Powered By Blogger

Monday, December 23, 2024

প্রবন্ধঃ সন্তান থাকুক মোর দুধে ভাতে। (পর্ব ২)

'সন্তান থাকুক মোর দুধে ভাতে (পর্ব ১)' প্রতিবেদন আমি শেষ করেছিলাম "এর জন্যে কে দায়ী? সমাজ? সমাজব্যবস্থা? শিক্ষা? পিতামাতা? পরিবার? পরিবেশ? নাকি সে নিজে?
"
এই পর্ব ১ প্রতিবেদন ক'জন পড়েছেন তা আমি জানি না। তবে ১০কোটি সৎসঙ্গী লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ছুটে চলা সৎসঙ্গীদের মধ্যে কয়েক কোটি ছোট্ট শিশুর দীক্ষিত পিতামাতা আছেন; এছাড়া অদীক্ষিতরাও যাতে উপকৃত হয় সেই উদ্দেশ্যেই আমি এই প্রতিবেদন লিখছি। সমস্ত পাঠককে আমার অনুরোধ আসুন একবার সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে দেখে নিই শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার জন্য প্রকৃত কে দায়ী।

কবি সুকান্ত অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে লিখেছিলেন,
"চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।"

আমিও ব'লে যাই,
যাবার হয়েছে সময়; চলে যাবো যে কোনও একদিন
আমার ফুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট দেবদূতদের ছেড়ে
অন্ধকার আগুন পৃথিবী আর বিষাক্ত নিশ্বাসে ভরা
আকাশের তলে।
তাই যাবার আগে ব'লে যাই,
শিশুর ভবিষ্যৎ সুদিন রাখা আছে জেনো নিশ্চিত
শিশুদের মা-বাবাদের কোলে।

প্রশ্নটা ছিল কে দায়ী? আজ পর্যন্ত মানুষের মুক্তির জন্য সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত সমাজ সংস্কারক মনিষীরা। মানুষের যত দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা সমস্ত কিছুর জন্য বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থা দায়ী ছিল ব'লে তাদের অভিমত। তাই তারা ঐ বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার কারাগারের লৌহকপাট ভেঙে ফেলার ডাক দিয়েছিল। কিন্তু অনেক কিছু হারাবার বিনিময়ে ঐ বন্ধ কপাট ভেঙে ফেলার পরেও আবার ধীরে ধীরে ভুঁই ফুঁড়ে উঠে এসেছিল আরও ভয়ংকর আবার ঐ বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার কারাগারের বন্ধ লৌহকপাট।

তাই, সমাজব্যবস্থার দোষ দেখিয়ে নিজের জৈবী সংস্থিতিতে যে অব্যবস্থা, নিজের প্রাত্যহিক জীবন চলনের ব্যবস্থার মধ্যে যে অব্যবস্থা, পারিবারিক সদস্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে যে অব্যবস্থা, এককথায় চরিত্রের মধ্যে যে অব্যবস্থার দোষ লুকিয়ে রয়েছে তা এড়িয়ে যাওয়া আর গোড়া কেটে আগায় জল দিয়ে গাছ বাঁচানোর চেষ্টা একই ব্যাপার। গুয়ের এ-পিঠ আর ও-পিঠ। সেদিকে কোনও সংস্কারক নজর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। সমস্যার সমাধান যে রিপুতাড়িত বৃত্তি-প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, জৈবী সংস্থিতির মধ্যে, জীবন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ গ্রহণের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে তা তারা স্বীকার করেননি ও মানেননি। অহংকারের কারণে আর অবৈজ্ঞানিক ব'লে সেই মূল বিষয়গুলিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে।

শিশুর প্রথম স্কুল তার মা। তারপর বাবা ও পারিবারিক অন্যান্য সদস্যরা। পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। শিশুর বাবা-মা যদি নিজেদের খারাপ দিকগুলিকে পরিবর্তন না করে তাদের জীবন যাপন, চালচলন, কথাবার্তা, আচার আচরণ, চিন্তাভাবনা ইত্যাদির মধ্যে তাহ'লে শত শিক্ষাও তাদের শিশুদের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ বাবা-মায়ের প্রতিদিনের প্রতিমুহুর্তের শরীরের ও চোখমুখের ভালো বা মন্দ ভাষা শিশুর কাঁচা মাথায় ছাপ রেখে যায়। ছোট্ট শিশুরা নকল প্রিয়। তারা তার চারপাশের সব কিছুকে খুব দ্রুত নকল করতে পারে। তাই খুব সাবধান থাকতে হয় বাবামায়েদের শিশু জন্মের পর থেকেই। বাবা-মা যদি তাদের সন্তানকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে, যদি শিশুকে শরীরে-মনে ও আত্মায় ছোট্ট থেকে মহাত্মায় উত্তীর্ণ করতে চায় তাহ'লে প্রথমে নিজেদের জীবনের যত বদ অভ্যাস, কু অভ্যাস, কুসংস্কার, অসৎ চিন্তা, ভাবনা, কর্ম ত্যাগ করতে হবে, ষড়রিপুকে নিজের কন্ট্রোলে রেখে সচেষ্ট হ'তে হবে মহাত্মায় উত্তীর্ণ হওয়ার। ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য যেন মা-বাবাকে কন্ট্রোল ক'রে রাস্তার কুত্তার মত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে না পারে গলায় তাদের বকলেস পড়িয়ে।

