Powered By Blogger

Tuesday, July 16, 2024

প্রবন্ধঃ শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীআচার্যদেব ও অপ্রিয় সত্য।



অপ্রিয় হ'লেও সত্যি।
পরমপূজ্যপাদ শ্রীশ্রীআচার্যদেব এবং পূজনীয় শ্রীশ্রীঅবিনদা ১১/৬/২৪ থেকে ২০/৬/২৪ দেওঘরে থাকবেন না এই কথাটা ঘোষণা করা হয়েছিল অফিশিয়ালি। এই ঘোষণার ফলে একটা অপ্রিয় হ'লেও সত্য লুকিয়ে আছে যা আরও বড় অপ্রিয় সত্যকে প্রমাণ করে। এখন প্রশ্ন জাগে মনে, কি সেই অপ্রিয় সত্য ও আরও বড় অপ্রিয় সত্য কি যা লুকিয়ে আছে এই ঘোষণার ফলে। আসুন আলোচনা ক'রে দেখি প্রথমে কি অপ্রিয় সত্য লুকিয়ে আছে এর পিছনে।

১) আমরা ঠাকুরবাড়ি যাই কেন? কার জন্যে যাই?
২) শ্রীশ্রীআচার্যদেব না থাকলে কি হবে? শ্রীশ্রীঠাকুর কি নেই?
৩) শ্রীশ্রীঅবিনদাদার থাকা আর না-থাকার কি গুরুত্ব আছে ঘোষণার সঙ্গে?

১) আমরা ঠাকুরবাড়ি যাই কেন? কার জন্যে যাই?
আমরা ঠাকুরবাড়ি যাই শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শন ও প্রণাম করতে। যাই শ্রীশ্রীবড়মা, শ্রীশ্রীবড়দা, শ্রীশ্রীদাদাকে দর্শন ও প্রণাম করতে। যাই বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্যদেবকে দর্শন ও প্রণাম করতে ও তাঁর কাছে সমস্যা নিবেদন ক'রে সমাধান জানতে। যাই শ্রীশ্রীঅবিনদাদার দর্শনলাভ ও তাঁর শ্রীশ্রীমুখের দু'টো কথা শুনতে ও শ্রীশ্রীআচার্যদেবের অবর্তমানে তাঁর কাছে সমস্যা নিবেদন করতে। যাই ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য পূজনীয় গুরুজনদের দর্শনলাভ করতে, প্রণাম করতে ও মনের দু'টো কথা প্রাণভরে খুলে বলতে, গল্প করতে। আমরা যাই চারপাশের হৈ চৈ, কোলাহল, অভাব, অনটন, হতাশা, অবসদ, ব্যর্থতায় ভরা অশান্তির জীবনে মানসিক শান্তি খুঁজে পেতে, আনন্দ পেতে ও অক্সিজেন পেতে।


২) শ্রীশ্রীআচার্যদেব ঠাকুরবাড়িতে না থাকলে কি হবে? শ্রীশ্রীঠাকুর কি নেই?


বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্যদেব দেওঘরে না থাকলে আমরা হতাশ হ'য়ে পড়ি ও মনে হয় যেন নিরাশ্রয় হ'য়ে পড়লাম। ভাবি, কি হবে আর এখন যেয়ে, যখন আচার্যদেবই নেই? অতএব এখন যাওয়া বৃথা। আচার্যদেব থাকলে তাঁকে মনের কষ্টের কথা, দুঃখের কথা, সমস্যার কথা, বিপদের কথা বলতে পারতাম, সমাধান পেতাম, সমস্যা জর্জরিত জীবন হ'তো হালকা, মনে-প্রাণে শান্তি পেতাম। কিন্তু যখন জেনেই গেলাম দেওঘরে আচার্যদেব থাকবেন না তখন থাক এখন যেয়ে আর লাভ নেই, আচার্যদেব ফিরে এলে যাবো। যখন তিনি নেই তখন আর গিয়ে কি হবে? মুহূর্তে ঠাকুরবাড়ির আকর্ষণ হ'য়ে গেল ফিকে।

তাহ'লে শ্রীশ্রীঠাকুর কি নেই?


হ্যাঁ, ঠাকুর আছেন। ঠাকুর আগেও ছিলেন, এখনও আছেন। ঠাকুর যখন দেওঘরে আসেননি, বাংলাদেশের পাবনা জেলার হিমাইয়েতপুর গ্রামে ছিলেন, তখনও দেওঘরে ছিলেন। যখন ভারত ভাগের আগে দেওঘরে চলে এলেন তখনও হিমাইয়েত পুর গ্রামে ছিলেন। যখন তিনি দেহরূপে আসেননি তখনও ছিলেন, যখন দেহরূপে ছিলেন ও দেহত্যাগ ক'রে চলে গেলেন অর্থাৎ দেহ রূপে নেই তখনও ছিলেন, এখনও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন অর্থাৎ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবসময়ই তিনি ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। যখন কিছুই থাকবে না, যখন তিনি তাঁর সমস্ত চ্যাপ্টার ক্লোজ ক'রে দেবেন তখনও থাকবেন। যখন ছিল-নার অস্তিত্ব ছিল তখনও তিনি ছিলেন আবার যখন ছিল-নার অস্তিত্ব আসবে তখনো তিনি থাকবেন।

৩) শ্রীশ্রীঅবিনদাদার থাকা আর না-থাকার কি গুরুত্ব আছে ঘোষণার সঙ্গে?



ঠাকুরবাড়িতে ঘোষণা অনুযায়ী
অবিনদাদাও ১১/৬/২৪ থেকে ২০/৬/২৪ দেওঘরে ছিলেন না। যখন সৎসঙ্গীরা শুনলো আচার্যদেব থাকবেন না, অবিনদাদাও থাকবেন না তখন তারা ঠিক করলেন তাহ'লে আর কি করতে যাবো? আচার্যদেব না থাকলেও অবিনদাদা আছে জেনেও বহু বহু মানুষ ঠাকুরবাড়ি যায়। কারণ আচার্যদেবের অনুপস্থিতিতে শ্রীশ্রীঅবিনদাদা যখন আছেন তখন অন্তত খালি হাতে ঠাকুরবাড়ি থেকে ফিরে আসবো না।


শ্রীশ্রীঅবিনদাদার দর্শন, তাঁর হাসি আর তাঁর একেবারে চাঁছাছোলা অপ্রিয় সত্য কথার চাবুক বৃত্তি-প্রবৃত্তিতে ডুবে থাকা হতাশাগ্রস্থ, অবসাদ্গ্রস্থ লোককে একেবারে চাঙ্গা ক'রে দেয়। আর সেই মানুষটাও যখন দেওঘরে থাকবেন না তখন দেওঘরে গিয়ে আর কি হবে? যদিও ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি সদস্যই প্রাণময়, আলোময়, রুপময়, রসময় ও মধুময়। দেখলে ও কথা বললে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়, শান্ত, স্থির হ'য়ে যায়। তথাপি যার উদ্দেশ্যে যাওয়া তিনিই যদি না থাকেন তখন আর এত কষ্ট ক'রে, পয়সা খরচ ক'রে যাওয়ার কোনও মানে হয়না।


এখন প্রশ্ন করতেই পারে বিরোধীরা যার উদ্দেশ্যে যাওয়া মানে? শ্রীশ্রীঠাকুরের উদ্দেশ্যে যাওয়া নয়?
এই হ'লো অপ্রিয় সত্য কথা।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা ঠাকুবাড়ি যাই বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে এবং অন্যান্য সাধারণ সময়ে। তখন আমরা ঠাকুরবাড়ি যাই শ্রীশ্রীঠাকুর দর্শন ও প্রণাম, শ্রীশ্রীবড়মা ও শ্রীশ্রীবড়দা দর্শন ও প্রণাম করতে, শ্রীশ্রীআচার্য দর্শন ও প্রণাম করতে, সমস্যা সমাধানের তুক জানতে, আশীর্বাদ নিতে। আমরা ঠাকুরবাড়ি যাই শ্রীশ্রীঅবিনদাদা সহ ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য পূজনীয় দাদাদের ও মায়েদের প্রণাম করতে। কিন্তু যখন শ্রীশ্রীআচার্যদেব থাকেন না, শ্রীশ্রীঅবিনদাদাও থাকেন না তখন কেন আমাদের যাওয়ার আগ্রহ ক'মে আসে? শ্রীশ্রীঠাকুর কি ঠাকুরবাড়িতে থাকেন না? তাহ'লে কি ঠাকুরের গ্রহণযোগ্যতা আমাদের কাছে কমে গিয়েছে ও যাচ্ছে? আমাদের কাছে বড় হ'য়ে উঠেছে শ্রীশ্রীআচার্যদেব? শ্রীশ্রীঅবিনদাদা? আমরা কি ঠাকুর থেকে সরে যাচ্ছি? এই কথা অপ্রিয় হলেও এই অপ্রিয় সত্যের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে আরও বড় অপ্রিয় সত্য। আরও বড় অপ্রিয় সত্য বললাম এই কারণে যে, আরও বড় যে সত্য লুকিয়ে রয়েছে সেই সত্য বিরোধী সৎসঙ্গীদের(?) কাছে অপ্রিয়।
যাই হ'ক এখন দেখা যাক এই অপ্রিয় সত্য তো বললাম এখন এর পিছনে আরও বড় অপ্রিয় সত্যটা কি?

১) আমাদের ইষ্ট, আদর্শ, গুরু ও লক্ষ্য কে? শ্রীশ্রীঠাকুর না শ্রীশ্রীআচার্যদেব?
২) শ্রীশ্রীআচার্যদেব কি আমাদের গোল বা লক্ষ্য?
৩) আমাদের বিপদ থেকে প্রতি মুহুর্তে রক্ষা করেন কে?
৪) আমরা প্রতিটি সমস্যা থেকে সমাধান পেয়ে মুক্ত হ'য়ে উঠি কার সাহায্যে?
৫) কে আমাদের অন্ধকার থেকে আলোর পথে নিয়ে যান?
৬) কে আমাদের বন্ধ চোখ খুলে দেন?
৭) প্রতিমুহূর্তে আমরা শক্তি পাই কার কাছ থেকে?
৮) কার সংস্পর্শে আমাদের মনের ময়লা দূর হয়?
৯) কার চোখের দৃষ্টিতে, আশীর্বাদে, দয়ায় আমরা শক্তিমান হ'য়ে উঠি?
১০) কার স্পর্শে আমরা দিব্যদৃষ্টি, দূরদৃষ্টির অধিকারী হ'য়ে উঠি?
১১) কার দয়ায় আমরা রোগ, শোক, গ্রহদোষ, বুদ্ধি বিপর্যয় ও দারিদ্রতা মুক্ত হ'য়ে উঠি?
১২) কার দয়ায় নিশ্চিত মৃত্যু ও অকাল্মৃত্যু থেকে আমরা রক্ষা পায়?

