Powered By Blogger

Tuesday, December 17, 2024

প্রবন্ধঃ আমিষ ও নিরামিষ।

আমিষ-নিরামিষ আহার নিয়ে প্রায় সময়ই বাদ বিতন্ডা চোখে পড়ে ধর্মজগত ও ঈশ্বর বিশ্বাসী লোকেদের মধ্যে। ভয়ংকর উগ্রতার বিষের কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায় চারপাশ। আমিষ নিরামিষ নিয়ে পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে কি বলা আছে, কোন ধর্মগুরু কোথায় কি বলেছেন, কোন প্রফেট তাঁদের কোন গ্রন্থে কি বলেছেন, বিজ্ঞান কি বলছে ইত্যাদি তাই নিয়ে চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ, চলে কথার স্রোতে অন্তহীন গন্তব্যহীন, লক্ষ্যহীন, কর্মহীন ভেসে চলা। আবার মুসুর ডাল আমিষ কি নিরামিষ তাই নিয়েও চলে জোর চর্চা, তর্কবিতর্ক, ছুঁৎমার্গ।

আরে বাবা, আমিষ নিরামিষ নিয়ে এত কথার প্যাচাল পারার কি আছে বুঝি না। সত্যিই বুঝি না। আরে আমিষ খেলেই বা কি আর না খেলেই বা কি? খাদ্যখানা সব তো জীবনকে ধারণ করা বা ধ'রে রাখা অর্থাৎ রক্ষা করার জন্য। আর এই ধারণ করা থেকেই ধর্ম কথাটা এসেছে। খাওয়ার জন্য জীবন নাকি জীবনের জন্য খাওয়া? এই ব্যাপারটা যে যেমন বোঝে তাকে তেমন বুঝতে দিন। এই নিয়ে এত খড়্গহস্ত হওয়ার বা তর্কাতর্কি, ঝগড়াঝাটি, মারামারির কি আছে? যে মনে করে খাওয়ার জন্য জীবন, খাওয়ার জন্য সে জন্মেছে তাকে প্রাণভরে খেতে দিন, আমিষ খেতে দিন। বিভিন্ন স্বাদের, বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পদের নানারকম দুর্দান্ত খাওয়াই যদি না হ'লো মন ভরে তাহ'লে এই অল্প ক'দিনের জন্য পৃথিবীতে এসে কি লাভ? ঠিক আছে সে তাই খাক। খেয়ে জীবন উপভোগ করুক। এতে ক্ষতি বা দোষটা কোথায়? এখানে নিরামিষাশীদের নাক সিটকানো বা ঘৃণার কি আছে!?!?

আর যে মনে করে জীবনের জন্যই খাওয়া, জীবনের প্রকৃত বেঁচে থাকা ও বৃদ্ধি পাওয়ার জন্যই খাওয়া। জীবনকে উপভোগ করার জন্যই খাওয়া। এই ভুবন মাঝে ব'য়ে যাওয়া আনন্দধারাকে জীবন মাঝে ব'য়ে দেবার জন্য নানারকম উপকরণের মধ্যে অন্যতম এক উপকরণ খাওয়া। এই নশ্বর পৃথিবীতে জীবনে রোগ, শোক, গ্রহদোষ, বুদ্ধিবিপর্যয়, দরিদ্রতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য খাওয়ারও একটা মুখ্য ভুমিকা আছে। শরীরে-মনে সুস্থ থাকা ও দীর্ঘ জীবন লাভের সঙ্গে খাওয়ার একটা সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। সে তেমন খাবারই খাক না নিজের তৃপ্তি মতো। তা'তে আমিষাশীদের নিরামিষ আহারকারীদের ওপর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার বা দূর্বল ভাবারও কিছু নেই। নিরামিষ আহারকারীদেরও এতে নিজেদের অহিংস ভেবে অহংকার করার কিছু নেই। জলের প্রাণী জলে বাঁচুক, ডাঙার প্রাণী ডাঙায়; আর উভচরকে উভয় জায়গায় থাকতে দিন। আসুন মিলেমিশে থাকি।

