পরবর্তী সময়ে যখন দ্বিতীয়বার মহাত্মাজী শ্রীশ্রীঠাকুরের অসুস্থতার খবর শুনে কলকাতায় তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। তখন কথাপ্রসঙ্গে মহাত্মাজী হাসতে হাসতে ঠাকুরকে বলেছিলেন, "আপনার আশ্রম থেকে ফিরে আসার পর একদল লোক এসে আপনার খুব নিন্দা করল, আবার একদল লোক খুব প্রশংসা করল। অথচ উভয় দলেই বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ রয়েছেন"।
ঠাকুর একথা শুনে বললেন - "প্রশংসার কথাতো জানিনা। তবে নিন্দা যদি কিছু শুনে থাকেন তবে ভরসা হয় পরমপিতার কাজ তাহলে একটু আধটু শুরু হয়েছে"। ঠাকুরের কথায় মহাত্মাজী মুগ্ধ হয়ে হাসতে লাগলেন। শেষে বললেন “আপনার সংস্পর্শে এসে দেশবন্ধুর যে অদ্ভুত মানসিক পরিবর্ত্তন সাধিত হয়েছে তা দার্জিলিং এ তাঁর সাথে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি”।
তখন শ্রীশ্রীঠাকুরের বয়স প্রায় ৪০বছর হবে। আর মহাত্মাজীর বয়স ৫৬ বছর। শ্রীশ্রীঠাকুরের চেয়ে মহাত্মাজী ১৬বছরের বড় ছিলেন। তারপর ভারতের বুকে ব'য়ে গেছে অনেক ঘোলা জল। সমস্যার নানা টানাপোড়েনে ওলোটপালোট হ'য়ে গেছে ভারতের মানচিত্র।
কি মধুর সম্পর্ক ছিল উভয়ের মধ্যে। ছিল শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালোবাসার অটুট বন্ধন। কতটা মহাত্মাজীর অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত ছিল, ছিল প্রবল যে শুধু দেশবন্ধুর মত কঠোর যুক্তিবাদী, দুঁদে আইনজ্ঞ, দুরন্ত রাজনীতিবিদের আমূল পরিবর্তন মহাত্মাকে ভাবতে বাধ্য করেছিল দেশবন্ধুর মত এমন প্রবল পরাক্রমশালী আইনি ও রাজনৈতিক সত্ত্বার কি ক'রে আধ্যাত্মিক সত্ত্বায় পরিবর্তন হ'তে পারে, কি সে কারণ, কে সে ব্যক্তি, সেই ব্যক্তির সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হবে। এতটাই মহাত্মাজীকে কৌতুহলী ক'রে তুলেছিল।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে ঠাকুরের কথা। আমাদের সৎসঙ্গীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, "তোমাকে দেখে চিনবে লোকে তোমার ঠাকুর কেমন। তোমাকে বলতে হবে না তুমি সৎসঙ্গী, তুমি ঠাকুরের দীক্ষিত। তোমার জীবন, তোমার কথা, তোমার আচরণ, তোমার আন্তরিকতা, তোমার প্রেম, ভালোবাসা, দয়া, মায়া, স্নেহ, মায়া, মমতা দেখে বলবে লোকে তোমায়, কোথায় গেলে এমন জীবন পাবো? " আজ ভাবি কতটা সত্যি ছিল তাঁর কথা।
শ্রীশ্রীঠাকুরের চাইতে ১৬ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও কি সম্মান শ্রদ্ধা ছিল ঠাকুরের ওপর। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা হওয়া সত্ত্বেও, প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া, বয়সে ১৬বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও সারা ভারত জুড়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ছুটে এসেছিলেন একবার নয়, দু'দুবার ঠাকুরের কাছে। একবার পাবনায় হিমায়েতপুর আশ্রমে, আরেকবার ঠাকুরের অসুস্থতার খবর পেয়ে কলকাতায়। শুধুমাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের কঠোর কঠিন মানসিকতার অদ্ভুত পরিবর্তন মহাত্মাজীকে ঠাকুরের কাছে আকর্ষণ ক'রে এনেছিল, এনেছিল দেশবন্ধুর গুরুদেবকে দেখতে।। কে সে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ববাণ ব্যক্তি যিনি দেশবন্ধুর চেয়ে ১৮ বছরের ছোটো হয়েও দেশবন্ধুর মত দোর্দন্ডপ্রতাপ আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি ও লেখক, দানবীর ইত্যাদি হিসেবে সুপরিচিত দেশবন্ধুর গুরু হ'তে পারেন, এই প্রবল কৌতুহল মহাত্মাজীকে ঠাকুর দর্শনে এনেছিল।
