Powered By Blogger

Sunday, December 22, 2024

প্রবন্ধঃ সন্তান থাকুক মোর দুধে ভাতে। (পর্ব ১)

পৃথিবীর সব মায়েরাই তার ছোট্ট সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধ'রে গালে কপালে চুমু খেতে খেতে অশ্রুসিক্ত চোখে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা ক'রে বলে, আমার সন্তান থাকুক দুধে ভাতে। পৃথিবীর গরীব-বড়লোক, মূর্খ-জ্ঞানী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সৎ-অসৎ, সতি-অসতী সব মায়েদের এই একই চাওয়া। এই চাওয়ায় কোনও ভেজাল নেই, নেই কোনও এই চাওয়ায় ধর্মীয় পরিচয়। একটাই পরিচয় 'মা'। এই একই কথা বাবাদের ক্ষেত্রেও।

মেয়েরা যেমন চেনা পরিবেশ, চেনা মানুষ, চেনা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে সম্পূর্ণ অচেনা এক মানুষের হাত ধ'রে অচেনা পরিবেশ, অচেনা মানুষজন, অচেনা বাড়িতে অচেনা এক নোতুন ঘরে; তারপরে ধীরে ধীরে স্বামী নামক অচেনা মানুষটির হাত ধ'রে অচেনা পরিবেশ, অচেনা বাড়িঘর, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ নামক অচেনা মানুষজন সবাইকে চেনা ক'রে নেয়, আপন ক'রে নেয়, তারপরে সংসারের সমস্ত কাজের বোঝা কাঁধে তুলে নেয় হাসি মুখে, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে সংসারের জন্য, সংসারের সকল সদস্যের জন্য হাসি মুখে। তারপর একদিন ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদে মায়ের ঘর ছেড়ে আসা সেই মেয়েই সংসার সমুদ্র পাড়ি দিতে দিতে একদিন নিজেই 'মা'-এর আসন গ্রহণ করে এবং অবশেষে একদিন সেই নতুন সংসারের সর্ব্বময় কর্ত্রী হ'য়ে ওঠে।

সেই যেদিন সেই মেয়েটি 'মা' হয় তখন সেই মা আমৃত্যু তার সেই ছোট্ট সন্তানের জন্ম থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়া, অনেক বড় হওয়া পর্যন্ত একটা কথায় ভাবে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে 'সন্তান থাকে যেন মোর দুধে ভাতে।' এর জন্য কোনও কষ্টকেই কষ্ট ব'লে মনে হয়না মায়েদের। সন্তানের একটু হাসি মুখে দেখলেই সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, জ্বর, রোগ, সারাদিন না খেয়ে থাকা, অভাব, অনটন, কত বিনিদ্র রাত ইত্যাদি সব সব ভুলে যায়, শিশুর হাসি মাখা মুখ দেখলেই মায়েদের শান্তি, আর কিচ্ছু চায় না মায়েরা সন্তানের কাছে।

ঠিক এই একই চাওয়া বাবাদেরও। বাবারা সন্তানের জন্য, সন্তানের মঙ্গলের জন্য, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পাহার ভেঙ্গে আনতেও পিছপা হয় না। কত কষ্ট, কত পরিশ্রম, কত ক্লান্তি, কত অপমান, কত অবহেলা, কত অন্যায়, কত আঘাত, কত না ঘুমানো রাত মুখ বুঝে সহ্য করে সন্তানের জন্য, সন্তানের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দেবার জন্য, সন্তানের ভালো থাকার জন্য, সন্তানের পড়াশুনার জন্য, সন্তানকে বড় ক'রে তোলার জন্য।

