ধিতে; অর্থাৎ সর্বব্যাপী পুরুষ; মহান পুরুষ, পুরুষোত্তম পরমপিতার সান্নিধ্যে, সেই মুক্তো পুরুষে জীবনের সমস্ত তৃপ্তি ও আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে সে তখন বুঝতে পারে সত্যিই সত্যিই আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনের কোনখানে। সেখানেই খুঁজে পায় জীবনে কোথাও না পাওয়া শান্তি, শান্তি, শান্তি!
( লেখা ২৩শে ডিসেম্বর'২৪)



No comments:

Post a Comment