তারপর মহাত্মাজী আর ২৩বছর মাত্র বেঁচেছিলেন। ভয়ংকর উত্তাল রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আর দেখা হয়নি দু'জনের মধ্যে। ঠিক নেতাজীর মত। ৭৯বছর বয়সে ১৯৪৮ সালে মহাত্মাজীর মৃত্যু হয়। তখন ঠাকুরের বয়স ছিল ৬৩বছর। তখন ঠাকুর দেওঘরে। মহাত্মাজীর মৃত্যুর খবর ঠাকুরকে বিরাট আঘাত দেয়। ব্যথিত কন্ঠে মহাত্মাজীর মৃত্যুর (৩০শে জানুয়ারী'১৯৪৮) পরদিন সন্ধ্যায় ১লা ফেব্রুয়ারী ঠাকুর এক মর্মবিদারক বাণী দিয়েছিলেন,
"To shoot Mahatma is to shoot the hearts of all the people-- the lovers of existence; O Thou the great Tapas! bestow thy bliss that resists with every shooting off the evils that obsess, Father the Supreme! pour thy grace on this dumb appeal of human heart."
"যে মৃত্যু মহাত্মাকে গুলিবিদ্ধ করেছে সে গুলি সত্তানুরাগী সবারই হৃদয়কে আবিদ্ধ, বিকীর্ণ ক'রে ফেলেছে। মহাতাপস! তোমার আশীর্বাদ যেন সবারই অন্তর্নিহিত অমঙ্গলকে চিরদিনের মত অবলুপ্ত করে। পরমপিতা! মানুষের এ আবেদন তুমি মংগলে পূর্ণ ক'রে তোল।"
আজ শুধু মনে প্রশ্ন জাগে আর কল্পনার চোখে দেখি, যদি দেশবন্ধু ও মহাত্মাজী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেঁচে থাকতেন বহুদিন তাহ'লে কি হ'তো!? যদি বেঁচে থাকতেন কেমন হ'তো রসায়ন? দেশের বর্তমান অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে চোখ ঝাপসা হ'য়ে আসে।
মহাত্মা গান্ধী ১৯২৫ সালের ১৬ই জুলাই বলেছিলেন তাঁর সম্পাদিত ইয়াং ইন্ডিয়া পত্রিকায় I have seen many greatmen in this world, but have never seen a man with such on extra ordinary powerin all respects and as lovely as SriSriThakur Anukulchandra.
আজ স্পষ্ট দেখতে পাই জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী সত্যদ্রষ্টা পুরুষোত্তম পরমপিতা শ্রীশ্রীঠাকুরের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে বলছেন,
'কিন্তু আমি তাঁর কোন পরামর্শ নিইনি এবং নেওয়া প্রয়োজন মনে করিনি দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে।'
দেশের স্বাধীনতার সময় যখন শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র দেশের প্রায় প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কি করা উচিত আলোচনা করা সত্বেও তাঁর সেই পরামর্শ গ্রহণযোগ্য ব'লে মনে হয়নি দেশ নেতাদের। ভারত ভাগের ব্যাপারে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র যখন দেশের প্রথম সারির নেতাদের কাছে তাঁর ভবিষ্যৎ সাবধান বাণী "Dividing compromise is hatch of the animoysity" (দেশ ভাগ ক'রে হিন্দু মুসলমানের সমস্যার সমাধানের অর্থ তা' দিয়ে দিয়ে শ্ত্রুতার ডিম ফোটানো) পাঠানো হ'লো তখন তাঁর কথা কেউ পাত্তা দেয়নি।
