দেশ জুড়ে ঘটে চলা নানা ঘটনাবলী সম্পর্কে কেউ কেউ জনগণের ওপর সম্পুর্ণ দোষ চাপিয়ে দেয়। আর তা জেনে বুঝেই হোক বা না জেনেই হোক কিম্বা কৌশলেই ক’রে থাকে। একথা ঠিক যে জনগণ যদি সতর্ক থাকতো, জেগে না ঘুমাতো, চোখ কান খোলা রাখতো, যে যা বলছে তা যদি বোধবুদ্ধি দিয়ে বিচার করতো, নিজের বিবেককে যদি অনুসরণ করতো তাহ’লে জনগণের ওপর দোষ চাপাবার সুযোগ বোধকরি সুযোগসন্ধানী কৌশলী মানুষ বা জনগণের ওপর ক্ষিপ্ত অভিমানী মানুষ পেত না।
যাই হোক এই সমস্ত কৌশলী বা অভিমানী মানুষ দেশের নানাবিধ বিতর্কিত অসাধু ঘটনার সঙ্গে জড়িত নেতাদের থেকেও বেশী দোষ দিয়েছেন জনগণের ওপর। এখন প্রশ্ন, আচ্ছা বলুনতো আপনি আমি কার কাছে কি আশা করেন বা করি? উদাহরণ স্বরুপ পশ্চিমবঙ্গে ৩৪বছরের একটানা বাম শাসনের যে ইতি হ’ল, পরিবর্তন হ’ল একটানা একটা ব্যবস্থার তার দাবীদার কে? জনগণ না-কি নেতৃত্ব? এই যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ঘটনাকে কেন্দ্র ক’রে ‘হোক কলরব’-এর জন্ম হ’ল এবং উপাচার্যের পদত্যাগের দাবীতে গণভোটের আয়োজন করা হ’ল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সমস্ত বিষয় সংঘটিত করার মূল কারিগর কে? যাদবপুরের ছাত্রবৃন্দ না-কি ছাত্র নেতৃত্ব? আবার যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবাদে সংগঠিত ছাত্র আন্দোলনের জনক কে ছিল? প্রতিবাদী ছাত্র সমাজ না-কি নেতৃত্ব? এই যে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে মিছিল পাল্টা মিছিলে অংশগ্রহণকারী মানুষের জমায়েতের পিছনে কার অবদান বেশী বা কম? অংশগ্রহণকারী সাধারণ বোকা বা লোভী মানুষ, বুদ্ধিজীবী নামধারী অদ্ভুত জীব নাকি মুশকিল আসান করে ওগো নেতৃত্ব!?
আসলে ভাঙাচোরা জীবনের অধিকারী বিক্ষিপ্ত জনগণ সবসময় পরিস্থিতির মুখাপেক্ষী। দেখুন পাঠক, শ্রোতা, দর্শক, কর্মী ইত্যাদি তৈরী করার দায়িত্ব কিন্তু লেখক, গায়ক, শিল্পী, পরিচালক ও নেতাদের। মাথা, কান, চোখ, মুখ সবার তৈরী থাকে না। ওটা জন্মগত ও ব্যতিক্রম। আর এই জন্মগত ও ব্যতিক্রমী প্রতিভা বা শক্তি নিয়ে যারা জন্মায় তারাই অনুকূল পরিবেশ তৈরী করে এবং সেই অনুকূল পরিবেশ বাকী সবার মাথা, কান, চোখ খুলে দিয়ে পাঠক, শ্রোতা, দর্শক, কর্মী ইত্যাদি তৈরী করে। যদিও এখন কার্বাইডের যুগ, গাছ পাকা আম জামের স্বাদ পাওয়া এখন দূর অস্ত! দই-এর স্বাদ এখন ঘোলে মেটানোর যুগ! গবেষণা এখন নেট থেকে কপি পেষ্টিং নির্ভর! বর্তমান লেখক, গায়ক, শিল্পী, পরিচালক ইত্যাদির কাছে ‘সাধনা’ এখন গরুর গাড়ীর যুগের ধারণা ও সময় নষ্টের বিষয়। অর্থ, মান, যশ ইত্যাদি লাভ এখন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সহজলভ্য বিষয়! সিনেমা, সিরিয়াল, গল্প, উপন্যাসে মুখ্য চরিত্রের নারীকে অগুন্তি পুরুষের অঙ্কশায়িনী করে তোলায় আজ সাহিত্য সৃষ্টির সেরা সময়, সিনেমা তৈরীর সেরা মুন্সিয়ানা, বুদ্ধিজীবীদের সেরা সম্পাদন, সেরা কৃতিত্ব, সেরা সম্পন্ন কাজ! পা ফাঁক করে বাহু উর্ধ্বে তুলে ভাঙ্গা গলায় উর্ধ্ব থেকে হাত কাঁপিয়ে কোমরের নীচে নাবিয়ে আনলেই এখন ক্লাসিক্যাল গানের গলার কাজ হ’য়ে যায়! এরাই এখন জিনিয়াস! মাষ্টার মাইন্ড! এদের মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুসরণ করে ভাঙাচোরা আম জাম আদমি!
যাইহ’ক কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, গায়ক, শিক্ষাবিদ, অভিনেতা ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীরা যেমন সুস্থ ও বলিষ্ট সমাজ গঠনে তাদের সামাজিক গুরুদায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না ঠিক তেমনি জনগণ হ’ল কুম্ভকর্ণ! এই কুম্ভকর্ণরুপী জনগণকে জাগাতে সম্মিলিত ঢাকঢোল এর আওয়াজের যে শক্তি সেই প্রচন্ড শক্তি স্বরুপ এই সমস্ত বিভিন্ন দিকের নেতৃত্বও ঘুমিয়ে থাকা, বৃত্তি প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা রিপু তাড়িত জনগণকে জাগাতে তাদের দায় দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না! আর নেতৃত্বের হাতে থাকে সেই রাজকন্যার গল্পের মত দু’টো জাদুকাঠি! সোনার কাঠি ও রুপোর কাঠি! একটার স্পর্শে রাজকন্যা জেগে ওঠে আর একটার স্পর্শে ঘুমিয়ে পড়ে। সবটাই নির্ভর ক’রে ঐ জাদুকরের ওপর। কখন রাজকন্যাকে জাগাবে আবার কখন রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে সবটাই ঐ জাদুকরের ইচ্ছা ও জাদু ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এখানে জনগণও ঐ রাজকন্যার মতো আর নেতা হ’ল জাদুকর! যেমন ধরুন মাকড়া কান্ডে যখন গোটা রাজ্য তোলপাড়, গোটা গ্রাম যখন শশ্মানে পরিণত হয়েছে তখন বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার শাহরুখ খান মত্ত রয়েছেন সেন্ট জেভিয়ার্সের তরুণ তাজা রক্তদের নিয়ে উন্মাদনার ফোয়ারা তুলে নিজের হ্যাপি নিউ ইয়ার ফিল্মের ব্যপক ব্যবসায়িক সাফল্যের সেলিব্রেশন অনুষ্টানে। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শহুরে আধুনিক তরুণ তাজা প্রাণ আদৌ অনুভব করলো না মাকড়া গ্রামের অকালে হারানো তরুণ তাজা প্রাণের অনুরণন! আর কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ফুর্তিতে ব্যস্ত বাংলার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ কিং খান!! সেন্ট জেভিয়ার্সের ছাত্র সমাজ যেমন জনগণের মধ্যে পড়ে ঠিক তেমনি শাহরুখ কিং খান ‘বাংলার অ্যাম্বাসাডর’ হিসাবে অভিভাবকের জায়গা অধিকার ক’রে আছেন। অভিভাবক হিসাবে তাঁর কর্তব্য ও দায়িত্ব আম জনগণের চেয়ে হাজার লক্ষ কোটি গুণ বেশী এ-কথা যেন আমরা ভুলে না যায় আর ভুলেও সাধারণ ভাঙাচোরা আম জনতার সঙ্গে গুলিয়ে না ফেলি!