এই সন্তানকে ঘিরেই নিজেদের কত চাওয়া, কত ইচ্ছা, কত স্বপ্নকে ভ্রুণের মধ্যেই হত্যা করে বাবা-মা। হত্যা করে শুধুমাত্র 'সন্তান থাকুক মোর, থাকবে মোর দুধে ভাতে' এই চিন্তায়। একমাত্র নির্ভেজাল অকপট এই চিন্তায়। কত বিনিদ্র রাত যে কেটে যায় সন্তানের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে; তার হিসাব কে রাখে? রাখে কি কেউ? সন্তান কি জানে তা? নাকি বোঝে তা? শুধু জানে একজন! সে জন আমার দয়াল প্রভু।
সত্যি সত্যিই কি বোঝে না? নাকি বুঝেও কিছুই করার থাকে না? কেন বোঝে না সন্তান? যে সন্তান পড়াশুনা ক'রে প্রতিষ্ঠিত সে কেন বোঝে না? প্রতিষ্ঠিত পুত্র সন্তান কেন বোঝে না বাবা-মায়ের কষ্টের দিনগুলির কথা? কেন বোঝে না বয়সকালে বাবা-মায়ের মনের কথা, অন্তরের ব্যথা? প্রতিষ্ঠিত পুত্র, উচ্চশিক্ষিত পুত্র বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ীর প্রতি জামাইয়ের দায়িত্ব পালনে অতিমাত্রায় সচেতন কিন্তু নিজের পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে ততোধিক উদাসীন হয় কেন? কিসের জন্য? বাবা-মা কি এইজন্যই নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিল যে তাদের প্রাণাধিক পুত্র বড় হ'লে লেখাপড়ায় দড় হ'য়ে বিয়ের পর তাদের ভুলে যাবে ও এমন মেয়েমুখো স্ত্রৈণ পুত্র হবে? কিংবা স্ত্রীর বাপের বাড়ির টাকার জোরে তাদের পুত্র শ্বশুরবাড়ির কেনা গোলাম হবে আর বাবা-মাকেই ভুলে যাবে? নিজের জন্মদাতা মা-বাবার চেয়ে বড় হ'য়ে দাঁড়াবে শ্বশুর শাশুড়ী?

ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ লেখাপড়া করা কিংবা সাধারণ ঘরের কন্যা সন্তান বিয়ের পরেও বাপের বাড়ির প্রতি, নিজের বাবা-মায়ের প্রতি যে রকম দরদী থাকে, কর্তব্যপরায়ণ হয় তেমনটি কেন হয় না নিজের শ্বশুরবাড়ি ও শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি?

কেন পড়াশুনা জানা, উচ্চমেধাসম্পন্ন সন্তান যখন অর্থ রোজগারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন কোনও সন্তান রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, আইন, শিক্ষা, ক্রীড়া, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যষ্টি, সমষ্টি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র জীবন গঠন, উন্নয়ন ও বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের চেতনার উন্মেষ হয় এমন নীতিকথা বলে ও তুলে ধরে তাদের বক্তৃতায়, লেখনীতে তখন তার বাস্তব ছবি তাঁদের চরিত্রে প্রতিফলিত হয় না কেন? কেন তারা সেই নীতিকথা তাঁদের চালচলন, কথাবার্তা, আচার আচরণ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নিজ জীবনে বহন ক'রে নিয়ে চলে না? কেন পালন করে না charity begins at home তত্ত্ব? তখন তাঁদের দিয়ে সমাজের কি হিত রচিত হবে?
আর, যারা অক্ষরজ্ঞানহীন, সাধারণ লেখাপড়া জানাওয়ালা, সরল, সিধা, বেকুব, মূর্খ, দুর্বল, কুসংস্কারাছন্ন, ভীরু, স্বার্থপর, ধান্দাবাজ আম মানুষ তারা যখন স্বাভাবিকভাবেই নিজের অজান্তে নিজেদের সর্বনাশ করার মধ্যে দিয়ে সমাজের সর্বনাশ করে তখন তাদের দিয়েই বা আর কি হবে?
ব্যতিক্রম কি নেই? আছে, নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু এই কলিযুগে ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমীই।
এর জন্যে কে দায়ী? সমাজ? সমাজব্যবস্থা? শিক্ষা? পিতামাতা? পরিবার? পরিবেশ? নাকি সে নিজে? 
(লেখা ২২ডিসেম্বর' ২০২৩)



No comments:

Post a Comment