আমিষ আহারকারীকেও একদিন চলে যেতে হবে এই দুনিয়া ছেড়ে, নিরামিষ আহারকারীকেও তাই। আগে আর পিছে। নিরামিষ আহার গ্রহণকারী গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে সে আমিষ আহারকারীর থেকে পরে অনেক পরে দুনিয়া ছেড়ে যাবে এবং সুস্থভাবেই যাবে এবং দুনিয়ার সব সব নিরামিষ আহার গ্রহণকারী আমিষ আহার গ্রহণকারীর চেয়ে দীর্ঘদিন সুস্থ সবলভাবে বাঁচে?

যাই হ'ক যে যে দর্শনে বিশ্বাসী, যে যে এঙ্গেল থেকে জীবন ও খাওয়ার ব্যাপারটাকে দেখে, যে যে বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি দিয়ে জীবন ও খাওয়ার মধ্যে পরস্পরের সম্পর্কটা দেখে, বিচার করে সে সেই দর্শনে বিশ্বাস, সেই এঙ্গেল, বোধ, বুদ্ধি, জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি নিয়ে চলুক না দু' দিনের জন্য আসা এই জীবনে। এত চাপাচাপি, এত তত্ত্বকথা গলা টিপে গেলানোর, এত তর্কবিতর্ক, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, মনোমালিন্য, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, জাতে জাতে সম্পর্কের অবনতি করার কি আছে বুঝি না।

আমিষ নিরামিষ খাদ্যের সঙ্গে শরীর-মনের বিধানের একটা সম্পর্ক আছে। শরীর বিধান অনুযায়ী খাদ্যখানা ক্রিয়া করে। যেমন পশুদের মধ্যে আছে। মাংসাশী পশু যেমন আছে আবার তৃণভোজী প্রাণীও আছে। মানুষ সর্বভুক। মানুষ সব খায়। মানুষের বুদ্ধি তীক্ষ্ণ তাই সে সব রকমের খাবার চেখে দেখেছে, করেছে বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু প্রোটিন ভিটামিন যুক্ত খাদ্যের আবিস্কার। আর সেই অনুযায়ী শরীরের ভালমন্দের কথা ভেবে সেইমতো বিধান দিয়েছে। এবার মানুষ কেউ তা মেনে চলতে পারে, কেউ মেনে নাও চলতে পারে। কেউ আমিষ খাদ্য পছন্দ করতে পারে, কেউ নিরামিষ খাদ্য পছন্দ করতে পারে, কেউ কেউ উভয় খাদ্যই পছন্দ করে। আমার জীবনে বহু মানুষকে দেখেছি আমিষভোজী মানুষ যে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমিষ ছাড়া চলতে পারতো না তাকেই দেখেছি আমিষ খাদ্যের প্রতি আর তেমন আগ্রহ বোধ করে না। কেউ শরীরের কারণে, কেউ বা বিতৃষ্ণার কারণে, কেউ বা ধর্মীয় কারণে খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। ছোটোবেলার পারিবারিক পরিবেশের কারণেও অনেক মানুষ আছে সম্পূর্ণ নিরামিষভোজী। আবার আজন্ম নিরামিষ পরিবারের বাইরে যখন পা রাখে পড়াশুনা কিংবা কর্মসূত্রে তখন অনেককেই দেখেছি বাধ্য হয়েই হ'ক আর লোভে পড়ে বা বন্ধুবান্ধবদের চাপে পড়েই হ'ক আমিষ খাদ্য গ্রহণ করতে। আবার অনেকে আছে সমাজে একটা মিথ্যা স্ট্যাটাস সিম্বল বজায় রাখতে প্রকাশ্যে নিরামিষ আহার খায় আর পর্দার পিছনে আমিষের মাথা, হাড় চিবিয়ে খায় পরম তৃপ্তিতে। অনেকে আছে আদর্শের খুশীর স্বার্থে আমিষ আহার ত্যাগ করেছে সানন্দে। অনেক মানুষ আছে যারা আদর্শে অনুপ্রাণিত হ'য়ে, কারও কথায় বা কোনও পরিবেশের ছোঁয়ায় প্রভাবিত হ'য়ে আমিষ ত্যাগ করেছে ও করছে। কিন্তু পরে আবেগ নষ্ট হওয়ার কারণে, বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়ায়, কারও দুর্ব্যবহারে বিরক্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত হ'য়ে ঐ ত্যাগ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে। পুনরায় ডুবে গেছে আমিষ আহারে।