এইসমস্ত প্রশ্নগুলির এককথায় উত্তর হ'লো তিনি হলেন আমার আপনার মতন একজন রক্তমাংসের মানুষ। আর, সেই মানুষটিই হলেন এক ও অদ্বিতীয় পুরুষোত্তম, পরমপুরুষ, পরমকারণ, সদগুরু, সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ, সর্ব্বশক্তিমান জীবন্ত ঈশ্বর পরমপিতা শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তিনিই আমাদের প্রতিমুহুর্তে সূক্ষ্মশরীরে রক্ষা ক'রে চলেছেন, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন।
এখন প্রশ্ন করতেই পারে কেউ, শ্রীশ্রীঠাকুর যদি সব কিছুর উৎস হন তাহ'লে শ্রীশ্রীআচার্যদেব যদি ঠাকুরবাড়ি না থাকেন আমরা ঠাকুরবাড়ি যাবো না কেন? শ্রীশ্রীআচার্যদেব যদি ঠাকুরবাড়ি না থাকেন তো কি হ'লো? শ্রীশ্রীঠাকুর তো আছেন? যা নিবেদন করবো আমরা তো ঠাকুরকেই নিবেদন করবো তাহ'লে ঠাকুরবাড়ি যাবো না কেন? শ্রীশ্রীঠাকুর যদি নাই-ই আসতেন পৃথিবীতে তাহ'লে কি এই ঠাকুরবাড়ি ব'লে কিছু থাকতো? শ্রীশ্রীঠাকুর যদি না আসতেন তাহ'লে আচার্যদেব ব'লে কিছু কি থাকতো? শ্রীশ্রীঠাকুর০ ছিলেন বলেই না আচার্যদেবের অস্তিত্ব।


এই যে ভারতবর্ষের বিভিন্ন বড় বড় মন্দিরে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক যান পুজো দিতে তা সে জীবন্ত ঈশ্বরের মন্দির হ'ক আর অমূর্ত ভগবান বা Unseen God বা বোবা ভগবান, মাটির ভগবানের মন্দির হ'ক সেখানে মানুষ যান জীবন্ত ঈশ্বরের দর্শন, প্রণাম করতে বা অমূর্ত দেবতাকে পুজো দিতে, কোন আচার্যের কাছে যান না। অমূর্ত ভগবান বা দেবতাকে পুজো দিয়ে মনে শান্তি পান। তা এখানে কেন আচার্যদেব না থাকলে সৎসঙ্গীদের আগমন কমে যায়? এখানে কেন শ্রীশ্রীঠাকুরের উদ্দেশ্যে আচার্যদেব থাকুক আর না-থাকুক মানুষ আসে না বা কম আসে? কেন এখানে পুজো দিতে আসে না? পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা নেই?


অন্যান্য মন্দিরের মত ফুল প্রসাদের ডালি নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পুজো দেবার ব্যবস্থা কেন নেই দেওঘরে ঠাকুরবাড়িতে? বিভিন্ন বড় বড় মন্দির, তিরুপতির মন্দির, বৈষ্ণদেবীর মন্দির, দেওঘর বাবা বৈদ্যনাথ দেবের মন্দির, কালিঘাট, তারাপিঠ বা দক্ষিণেশ্বরের মন্দির, তারকেশ্বরে অমূর্ত ভগবান বা দেবতাকে পুজো দেবার মতো এখানেও যদি জীবন্ত ঈশ্বরকে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতো তাহ'লে শ্রীশ্রীআচার্যদেব বা শ্রীশ্রীঅবিনদাদা না থাকলেও না ক'রে পাওয়ায় বিশ্বাসী, কুসংস্কারাছন্ন, নিতেই লেলিহান, ভীরু, দুর্বল, ধান্দাবাজ লক্ষ লক্ষ ভক্তের আগমন হ'তো। আর, এছাড়া যদি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বা মা কালীর কোনও অমূর্ত ভগবানের মূর্তি রেখে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতো দেওঘর ঠাকুরবাড়িতে তাহ'লে সৎসঙ্গীদের সঙ্গে সঙ্গে আম ভক্তকুলের ভিড় উপচে পড়তো সেই জাগ্রত দেবতা হিসেবে প্রচারিত অমূর্ত ভগবানের সামনে পুজোর বর বড় ডালি নিয়ে।


আর, যদি এমনটা হ'তো তাহ'লে শ্রীশ্রীঠাকুর পড়ে থাকতো এককোণে। যেমন দক্ষিণেশ্বরে মায়ের পুজোতে সারাবছর হাজার হাজার ভক্তের বিশেষ ক'রে শাস্ত্র মতে কোনও বিশেষ দিনে লক্ষ লক্ষ ভক্তের ঢল নাবে মায়ের মন্দিরে মায়ের পুজো দিতে। আর, পাশে সৃষ্টিকর্তা, জীবন্ত ঈশ্বর, পুরুষোত্তম, পরমপিতা শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের ঘর থাকে ফাঁকা পড়ে। কেউ আসে না তাঁকে দর্শন প্রণাম করতে। আর, রোদে পুড়ে, জলে ভিজে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণের দীক্ষিত ও আম ভক্তের দল অমূর্ত ভগবান (Unseen God) মা কালীর পুজো দেওয়ার জন্য। এই হ'লো বাস্তব ছবি। যদি দেওঘরেও এই ব্যবস্থা থাকতো তাহ'লে এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা কামাবার রাস্তা খুলে যেত ঠাকুরবাড়ির। কিন্তু আপশোষের বিষয়, দেওঘরে সৎসঙ্গ মন্দিরে লাইন দিয়ে ফুল প্রসাদের ডালি নিয়ে দাঁড়িয়ে জীবন্ত ঈশ্বরের বা কোনও ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর বা মা-কালি, কোনও অমূর্ত ভগবান বা দেবতার ( Unseen God) পুজো দেবার কোনও ব্যবস্থা নেই।

