এখন নেতা সম্পর্কে বামপন্থী নেতৃবৃন্দের মনোভাব কি? তারা বলছেন, নেতা নয়, দেশে বিকল্প নীতি প্রয়োজন। নীতির ভিত্তিতে সরকার গড়তে হবে। এখন প্রশ্ন, নীতি নাহয় নীতিশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, ভালোমন্দ ন্যায়-অন্যায় বা কর্ত্যব্যাকর্তব্য বিষয়ে বোধসম্পন্ন মানুষ তৈরী করল কিন্তু সেই নীতি কার্যে পরিণত করবে কে বা কারা? সভ্যতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় অন্তিম লগ্নে এসে তাহলে কি মানুষ আবার পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করল? এটাই কি তাহলে সৃষ্টির নিয়ম? শুরু থেকে শেষ, শেষ থেকে আবার শুরু? তাহলে কমিউনিস্টরা কি প্রমাণ করল ঈশ্বরবাদীদের দর্শন সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ-এর অস্তিত্ব? মানুষ কি অজ্ঞানতার অন্ধকার ভেদ করে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে জ্বালাতে চারিদিক আলোময় করে আবার অন্ধকারের বুকে ফিরে যাচ্ছে? অসভ্যতার বেড়াজাল ভেঙ্গে সভ্য হতে হতে চারিদিকে সভ্যতার মশাল জ্বালিয়ে আবার অসভ্যতার অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে? প্রগতির পথে চলতে চলতে অতি প্রগতির নেশায় দুর্গতিকে ডেকে আনতে চাইছে? নেতার প্রয়োজন নেই? নীতির প্রয়োজন? এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল The greatest phenomenon of the world Sri Sri Thakur Anukul Chandra-এর কথা। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় শ্রী শ্রী ঠাকুর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে বলেছিলেন, “দাশদা ঘোড়া গাড়ী টেনে নিয়ে চলে না-কি গাড়ী ঘোড়া টেনে নিয়ে চলে? দেশ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায় না-কি মানুষ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়?” ঠিক তেমনি নীতি নিজে নিজে নিজেকে কার্যে পরিণত ক’রে দেশকে গড়ে তুলবে, এগিয়ে নিয়ে যাবে না-কি কাগজের বুকে লেখা ভালো ভালো কথা হয়ে পড়ে থাকবে না-কি একজন নেতা তার চরিত্র দিয়ে, জীবন দিয়ে নীতিগুলিকে কার্যে পরিণত করে তুলবে, বাস্তবায়িত করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সপারিরিপার্শিক বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার দিকে? কোনটা? শ্রী শ্রী ঠাকুর আরও বললেন, “বই পড়ে বই হ’য়ে যেও না, বই-এর essence (সার)-কে মজ্জাগত করতে চেষ্টা কর। Pull the husk draw to the seed, (তুষটা ফেলে শস্যটা নিতে হয়)”। তাহলে নেতাদের দ্বারা রচিত নীতিগুলিকে যদি নেতারা নিজেরাই চরিত্রগত করে না তোলে, মজ্জাগত না করে তাহলে সেই নীতি দিয়ে কি হবে? বই পড়ে বই হ’য়ে যাবার মত নীতিকথার তোতাপাখি হ’য়ে লাভ কি? ছোটবেলা থেকে তো কত ভালো ভালো কথা বইয়ে পড়লাম, শুনলাম ‘সদা সত্য কথা বলিবে, অহিংসা পরম ধর্ম, চুরি করা মহাপাপ, সততাই জীবন, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করিও ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন আমরা কি দেখতে পাই? উল্টোটা নয় কি? তাহলে নীতি দিয়ে হবেটা কি? যদি না নীতিগুলিকে কার্যে পরিণত করার জন্য নেতা না থাকে? রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, বড় বড় হস্তিরা, রাজনীতিই যাদের ধ্যান-জ্ঞান, মন-প্রাণ, রাজনীতিই যাদের জীবন-মরণ তাঁরা কেউ স্বাধীনতার ৬৬বছর পরেও এতবড় দেশটার জন্য তাঁদের মধ্যে থেকে দেশের হাল ধরার জন্য, বিকল্প নীতিকে রুপায়িত করার জন্য, ভারতকে বিশ্বের দরবারে শক্তিশালী এক রাষ্ট্র হিসাবে তুলে ধরার জন্য কোনও ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেল না? এত সেই গাড়ি আছে ঘোড়া নেই, দেশ আছে মানুষ নেই। গাড়িটা কে টেনে নিয়ে যাবে? দেশটাকে বিশ্বের দরবারে কে তুলে ধরবে? আনাড়ি হাতে গাড়ীটা যদি পড়ে তাহলে কি হবে? আধুনিক টেকনোলজিতে যদি তার জ্ঞান না থাকে, আধুনিক টেকনোলজি তার করায়ত্ত না থাকে তাহলে তার হাতে আধুনিক টেকনোলজিতে তৈরী গাড়ি কতটা নিরাপদ? দেশে যদি নীতিজ্ঞান সমৃদ্ধ, নীতি চরিত্রায়ত্ত নেতার মত নেতা না থাকে তাহলে কি হবে নীতিজ্ঞ দিয়ে তৈরী নীতিমালা দিয়ে? রাজভোগ, রাজঅন্ন কি ভিখিরির জন্য শোভা দেয়? সে তো সমস্ত অন্ন ঘেঁটে একাকার করে দেবে। এ প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ঠাকুর বললেন, ‘অপাত্রে করিলে দান, দাতা গ্রহীতা দুই-ই ম্লান’! দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনকে বললেন, “দেখুন, দেশে মানুষের মত মানুষের অভাব আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, অথচ এত তাড়াতাড়ি স্বরাজ পেতে যে আপনারা চাচ্ছেন, তা’তেই বোঝা যায় আপনারা স্বরাজ চান না। যদি চাইতেন তবে আমার মনে হয়, আগে মানুষ তৈরী করতেন। তা’ না-করে আপনারা পরের দোষ দিচ্ছেন, আর, ইংরেজের দোষই শুধু দেখছেন। ওদের দোষ দেখতে দেখতে ওদের কি কি গুণে আমাদের ওদের অধীনে থাকতে হচ্ছে তা’ আর নজরেই পড়ছে না”।
(লেখা ২৫শে মার্চ' ২০১৪)
No comments:
Post a Comment