যাই হ'ক এরকম নানা কারণ আছে আমিষ নিরামিষ ছাড়ার ও ধরার। কিন্তু ধর্মপালন করার কারণে যে আমিষ ত্যাগ ও নিরামিষ আহার গ্রহণ সেখানে ধর্মের মূল অর্থ, আমিষ নিরামিষ আহারের মেরিট-ডিমেরিটস্-এর কোনও ধার ধারে না তথাকথিত ধার্মিকেরা। তারা স্পষ্টতই একটা বিভাজনের খেলা ডিভাইড অ্যান্ড রুলের খেলা খেলে, একটা সুপিরিয়র-ইনফিরিওর-এর ক্ষেত্র রচনা ক'রে ধর্মের খোলসে অধর্মীয় আচরণের চাষ করে ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখার তাগিদেই বোকা, মুর্খ, ভীরু, অতিবোদ্ধা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মাথা মোটা ধর্ম ও ঈশ্বরভীরু মানুষের সাহায্যে। মিলেমিশে থাকার মানসিকতা কেন যে থাকে না সেটাই অবাক হওয়ার ব্যাপার।

আমরা ধর্ম ও ঈশ্বর আরাধনার জগতে ধর্ম ও ঈশ্বর আরাধনার পথে চলা প্রকৃত ও ভন্ড উভয় ভক্তদের দেখেছি ও দেখছি। ঈশ্বর ও ধর্মকে অনুধাবন করা দুনিয়া কাঁপানো উপলব্ধিবান আধ্যাত্মিক পুরুষ প্রকাশ্যে আমিষ ভক্ষণকারী বিবেকানন্দকে আমরা যেমন দেখেছি ঠিক তেমন বহু নিরামিষভোজী আধ্যাত্মিক মহাপুরুষকেও দেখেছি ও দেখছি। আবার লুকিয়ে নিরামিষ খাওয়া তথাকথিত ধর্মকথক ও ধার্মিক মানুষও বহু আছে। আবার এমন অনেক আছে যারা ধর্ম-ঈশ্বর ভালোবাসে, সত্যিই ভালোবাসে আবার আমিষ খাবারও পছন্দ করে। কিন্তু লোকলজ্জায় কিংবা অতিভক্ত, উগ্র, অন্ধ, মূর্খ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ভন্ড ভক্তদের চাপে প্রকাশ্যে আমিষ আহার করতে পারে না, বাধ্য হ'য়ে লুকিয়ে খায়। আমি প্রায় সব ধরণের ধর্মীয় লোকেদের ক্ষেত্রেই দেখেছি এ ধরণের প্রবণতা।

নিরামিষ আহার গ্রহণকারী অনেক মানুষ আছে যারা পেঁয়াজ রসুনকে আমিষ মনে করে না। আবার অনেক আছে পেঁয়াজ রসুনও খায় না। যেমন স্বস্ত্যয়নী ব্রতধারী সৎসঙ্গীরা পেঁয়াজ রসুনও খায় না। কিন্তু অনেক স্বস্ত্যয়নী ব্রতধারী আছে যারা রা -জ-সিক নিরামিষ খায় অর্থাৎ হাত চপচপে তেল, ঘি, ঝাল, মশলা সহযোগে নিরামিষ খায়। খেয়ে আবার নাক-চোখের জল মুছে পাড়া কাঁপিয়ে নিরামিষের ঢেঁকুর তোলে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, নিশ্চয়ই আছে, অ-নে-ক আছে যারা সাত্ত্বিক নিরামিষ খায়।