২০২৩ সালের হিসেব অনুযায়ী আনুমানিক ভারতে ৩৫ লক্ষের চেয়েও বেশি বৃহৎ আকৃতির হিন্দু মন্দির রয়েছে বলে অনুমান করা হয়, যার সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমস্ত বড়ো,মাঝারী,ছোট মন্দির সহ আশ্রম, গুহাপাহাড়, জঙ্গলের ভিতর, রাস্তার ধারে, গৃহদেবতার এবং গ্রামের অধিষ্টাত্রী দেবদেবীর মন্দিরের সংখ্যা ১ (প্রায়) কোটি হবে। সেখানে মানুষের সারা বছর ভিড় লেগেই থাকে। কিন্তু দেওঘরের সৎসঙ্গে এর উল্টো বিপরীত চিত্র দেখা যায়।
মোদ্দা কথা শ্রীশ্রীআচার্যদেব না থাকলে কোটি কোটি সৎসঙ্গীদের আগমন কমে যায় দেওঘরে, সৎসঙ্গীরা উৎসাহ পায় না আসতে।

১) কেন আসতে উৎসাহ পায় না?
২) কেন সৎসঙ্গীরা অন্য সৎসঙ্গীদের বলে এখন আচার্যদেব নেই, তিনি আসলে পরে যান বা আসুন?
৩) এটা কি অন্যায়? এটা কি ভুল? এটা কি দোষের?
৪) এটা কি শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি অসম্মান, অশ্রদ্ধা প্রদর্শন?

এই ঘটনা বা দৃশ্য বা কথোপকথন চলে আসছে শ্রীশ্রীঠাকুর পরবর্তী শ্রীশ্রীবড়দার সময় থেকে। শ্রীশ্রীঠাকুরের সময় সবসময় আশ্রমে মানুষে মানুষে ভিড় লেগে থাকতো, গিজগিজ করতো মানুষ। শ্রীশ্রীঠাকুরের তিরোধানের পর থেকে ক্রমশঃ ঠাকুরবাড়িতে মানুষের আসার সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে, বেড়েই চলেছে। শ্রীশ্রীবড়দার সময় থেকে শ্রীশ্রীদাদা হ'য়ে বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্দেব পর্যন্ত চলে আসছে আর এই ট্রাডিশান চলতে থাকবে আগামী দিনে শ্রীশ্রীঅবিনদাদার মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যত প্রজন্মের পর প্রজন্মের হাত ধরে হাজার হাজার বছর ধ'রে, আবার যতদিন না শ্রীশ্রীঠাকুর নোতুন রূপে আসছেন। আর, কলি যুগ শেষ হ'তে এখনও বহু হাজার হাজার বছর বাকী। এই হাজার হাজার বছর ধ'রে চলবে আচার্য প্রথা, আচার্য পরম্পরা।
এই যে লোকসংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে কিন্তু যখনি শ্রীশ্রীবড়দা, শ্রীশ্রীদাদা ঠাকুরবাড়িতে থাকতেন না তখনও সৎসঙ্গীদের আগমন কম হ'তো, যা এখন বর্তমান আচার্যদেবের সময় যত দিন যাচ্ছে তত আশ্চর্যজনকভাবে আরও প্রকট হ'য়ে উঠছে। সাধারণ দিনগুলিতে শ্রীশ্রীআচার্যদেব ঠাকুরবাড়িতে কিংবা উৎসব ইত্যাদিতে উপস্থিত থাকলে লক্ষ লক্ষ লোকের আগমণ হয় আর তাঁরা ঠাকুরবাড়িতে না থাকলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কেন এমন হয়?
এর থেকে তিনটে জিনিস প্রমাণ হয়।

১) কেন ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার পানাগড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু কর্তৃক সৎসঙ্গের জন্য অনুমোদিত ৬০০০ হাজার বিঘার পরিবর্তে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের দেওয়া ৮০০ বিঘা জমি শ্রীশ্রীঠাকুর রিজেক্ট করেছিলেন।
২) ছোটোবেলায় ছোট্ট শিশু শ্রীশ্রীদাদাকে পথের ধারে খেলা করতে দেখে ছোট্ট শিশু শ্রীশ্রীদাদাকে দেখিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুর কেষ্টদাকে ( শ্রীকৃষ্ণ প্রসন্ন ভট্টাচার্য) কেন বলেছিলেন, " আমার সৎসঙ্গের প্রকৃত আন্দোলন আমার থার্ড জেনারেশন থেকে শুরু হবে"।

৩) আর কেনই বা শ্রীশ্রীবড়দা হাসপাতাল থেকে সদ্য ঘরে আসা ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়েই শিশুর মুখের দিকে তাকিয়েই বিস্ময়ে তাঁর চখা আখি বিস্ফারিত ক'রে বলে উঠেছিলেন, "বাবা আই!!!!!" আর সেই থেকেই হ'য়ে গিয়েছিল বর্তমান আচার্যদেবের নাম বাবাই?


