দ্রুত পা চালিয়ে গলি রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। আর তখনি দেখা হ'য়ে গেল একজন বন্ধুর সঙ্গে যে আমার কাছেই আসছিল ব'লে জানালো। এসেই সাইকেল থেকে হন্তদন্ত হ'য়ে তাড়াতাড়ি নেবে বললো, কি রে এত দেরী হ'লো? কোথায় ছিলি? কি করছিলি এতক্ষণ? তুই জানিস না দাদার কাছে যেতে হবে? সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। একনাগাড়ে কথাগুলি ব'লে থামলো। একটা বিরক্তি অধৈর্যের চিহ্ন ফুটে উঠলো চোখেমুখে। আমি সেদিকে লক্ষ্য ক'রে কিছু না বোঝার ভান করলাম। বললাম, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সবাই কোথায়? ভাবলাম তোরা ডাকতে আসবি তাই------। কথা শেষ করার আগেই বললো, চল চল, দেরী হ'য়ে যাচ্ছে। সবাই দাদার ওখানে অপেক্ষা করছে। আমি ভিতরে ভিতরে চমকে গেলাম। আমাকে ফেলে সবাই দাদার কাছে চলে গেছে? আমাকে কেউ ডাকলো না? আমি এখন ব্রাত্য? গুরুত্বহীন? দাদাই এখন সব? দাদাই এখন নিয়ন্তা? দাদা সমাধান দেবে কে কাল প্রথম চাকরীতে জয়েন করবে আর না করবে!? মনের মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলি প্রশ্নের ডানা ঝাপটে উঠলো, ঝড় উঠলো বুঝি মনে। রাগ, হতাশা এসে ঠুকরোতে লাগলো মনের আঙিনায়। আমি নিজেকে নিজের কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করলাম। তবুও অবাক গলায় ব'লেই ফেললাম, আমাকে ফেলে সবাই চলে গেছে!? আমাকে ডাকলি না!? বন্ধু ইতস্তত ক'রে বললো, ন্ ন্ না, মানে ভাবলাম তুই তো ওখানেই যাবি তাই আমরা ভাবলাম, যাই ওখানে গিয়েই অপেক্ষা করি। আর, তাই ওখানে গিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। গলায় সাফাই ঝড়ে পড়লো।
আর কোনও কথা না ব'লে বন্ধুকে বললাম, তুই যা আমি যাচ্ছি। বন্ধু বললো, সাইকেলে ওঠ তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো। আমি গম্ভীর অথচ স্বাভাবিক গলায় বললাম, তাড়াতাড়ির আর কি আছে? দেরী হয়েছে আর একটু না-হয় দেরী হবে। তুই যা, গিয়ে বল আমি আসছি। আমি হেঁটেই যাচ্ছি। একথা ব'লে বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়ে আমি হাঁটতে লাগলাম।
সাইকেলে আমি উঠতেই পারতাম কিন্তু কেন জানি আজ আর উঠতে ইচ্ছে করলো না। আপন মনে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলাম। রাতারাতি পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত নেবার লোক এবং জায়গা পাল্টে গেল!? এতদিনের বন্ধুদের হঠাৎ অপরিচিত ব'লে মনে হ'লো। মনে হ'লো দাদার ঐ দু'জন আধা অল্প পরিচিত জনের মতো আমার বন্ধুরাও। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আশেপাশের পরিচিত সব লোকজনের আমার দিকে তাকানো দেখে পরিষ্কার মনে হ'লো আমি রাতারাতি আগের থেকে অনেক বেশী লোকের দৃষ্টিতে চলে এসেছি। তবে সেটা ভালো না খারাপ দৃষ্টি তা জানি না। তবে অনেক পড়ে বুঝেছিলাম সেই দৃষ্টির মধ্যে ঘনিষ্ঠ হবার ব্যাপারও ছিল। ঘনিষ্ঠতার কারণ সেই চিরাচরিত নেপোয় মারে দই ব্যাপার। যদি চাকরীর লিস্টে পটিয়ে পাটিয়ে নামটা ঢোকানো যায়।