তাই, শিশু সন্তানকে কে যদি ভবিষ্যতে আদর্শ মানুষ হিসেবে দেখতে চায় মা-বাবা তাহ'লে মা-বাবার জীবনে আদর্শ গ্রহণ করা দরকার। সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ অর্থাৎ জীবন্ত ঈশ্বরকে যাকে পুরুষোত্তম, পরমপিতা, পরমকারণ, সদগুরু, সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, সর্বব্যাপী বলা হয় তাঁকে জীবনে গ্রহণ করা দরকার এবং লোকদেখানো ফুল, ধুপ-ধুনো দিয়ে আদর্শের চরণপূজা করা নয় তাঁর চলনপুজা করার দরকার। তাবিজ, মাদুলি, আংটি, পাথর, লালসুতো, কালোসুতো, লোহা, শেকড় বাকড় ইত্যাদি নির্ভর ক'রে সন্তানকে মানসিকভাবে দূর্বল মানুষে পরিণত ক'রে বড় করা নয়। তারপর সেই জীবন্ত ঈশ্বরের চলনপুজা অনুযায়ী নিজে শিক্ষিত হ'য়ে নিজে ক'রে ও সন্তানকে করিয়ে একেবারে আধো কথার সময় থেকেই জীবন্ত আদর্শে অনুপ্রাণিত ক'রে তোলা দরকার এবং যথাসময়ে পাঁচ বছর বয়সেই জীবন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ সদগুরু পরমপিতার সৎনাম দিয়ে দেওয়া দরকার। তারপর পাঁচ থেকে দশবছরের মধ্যেই যা কিছু সন্তানের ভিত তৈরী ক'রে দিতে হবে। নতুবা সেই প্রবাদ 'কাঁচায় না নুইলে বাঁশ পাকায় করে ট্যাঁসট্যাঁস'-এর মতো হবে। পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ভিত তৈরীর সময়। সেই সময়ের মধ্যে ভিত যদি তৈরী না হয়, তৈরী না হয় সময়ে কাঁচা জমিতে তখন পাকা জমিতে শত শাসন, লক্ষ সাধু কথা, কীর্তন, গুরুর হাজার আশীর্বাদ কোনও কাজে আসবে না। উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল রিপুর দাপাদাপিতে বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া তোমার সন্তান তখন পাড়ে উঠে আর আসতে পারবে না। যদিও বা আসে কখনও কোনোদিন উঠে তবে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে সময় হারিয়ে উঠে আসবে।
আর, তোমার সন্তানের মঙ্গলের জন্য তোমায় তৈরী হ'তে আগে। তৈরী হ'তে জীবন্ত ঈশ্বর যুগ অনুযায়ী যিনি এসেছেন তাঁকে জীবনে গ্রহণ ক'রে তাঁর অনুশাসন মেনে চলতে হবে সন্তানের বাবা-মাকে। ত্যাগ করতে হবে জীবনের সব অলীক মায়ার মোহন বাঁশীর ডাক সন্তানের সুন্দর জীবন যদি চাও তুমি। ত্যাগ করতে হবে সমস্ত রকম ভারসাম্যহীন ভোগ বিলাসিতা। ত্যাগ করতে হবে মদ, সিগারেট ইত্যাদি সমস্ত রকম জীবন ধ্বংসকারী নেশা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। যদি তুমি সন্তানের মঙ্গল চাও তাহ'লে তোমার আত্মজর দিকে তাকিয়ে ষড় রিপু কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য রিপুর 
সমস্ত রকম বিশৃঙ্খলা থেকে নিজেদের অর্থাৎ বাবা-মাকে মুক্ত থাকতে হবে। নতুবা শিশু বাবা-মা পেয়েও অনাথ শিশুর মতো জীবনে বড় হবে। তুমি নিজের হাতে বসিয়ে দিয়ে যাবে তোমার আদরের সন্তানকে নরকের দ্বারে। বাবা-মা সাবধান। 
( লেখা ২৪শে ডিসেম্বর'২০২৩)

No comments:

Post a Comment