৪) কেন শ্রীশ্রীদাদা বলেছিলেন, বাবাই বাকসিদ্ধ পুরুষ। ও যা বলে তা ফলে যায়। সারা ভারত জুড়ে দীক্ষা পরিক্রমায় বেরোবার সময় কেন শ্রীশ্রীদাদা বলেছিলেন, বাবাই দীক্ষা দিতে বেড়োয়নি, শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং দীক্ষা দিতে বেড়িয়েছেন।


৫) কেন দেওঘরে বা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে উৎসব অনুষ্ঠানে শ্রীশ্রীআচার্যদেবের অবর্তমানে বা অনুপস্থিতিতে শ্রীশ্রীঅবিনদাদার উপস্থিতিতে তাঁকে দেখবার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়? এর জন্যে তো রাজনৈতিক দলের মঞ্চ ভরাবার মত লোক সংগ্রহের কোনও পরিকল্পনা বা ব্যবস্থা থাকে না। এ তো সম্পূর্ণ স্বতস্ফুর্ত যোগদান।

এখন এই যে পাঁচটা জিনিস তুলে ধরা হ'লো এর উত্তর কি? এর উত্তর ছিল, আছে ও আগামী দিনেতেও থাকবে তা হ'লো জন বিস্ফোরণ। জন বিস্ফোরণের সম্ভাবনা বুঝতে পারার কারণেই শ্রীশ্রীঠাকুর ৬০০০বিঘার পরিবর্তে ৮০০ বিঘা জমি দেওয়ার বিধান চন্দ্র রায়ের সরকারী প্রস্তাব সরাসরি রিজেক্ট ক'রে দিয়েছিলেন। দূরদর্শী সত্যদ্রষ্টা শ্রীশ্রীঠাকুরের ভবিষ্যত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হ'তে ওই ৮০০বিঘা জমি যথেষ্ট বিবেচিত না হওয়ায় তিনি অদূরদর্শী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের ৮০০বিঘার প্রস্তাব বাতিল ক'রে দিয়েছিলেন। সত্যদ্রষ্টা পরমপুরুষ পরমপিতা তাঁর সৃষ্টির আদি অন্ত সবটাই জানেন, তিনি সর্বদর্শী। তিনি যেদিন দেহরূপে, স্থুলরূপে থাকবেন না সেদিন কি হবে তা তিনি জানতেন বলেই ৮০০ বিঘা দয়ার দান রিজেক্ট ক'রে দিয়েছিলেন। জ্ঞানের অহংকারে, দূরদর্শীতার অভাবে শ্রীশ্রীঠাকুরকে অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তাকে তাঁরই সৃষ্ট জমি তাঁরই সৃষ্ট মানুষ অদূরদর্শী ডঃ বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে তৎকালীন প্রদানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু কর্তৃক ৬০০০ হাজার বিঘার পরিবর্তে ৮০০বিঘা জমি দান করতে চেয়েছিলেন দয়া ক'রে। এর থেকে বেশী ঠাট্টা, অপমান, অশ্রদ্ধা, অজ্ঞানতা, অহংকার, ঔদ্ধত্ব, বেকুবি, সবজান্তা মনোভাব, শ্রেষ্ঠজনকে অস্বীকার, ইগো আর কিছু নেই। মেরী বিল্লি মুঝসে ম্যাঁও।


উৎসব ইত্যাদি ছাড়াই জন বিস্ফোরণ দিন দিন ভয়ঙ্কর হ'য়ে উঠছে প্রতিদিন সাধারণ সময়ে। যা চিন্তার কারণ হ'য়ে উঠছে স্থান সঙ্কুলান ও ভূগর্ভস্থ অপর্যাপ্ত জলের কারণে। বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্যদেবের নেতৃত্বে শ্রীশ্রীঠাকুরের জলের সমস্যা সম্পর্কিত Blue print বাস্তবিত হয়েছে ও হয়ে চলেছে।

আর, শ্রীশ্রীঅশোকদাদার হাত ধ'রে বিশ্বজুড়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন দর্শন 'বাঁচা-বাড়ার মতবাদ, জীবনবাদ বা অস্তিত্ববাদ'-এর আন্দোলন ও শ্রীশ্রীঠাকুর সৃষ্ট এক ও একমাত্র প্রতিষ্ঠান 'সৎসঙ্গ'-এর প্রচার ও প্রসার আজ সারাবিশ্বে আলোচিত যা শ্রীশ্রীঠাকুরের ছোট্ট শিশু শ্রীশ্রীদাদাকে দেখিয়ে বলা "আমার সৎসঙ্গের প্রকৃত আন্দোলন শুরু হবে আমার থার্ড জেনারেশন থেকে" এই ভবিষ্যত বাণী প্রমাণ করে।