যখন তিনি বাংলা ভাগ যাতে না হয়, হিন্দু মুসলমানের দীর্ঘদিনের একসাথে মিলেমিশে থাকার ঐক্য বিনষ্ট না হয়, অটুট থাকে, হিন্দু মুসলমানের জন সংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখা যায় তার জন্য তিনি সমাধান দিয়েছিলেন সেইসময়ের নেতাদের, হিন্দু মুসলমানের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের, পরামর্শ দিয়েছিলেন জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে, এই নিয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ আলোচনা হয়েছিল ঠাকুরের কিন্তু তখন কেউই তাঁর কথাকে গুরুত্ব বা মূল্য দেননি।
বরং সেইসময় যখন তিনি একার উদ্যোগে বাংলাভাগকে আটকাবার জন্য, হিন্দুমুসলমানের ঐক্যকে রক্ষা করবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন, হিন্দুমুসলমানের সমতা রক্ষা করার জন্য, উভয় সম্প্রদায়ের চিরকালীন মঙ্গলের জন্য, উভয় সম্প্রদায়ের বাঙ্গালীর মধ্যে বহু বছরের যে বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বাঙালি সত্ত্বা, সম্প্রীতি, এক আত্মা বোধ রক্ষা করার জন্য, অটুট রাখার জন্য, যাতে কোনও অবস্থায় দাঙ্গা না বাধে সেইজন্য বহু হিন্দু মুসলমান পরিবারকে বিভিন্ন জায়গার থেকে এনে যেখানে হিন্দু কম মুসলমান বেশী, মুসলমান কম হিন্দু বেশী সমান বসতি স্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, করেছিলেন হিন্দু মুসলমানের জনসংখ্যার ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য। কিন্তু তখন তৎকালীন নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশের প্রভাবশালী নাগরিক কেউই সত্যদ্রষ্টা শ্রীশ্রীঠাকুরকে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেননি। উপরন্তু সেইসময়ের বহু প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাশালী হিন্দু জমিদার তাঁর কাজে বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছিল। ফলে তিনি হিন্দু-মুসলিম সমতা, সম্প্রীতি, ঐক্য রক্ষা, দাঙ্গা আটকানো, দেশভাগ ইত্যাদি সব কাজে ব্যর্থ হন। দেশভাগ ও বাংলাভাগ নিশ্চিত হ'য়ে যায়। দেশ টুকরো হ'য়ে যায়, বাংলা দু'ভাগ হ'য়ে যায়, হিন্দু মুসলমান পরস্পরের দীর্ঘ দিনের একসাথে মিলেমিশে থাকার ঐতিহ্য নষ্ট হ'য়ে যায়। দেশভাগ ও হিন্দু-মুসলমান দুই সম্পদায় পরস্পরের শত্রু হ'য়ে যায় চিরতরে। দীর্ঘ বহু বছরের বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বাঙালি ঐক্য, বাঙালি সত্ত্বা, বাঙালি এক আত্মা ধ্বংস হ'য়ে যায়। দীর্ঘ বহু বছরের এক ঐতিহ্যশালী ইতিহাস ধ্বংসের বীজ বপন হ'য়ে যায়, যা আজ দুই বাংলার সম্পর্কের মধ্যে মহীরূহ হ'য়ে দাঁড়িয়েছে, যা আমরা প্রতিমুহুর্তে যে কোনও বিষয় নিয়ে দুই বাংলার মধ্যে ভয়ংকর বাদানুবাদ দেখতে পায়। ফলস্বরূপ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই এবং আজও ৭৮ বছর পরে সত্যদ্রষ্টা শ্রীশ্রীঠাকুরের ব'লে যাওয়া বাণী "Dividing compromise is hatch of the animoysity" (দেশ ভাগ ক'রে হিন্দু মুসলমানের সমস্যার সমাধানের অর্থ তা' দিয়ে দিয়ে শ্ত্রুতার ডিম ফোটানো) সত্য প্রমাণিত হয়। এর থেকে আজও আমরা দেশবাসী, দেশ নেতানেত্রীরা কোনও শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। ভুলে গেছি ভয়ংকর নিষ্ঠুর অতীত, দেশভাগ, বাংলাভাগের যন্ত্রণা, ভুলে গেছি সত্যদ্রষ্টা ঠাকুরের একক প্রচেষ্টা ও বুকের যন্ত্রণা। ঠাকুরের সোনার সৎসঙ্গীরাও তাই। আমরা সৎসঙ্গীরা ভুলে গেছি বললে ভুল হবে, আমরা অতীত যন্ত্রণাময় ইতিহাস জানিই না।
আজ এই পর্যন্ত। আবার আগামীতে দেখা হবে আপনাদের সাথে। নমস্কার। জয়গুরু।
No comments:
Post a Comment