আবার আমাদের সৎসঙ্গীদের মধ্যেও অনেক সৎসঙ্গীকে দেখেছি তাদের মধ্যে যারা স্বস্ত্যয়নী ব্রত গ্রহণকারী তারা অনেকেই সাধারণ দীক্ষিত সৎসঙ্গীদের সঙ্গে কথাবার্তায়, চালচলনে, এককথায় বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন কিংবা অদৃশ্য একটা দেওয়াল সৃষ্টি করে। কারণ তারা মনে করে তারা নিরামিষভোজী। স্বস্ত্যয়নী ব্রতধারী সৎসঙ্গীরা মনে করে তারা অন্য গ্রহের জীব। স্বস্ত্যয়নীর অর্থ বা ব্রতের অর্থ জানুক আর না-জানুক, বুঝুক, না-বুঝুক, স্বস্ত্যয়নীর পঞ্চনীতি পালন করুক আর না-করুক, চরিত্রে তার প্রতিফলন ঘটুক, আর না-ঘটুক ও কর্মক্ষেত্রে তা ফুটে উঠুক আর না-উঠুক নিরামিষ খেলেই তারা জাতে উঠে গেছে, সাধারণ দীক্ষিতদের থেকে একটু উচ্চ আসনে তারা অবস্থান করে, তারা ঠাকুরের খুব কাছের মানুষ। অতএব তারা সাধারণ দীক্ষিতদের থেকে ওঠা, বসা, শোওয়া, খাওয়া সব কিছুতেই একটা দূরত্ব বা ব্যবধান রচনা করে নিজ এলাকায়। মাঝে মাঝে দেখে মনে হয় নিজেরাই এক একজন ঠাকুর হ'য়ে গেছে। কিন্তু ধর্ম, ঈশ্বর, দীক্ষা, স্বস্ত্যয়নী, নিরামিষ-আমিষ ইত্যাদি সব ব্যাপারেই চলনে-বলনে, কথাবার্তায়, আচারে-ব্যবহারে অর্থাৎ চরিত্রে যার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন নেই। ঈশ্বর বিশ্বাসী, ধর্ম পালনকারী, নিরামিষ আহার ভক্ষণকারী মানুষ কথাবার্তায়, চালচলনে, আচার-আচরণে এমন উগ্র হয় কেন? বৃত্তি-প্রবৃত্তির ওপর লাগাম নেই ক? মোদ্দাকথা সব ধর্মের এই ধরনের মানুষ ধর্ম ও ঈশ্বরের জগতের সব ব্যাপারে অন্ধকারে, ঘোর অন্ধকারে। অথচ এদের হাতেই লাগাম, চাবিকাঠি!!!

সম্পূর্ণ নিরামিষ আহার ভক্ষণকারী মানুষের চরিত্রে যেখানে দেখেছি ও দেখছি ষড় রিপুর ভয়ংকর উগ্রতা; সেখানে আবার আমিষ ভক্ষণকারী মানুষের চরিত্রে অদ্ভুতভাবে দেখা গেছে চরম মানবিকতার, মনুষ্যত্বের নিদর্শন।

চরিত্রটাই যে নীরব যাজন ধর্ম পালন ও ঈশ্বর আরাধনার ক্ষেত্রে সে ব্যাপারে তথাকথিত ধার্মিকেরা বেহুঁশ।

সৎসঙ্গীরাও কি তাই? শ্রীশ্রী ঠাকুর কেমন দেখতে চেয়েছিলেন তাঁর সোনার সৎসঙ্গীদের? 
( লেখা ১৭ই ডিসেম্বর' ২৩)

No comments:

Post a Comment