আর, বর্তমান আচার্যদেবের মধ্যে যে শ্রীশ্রীঠাকুর ভয়ঙ্করভাবে জীবিত তা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি সৎসঙ্গী প্রতিমুহুর্তে অনুভব করতে পারে। অনুভব করতে পারে শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রায়ই সময়ের বলা, "আজও লীলা করে গৌড়চাঁদ রায়, কোনও কোনও ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।" এই ছড়ার মধ্যে দিয়ে যেমন শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে তাঁর প্রতিটি পূর্বরূপ রাম। কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, মহম্মদ, মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ-এর লীলা বিচ্ছুরিত হ'তো ঠিক তেমনি শ্রীশ্রীঠাকুরের ব'লে যাওয়া "ইষ্টগুরু পুরুষোত্তম প্রতীক গুরু বংশধর রেত শরীরে সুপ্ত থেকে জ্যান্ত তিনি নিরন্তর" এই ছড়ার বিচ্ছুরণ আমরা দেখতে পেয়েছি শ্রীশ্রীবড়দার মধ্যে, শ্রীশ্রীদাদার মধ্যে, দেখতে পাই বর্তমান শ্রীশ্রীআচার্যদেবের মধ্যে। দেখতে পায় ঠাকুর প্রতি মুহুর্তে আচার্যদেবের মাথার চুল থেকে পায়ের আঙ্গুল পর্যন্ত যেন সঙ্কেত দিচ্ছে, ম্যায় হুঁ না, ডর কিস বাত কি? হাম হ্যাঁয় না। ডরো মাত। কল যুগ কা First and foremost পরিচয় হ্যাঁয় হল্লা। আগর হল্লা নেহী হোগা তো কলযুগ কা অস্তিত্ব কাহাঁ হ্যাঁয়? কলযুগ কিউ বোলা যাতা হ্যাঁয়? কলযুগ কা অর্থ ক্যা হ্যাঁয়? ধ্যান মত দো। ঠাকুরজীকা ধ্যান মে ডুব যাও। ঠাকুরজী হ্যাঁয় না।


শ্রীশ্রীআচার্যদেবের ধীর অথচ দ্রুত অদ্ভুত এক টানটান দৃপ্ত ভঙ্গীতে হেঁটে চলা, কথা বলা, অঙ্গভঙ্গী, আচার-আচরণ, চালচলন, চোখের চাউনি, চোখমুখের অভিব্যক্তি, অঙ্গুলি হেলন, মিষ্টি মধুর হাসি, কখনও বা বিস্ফারিত সার্চলাটের মতো উজ্জ্বল গভীর চোখের দৃষ্টি আমাকে ব'লে দেয়, ঐ দ্যাখ রেত শরীরে সুপ্ত জীবন্ত ঠাকুরজী আসছেন! তাঁর দিকে তাকালেই মনে পড়ে যায় ঠাকুরের বাণীঃ "তোমায় দেখে চিনবে লোকে তোমার ঠাকুর কেমন! তোমার সুন্দর আলোময়, রূপময়, রসময়, মধুময় জীবন দেখে বলবে লোকে কোথায় গেলে পাবো এমন জীবন!? শ্রীশ্রীআচার্যদেবের চোখের ভয়ংকর উজ্জ্বল দৃষ্টি মুহূর্তে যার শরীরের ওপর পড়ে সেই দৃষ্টি তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ পড়ে ফেলতে পারে। এটা বিজ্ঞান। এই ক্ষমতা যার ভিতরে ঠাকুর যতটা জাগ্রত ততটাই তাঁর ক্ষমতা প্রবল ও ততটাই সে দেখতে পারে। শ্রীশ্রীঠাকুর তাঁর বংশধরদের সবার মধ্যে রেত শরীরে বর্তমান। শ্রীশ্রীঠাকুরের রক্ত যার যার মধ্যে বইছে সবাই এই ক্ষমতার অধিকারী। এবং যারা ঠাকুরের কৃষ্টিজাত সন্তান তাঁদের মধ্যে যাঁদের মধ্যে ঠাকুর যতটা জাগ্রত, যার মধ্যে যতটা ঠাকুরের ঠাকুরত্ব জাগ্রত তিনি ততটাই ঐ ক্ষমতার অধিকারী। তাই তিনি বলেছিলেন, তোমাকে দেখে, তোমার কথাবার্তা, চালচলন, আচার আচরণ, হাবভাব, ভঙ্গী, চোখের চাউনি, মুখের হাসি দেখে, তোমার সঙ্গ ক'রে লোকে বুঝে যাবে তুমি কে? তোমায় মুখে বলতে হবে না তুমি সৎসঙ্গী, তুমি ঠাকুরের মানুষ, তুমি ঠাকুরের দীক্ষিত। তোমায় দেখে লোকে বলবে কোথায় গেলে পাবো এমন জীবন?

শ্রীশ্রীআচার্যদেবের মধ্যে আমরা শ্রীশ্রীঠাকুরকে পূর্ণরূপে জাগ্রত দেখতে পাই, অনুভব করি, উপলব্ধি হয়। সবকিছু দেখে যেন মনে হয় দয়াল ঠাকুর আমাদের সামনে সশরীরে বসে আছেন আর আমাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাঁকে প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের নানারকম সমস্যার প্রশ্নবাণে জর্জরিত করার জন্য আর তিনি সমস্ত প্রশ্নের সহজ, সরল, যুক্তিপূর্ণ, বিজ্ঞান নির্ভর সমাধানী উত্তর দিচ্ছেন যতক্ষণ মানুষ আছেন ততক্ষণ। কি অসীম অনন্ত ধৈর্য! যা আমরা দেখেছি শ্রীশ্রীঠাকুরের মধ্যে। যা কোনও সাধারণ অসাধারণ মানুষের পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। এটা সম্পূর্ণ অলৌকিক। যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। শুধু বলতে পারি শেক্সপিয়ারের সেই হ্যাম্লেট নাটকের উক্তি, যা শ্রীশ্রীঠাকুর প্রায় সময় বলতেন, "There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreampt of in your philosophy." (স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত)


এই যে আচার্যদেবের মধ্যে আমরা আমাদের দয়াল ঠাকুরকে প্রত্যক্ষ করি এই প্রসঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুর নিজেই বলে গেছেন,