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন থেকে শুরু ক’রে সাম্প্রতিক পরিবর্তনের আন্দোলন, যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলন ও প্রতিবাদী ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি সব আন্দোলনের জোয়ারের পিছনের রহস্য ঐ সমুদ্রের বিশাল একটা ঢেউ-এর মতো এক বা একাধিক নেতৃত্ব! এই যে সম্প্রতি লোকসভা ভোটে দেশজুড়ে একাধিক আঞ্চলিক দলের ভিড়ের মাঝেও বহুদিন পর এককভাবে কোনও দলের সরকার গঠন হ’ল কেন্দ্রে তার পিছনেও সেই জনগণকে মন্ত্রমুগ্ধ করার কারিগর একজন নেতা! পৃথিবী জুড়ে এর অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণের অধিকারী নেতাদের কাছে জনগণকে জাগানো এবং ঘুম পাড়ানো হাতের ময়লা। তাই বৃত্তি প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা সরল সিধাসাধা বেকুব রিপু তাড়িত ভাঙাচোরা জনগণকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো মানে নেতাদের গা বাঁচিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য safe passage তৈরী করে দেওয়া। দেশ ভাগ করা না করার মত জটিল বিষয়, দুর্বোধ্য অংক, স্পর্শকাতর ইস্যু আম চাষার দল জানবে, বুঝবে, চিন্তা করবে এবং এই কঠিন বিষয় নিয়ে নির্ভুল পজিটিভ সিদ্ধান্ত নেবে এ যদি সত্য হ’ত; এই ক্ষমতা যদি আম জনতার থাকতো; এই বোধ, এই বুদ্ধি, এই চেতনা, এই শিক্ষা যদি দেশের জনগণের থাকতো তাহ’লে তথাকথিত জ্ঞানী পন্ডিত মহান আত্মাসম্পন্ন নেতাদের স্থান হ’ত আস্তাকুড়ে আর ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ট আসন লাভ ক’রে নিত এতদিনে!
তাই ভাঙাচোরা আয়ারাম-গয়ারাম আম জনগণের ওপর সম্পুর্ণ দোষ চাপাবার আগে, জনগণকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার আগে যারা সাধারণ সরল সিধেসাধা বোকা আম জনতাকে, জনতার বিশ্বাস, জনতার আশা-ভরসা-নির্ভরতাকে নিয়ে পিংপং বলের মতো লোফালুফির ভেলকি বাজী দেখায় সেই কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক, লেখক, নেতা, অভিনেতা, পরিচালকরুপী বাজিকরদের বিচার, তাদের ভবিষ্যৎ না-হয় সর্ব্বশক্তিমান বলে যদি কেউ বা কিছু থেকে থাকে তাঁর ওপরে ছেড়ে দেওয়া গেল কিন্তু যারা বোকা হাবা জনগণকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে কথার ঝিকিমিকিতে সেইসমস্ত বহুরুপী বাজিকরদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবার সুযোগ করে দেয় তাদের জন্য বেহেস্ত ব’লে যদি কিছু থেকে থাকে তার দরজা জন্মজন্মান্তরের জন্য বন্ধ কিন্তু খোলা আছে পরবর্তী ঘৃণ্য চরম যন্ত্রণাময় ভয়ংকর অন্ধকার জীবনের অন্তহীন পথচলা! এ কথা অতি সত্য। মানা, না মানা গৌণ, যার যার নিজের ব্যাপার; একান্তই ব্যক্তিগত।
( ৩০শে নভেম্বর'২০১৪ )
No comments:
Post a Comment