"গুরু পুরুষোত্তমকে direct ( সরাসরি) যারা না পায়, তারা ত'দনুবর্তী আচার্য-পরম্পরার ভিতর দিয়ে তাঁর ভাবটাই কিছু না কিছু পায়। ঐ ভাব যখন মলিন ও ম্লান হ'য়ে যায়, উবে যাবার মতো হয়, বিকৃতিতে আচ্ছন্ন হ'য়ে ওঠে, মানুষকে ঈশীস্পর্শে সঞ্জীবিত ক'রে তোলবার জন্য তখন তিনি আবার মানুষ হ'য়ে আসেন, মানুষের মধ্যে তাদেরই একজন হ'য়ে বিচরণ করেন, আর নিজের আচরণ দিয়ে প্রতি পদক্ষেপেই দেখিয়ে দেন, কেমন ক'রে মানুষ ঈশ্বরের হ'য়ে চলতে পারে সব কিছুর মধ্যে।"
----শ্রীশ্রীঠাকুর। আলোচনা প্রসঙ্গে (১ম খন্ড/ পৃষ্টা ১৫৩; ৪/১২/৪১)

এছাড়াও বলেছেন,
শ্রীশ্রীঠাকুর- গুরুর তিরােধান যদি হয় তখন তিনি মূৰ্ত্তি গ্রহণ করেন
আচার্য্যের ভিতর। আচাৰ্য্যদেবাে ভব’ না কী কয়! আচাৰ্য—যাঁর আচরণকে অনুসরণ করে আমরা সমৃদ্ধ হয়ে উঠি। (দীপরক্ষী ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২২)
আবার শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন,
"ইষ্টগুরু পুরুষোত্তম
প্রতীক গুরু বংশধর
রেত শরীরে সুপ্ত থেকে
জ্যান্ত তিনি নিরন্তর।"

এবার ফিরে আসি আমার প্রথমদিকের কথায় কেন সৎসঙ্গীদের দেওঘর ঠাকুরবাড়িতে আচার্যদেব না থাকলে আগমন কম হয়।
আমরা জানি, আমাদের দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর কোথায় থাকেন।
ঐ যে পদ্মপুরাণে আছে,
নাহং তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে, যোগীনাং হৃদয়ে চ।
মদ্ভক্তা যত্র গায়ন্তি, তত্র তিষ্ঠামি হে নারদ।।
(অর্থাৎ :শ্রীশ্রীভগবান বলেছেন - "আমি বৈকুন্ঠে বাস করি না, যোগী হৃদয়েও বাস করি না, আমার ভক্তগন যেখানে আমার নাম কীর্তন করে, হে নারদ ! সেখানেই আমি অবস্থান করি ।।" )

কিন্তু আমরা ঠাকুরবাড়ি যাই তাঁর কারণ ঠাকুরের কথামত ঠাকুর রেত শরীরে ওখানে লীলা করছেন। দেওঘরের আকাশে বাতাসে, গাছগাছালিতে, পথেঘাটে সব জায়গাতে ছড়িয়ে আছে তাঁর গায়ের বাতাস, সেই বাতসে মিশে আছে তাঁর অনুপম শরীরের সুবাস, তাঁর পায়ের স্পর্শ আছে পার্লার, নিভৃত নিকেতন, নিরালা নিবেশ, জামতলা অঙ্গন, মেমোরিয়া, চিড়িয়াখানা চত্বর, স্নানকুন্ড ইত্যাদি ইত্যাদি বিশাল আশ্রম চত্বর জুড়ে, হাতের স্পর্শ আছে সেইসব স্থানে ও গাছগাছালিতে। সেই সমস্ত কিছু অনুভূত হয় তখন, যখন আচার্যদেবকে সেইসব জায়গা দিয়ে হেঁটে চলে যেতে দেখি, যখন দেখি তিনি বসে আছেন প্রার্থনা স্থলে, যখন দেখি তিনি বসে আছেন নাট্মন্দিরে, কথা বলছেন মোহন ভঙ্গীতে তখন তাঁর অপরূপ শরীরে স্পষ্ট অনুভূত হয় শ্রীশ্রীঠাকুরের উপস্থিতি। বর্তমান আচার্যদেবের নয়নজুড়ানো দেহসৌষ্ঠব, মন মাতাল করা তাঁর কথা, যুক্তিপূর্ণ সহজ সমাধানী উত্তর, তাঁর ভুবনভোলানো মিষ্টি মধুর হাসি, তাঁর কোমল-কঠিন ব্যবহার দেখে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পার্লারে বসে থাকা ঠাকুরের সেই একই রকম দৃশ্য, মনে পড়ে এস ওয়াজেদ আলির সেই বিকজ্যাত লাইন, "সেই ট্রাডিশান সমানে চলেছে।" যে দৃশ্য দেখে আমার পরিচিত আচার্যদেবের অতি বড় সমালোচককেও নতমস্তকে সলজ্জ ভঙ্গীতে নিম্ন কোমল স্বরে ভেজা গলায় অশ্রুসজল চোখে বলতে শুনি, সত্যি সত্যিই "আজও লীলা ক'রে গৌড় চাঁদ রায়, কোনও কোনও ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়" আর "ইষ্টগুরু- পুরুষোত্তম প্রতীক গুরু বংশধর, রেত-শরীরে সুপ্ত থেকে জ্যান্ত তিনি নিরন্তর।"
তাই আচার্যদেব না থাকলে আমরা সরাসরি ঠাকুর দর্শন, ঠাকুরের সঙ্গ লাভ থেকে বঞ্চিত হ'ই, তিনি যদি এবারও না রেখে যেতেন তাঁর বংশধর তাহ'লে আমরা এই ঘোর কলিযুগে, আমার চারপাশের ভয়ংকর সমস্যা জর্জরিত অন্ধকার জীবনে, জটিল নোংরা সমাজ জীবনে আমরা পাগল হ'য়ে যেতাম, মৃত্যুই একমাত্র আমাদের গন্তব্যস্থল হ'তো ঘরে ঘরে। এই কঠিন অন্ধকার জীবনে অক্সিজেন পাওয়ার জন্য আমরা ছুটে ছুটে যায় জীবন্ত ঠাকুর দর্শনের জন্য দেওঘরে। শ্রীশ্রীআচার্যদেব না থাকলে, শ্রীশ্রীআচার্যদেবের মধ্যে শ্রীশ্রীঠাকুর রেত শরীরে সুপ্ত না থাকলে আমরা বঞ্চিত হ'তাম আমাদের সমস্যা জর্জরিত জীবনে রোগ, শোক, গ্রহদোষ, বুদ্ধি বিপর্যয় ও দারিদ্রতা নানাবিধ সমস্যার সমাধান পেয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া থেকে, বঞ্চিত হ'তাম আলোর সন্ধান পেতে যা' বোবা ভগবানের কাছ থেকে, অমূর্ত ভগবানের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব হ'তো না। আমাদের মতো রিপুতাড়িত বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তে ডুবে থাকা জীবেদের পক্ষে শ্রীশ্রীঠাকুরের মূর্তি বা ফটোর সামনে বসে থেকে সমস্যার সমাধান পাওয়া, বিপদ থেকে বাঁচা কোনওদিনও সম্ভব হ'তো না।
আর, আচার্যদেব না থাকলে অবিনদাদার মধ্যে দিয়ে সেই অভাব কিছুটা পূরণ করি। পূরণ করি ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য দাদাদের সংস্পর্শে থেকে। আমরা তো ভক্ত প্রহ্লাদ নই যে স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুরকে সাধনার জোরে আমাদের সামনে নাবিয়ে আনবো। তাই ঠাকুর দয়া ক'রে এবার এই কলিযুগে আমাদের সামনে পূর্ণচন্দ্রের মতো রেত শরীরে অবস্থান করছেন শ্রীশ্রীআচার্যদেবের মধ্যে দিয়ে, আচার্য প্রথা ও আচার্য পরম্পরার মধ্যে দিয়ে। তাই আচার্যদেব আশ্রমে না থাকলে আমরা সৎসঙ্গীরা অসহায় বোধ করি। তিনি যখন যেখানে থাকেন সেখানে সৎসঙ্গীদের ঢল নাবে। সৎসঙ্গী জীবন্ত ঈশ্বরের পূজারী। শ্রীশ্রীআচার্যদেবকে দেখে আমাদের অশান্ত মন শান্ত হয়, আমাদের প্রায় বন্ধ হ'য়ে যাওয়া হৃদস্পন্দন আবার চালু হ'য়ে যায়। আমরা বাঁচি, আমরা আবার পূর্ণশক্তি নিয়ে বেড়ে উঠি। এই সহজ কথাটুকু তারা বুঝতে পারে না, যাদের এই বিশ্বাস নেই, নেই নাম ধ্যান, নেই ঠাকুরের ঠাকুরত্ব জাগাবার ইচ্ছা ও চেষ্টা, যাদের নেই অভিজ্ঞতা, নেই উপলব্ধি; তাদের কাছে সবটাই বকোয়াস, বকোয়াস এই জীবন, বকোয়াস এই পৃথিবী। শ্রীশ্রীঠাকুর সৃষ্ট মূল কেন্দ্র 'সৎসঙ্গ'-এর বিরোধীদের কাছে এ প্রতিবেদন অপ্রিয় হ'লেও ভয়ংকর সত্যি। এ চিরন্তন সত্য।
এসব কথা প্রিয় হ'লেই বা কি আর অপ্রিয় হ'লেই বা কি। সত্য হ'লেই বা কি, আর মিথ্যা হ'লেই বা কি? মানলে ভালো, না-মানলে তার ব্যাপার, সময় থেমে থাকে না। সত্য তার আপন পথে চলতে থাকে।


তাই, শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকের সেই সংলাপ যা শ্রীশ্রীঠাকুর কথায় কথায় বলতেন, আবার বলি, There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreampt of in your philosophy. যার অর্থ, (স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত)

এই সংলাপ ঠাকুর বারবার বলতেন আমাদের চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য, আমাদের সন্দেহকে দূর ক'রে বিশ্বাসকে শক্ত করার জন্য, মিথ্যার জগত থেকে বেরিয়ে এসে সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। সেই সংলাপ বিরোধীরা জানেন না বা জানলেও মানেন না বা অর্থ বোঝেন না। তাই তারা আচার্য প্রথা, আচার্য পরম্পরা, আচার্যদেবের মধ্যে দিয়ে রেত শরীরে ঠাকুরের পূর্ণপ্রকাশ বিশ্বাস করে না। করে না তাদের আত্মপ্রতিষ্ঠা, একচেটিয়া ক্ষমতা দখল ও মৌরসি পাট্টা বজায় রাখার জন্য।
আজ এই পর্যন্ত। সবাইকে জয়গুরু জানিয়ে আজকের মত আসছি।

No comments:

Post a Comment