যাই হ'ক, অবশেষে যখন গিয়ে পৌঁছলাম দাদার ডেরায় দেখলাম প্রতিদিনের মত ভিড় জমে রয়েছে দাদার আশেপাশে। দাদার লোকজন রাস্তার উলোদিকে বেঞ্চ পেতে দলবেঁধে বসে রয়েছে সবাই। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। বন্ধুদের দেখলাম রাস্তার একপাশে গোল ক'রে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বন্ধুরা উৎসাহিত হ'য়ে উঠলো। দাদার লোকজন---- যদিও সবাই আমার পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ---- আমার দিকে সসম্ভ্রমে তাকিয়ে রয়েছে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমাকে দেখেই দাদা জোরে চেঁচিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে ব'লে উঠলো, কি রে বাপি কোথায় ছিলি এতক্ষণ? তুই আসার আগেই তোর বন্ধুরা সব এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে! তারপর বন্ধুদের দিকে দেখিয়ে বললো, এরা সব আমার কাছে এসেছে কেন? আমি দাদার বলার মধ্যে ইঙ্গিতটা ধরতে পারলাম কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাদা আবার বললো, আমি ওদের বললাম, আরে আমার কাছে এসে কি হবে? বাপীর কাছে যা। তোরা কাল কে প্রথমে চাকরীতে জয়েন করবি না করবি আমি কি জানি। বাপীর সঙ্গে আলোচনা ক'রে সব ঠিক কর। তাই ওদের তোকে ডেকে নিয়ে আসতে বললাম। তারপরে বললো, কোথাও গেছিলি? এত দেরী হ'লো? আমি ভাবলাম কি হ'লো না হ'লো তোর মুখ থেকে শুনবো আর ওরা কিনা এসে বলছে, কে কাল আগে জয়েন করবে। আরে কে আগে কে পরে জয়েন করবে তা আমি কি ক'রে বলবো? আমি তো কিছুই জানি না কি হয়েছে না হয়েছে। আগে বাপিকে তো আসতে দে। তা ওরা আমার কাছে সমাধান চাইছে। ব'লে ছোট্ট ক'রে একটা বিড়বিড় ক'রে কি জানি বললো। মনে হ'লো যেন বললো, গদ্দার। আমি কি ঠিক শুনলাম? নাকি মনের ভ্রম?
যাই হ'ক, আমি এতক্ষণ চুপ ক'রে সব শুনছিলাম। তারপর বললাম, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম; মাথা যন্ত্রণা করছিল। তারপরে সকালের সারাদিন অফিসে হেডটাইমকিপারের সঙ্গে কি কথা হয়েছিল সবিস্তারে তা তুলে ধরলাম দাদার কাছে। দাদা শুনে বললো, তুই কি ঠিক করেছিস? আমি বললাম, আমি কিছুই ঠিক করিনি। আপনি যা বলবেন তাই-ই হবে। ব'লে চুপ ক'রে রইলাম। দাদা সঙ্গে সঙ্গে খোলামেলা স্পষ্ট ব'লে উঠলো, আমি কি বলবো? এখানে আমার কি বলার আছে? আমি কি কিছু করেছি নাকি? তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে গলায় বিরক্তি ঝরিয়ে বললো, আমার কাছে তোরা এসেছিস কেন? ব'লে উঠে চলে গেল ভিতরে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। মনে হ'লো যেন ওরা সবাই চুপ ক'রে দাঁড়িয়ে আছে অপরাধীর ভঙ্গিতে। সত্যিই কি অপরাধী? নাকি ভঙ্গিমাতেও নাটক? জানিনা। কিছু বুঝে উঠতেও পারছি না কি করবো, কি বলবো। উঠে পড়লাম তারপর চলে গেলাম একটু দূরে একাকী।
অনেকক্ষণ পর দাদা আমাকে ঘরের ভেতরে ডেকে পাঠালো। আমি ভিতরে গিয়ে দাঁড়ালাম দাদা আমাকে চেয়ার দেখিয়ে বললো্, বস। তারপর বললো, শোন একটা কথা বলবো আমার কথা রাখবি? আমি মনে মনে ভাবলাম, রাখার মতো হ'লে নিশ্চয়ই রাখবো। কিন্তু মুখের ওপর সরাসরি বলতে পারলাম না। চুপ ক'রে রইলাম। আমার চুপ ক'রে থাকা দেখে বললো, কি রে চুপ ক'রে আছিস? কিছু বল? আমি ইতস্তত ক'রে বললাম, ন্ ন্ না, মানে-----। শোন ঐসব মানে টানে ছাড়। আমি যা বলছি শোন। প্রথমে কাল তুই জয়েন কর আর সঙ্গে তোর যাকে মনে হয় সঙ্গে নে। আমি এ কথায় ভিড়মি খেয়ে গেলাম। আমি অবাক হ'য়ে বললাম, আমি!? যেন আকাশ থেকে পড়লাম। আজ লিখতে বসে ভাবি, কতটা বেসামাল আবেগসর্ব্বস্ব ছিলাম সেদিন সেই যৌবনে আমি। সবকিছুতেই যেন লাগামছাড়া ভালোমানুষী! অবাক হওয়ারও একটা সীমা আছে। আমার অবাক হওয়া দেখে একটু বিরক্ত হ'য়ে দাদা বললো, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? আমি কি অবাক হওয়ার মতো কিছু বলেছি? আমি কিছু না ব'লে মাথা নীচু ক'রে রইলাম। লজ্জায় মুখ ফুটে নিজের চাকরীর সমর্থনে সায় দিতে পারলাম না। তখন আমার মনোভাব বুঝতে পেরে তিনি বললেন, তুই বল তোর কি ইচ্ছা। আমি একটু যেন অক্সিজেন ফিরে পেলাম। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আমার যেটা ন্যায্য যুক্তিপূর্ণ ব'লে মনে হয়েছিল সেই নাম দু'টো বললাম। তার মধ্যে একজন আমার বন্ধু আর অন্যজন ছিল দাদার দেওয়া দু'টো নামের একটা। দাদা জানতে চাইলো কেন এদের আমি চাইছি। আমি অন্যদের থেকে তুলনামূলকভাবে এদের দু'জনের প্রয়োজনের কথা বললাম। এর মধ্যে আমার বন্ধুর ছিল একজনের সঙ্গে ভালোবাসা। সেই মেয়েটার বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোর চলছে। পাত্রপক্ষ আসছে দেখতে। এদিকে বন্ধুর অদূর ভবিষ্যতে চাকরীর কোনও সম্ভাবনা নেই। হয়তো মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হ'য়ে যাবে। তাই ওর প্রয়োজন সর্বাধিক। আর, দাদার যে ক্যান্ডিডেট, তার বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। সে বাড়ির সবচেয়ে বড়। সে বাড়িতে থাকতো না। সম্ভবত নকশালী রাজনীতির কারণে এলাকা ছাড়া ছিল। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তার ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে ছিল আমার বন্ধুত্ব। বাড়িতে আর কেউ রোজগেরে ছিল না। আজ আর মনে পড়ে না বাবা-মা ছিল কি ছিল না। তাই আমি তার নামটা দ্বিতীয় নাম হিসেবে ঠিক করেছি ব'লে বললাম দাদাকে।
চুপ ক'রে মন দিয়ে আমার কথা শোনার পরে দাদা কৌতুহলের সঙ্গে আস্তে নীচু গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুই প্রেম করিস? আমি লজ্জা পেয়ে হেসে বললাম, না, না আমার ওসব কিছু নেই। দাদা বেশ ভালোবেসেই বললেন, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই আমার কাছে। আমি ততোধিক জোর দিয়ে বললাম, সত্যি বলছি। তিনি বললেন, তোর দলের সবাই প্রেম করে? আমি বললাম, হ্যাঁ। তুই করিস না কেন? দাদা বললো। এই প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে আমি প্রসঙ্গ ঘুরাবার জন্য বললাম, আমি যে নাম দু'টো ঠিক করেছি তা ঠিক আছে? তিনি বললেন, আমায় লুকোচ্ছিস? আমি বললাম, আমি লুকোলে আপনি ঠিক একদিন না একদিন জানতে পারবেন। তাহ'লে তুই তোর বন্ধুর ভালোবাসার পরিণতি নিয়ে এত চিন্তিত কেন? বন্ধু প্রেম? উদারতা? ভালোমানুষী? পরপর কথাগুলি ব'লে আমাকে ঘাবড়ে দিল। তারপর বললো, যাক্ তুই যা ভালো বুঝিস, কর। তারপর স্বগোক্তির মতো নীচুস্বরে ব'লে উঠলো, পরে না খেসারত দিতে হয়।
এই পর্যন্ত কথা ব'লে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে, বললো, চল বাইরে যায়। ডিসিশানটা জানিয়ে দিই। খেসারত দেওয়ার কথাটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। কেন বললো দাদা এরকম কথা?
বাইরে বেরিয়ে এলাম আমরা। আমার কাঁধে হাত রেখে সবাইকে শুনিয়ে দাদা ব'লে উঠলো, শোন, বাপী আমাকে অনেক বড় উঁচু জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। কথাটা কে বুঝলো আর না বুঝলো জানি না সেদিন আমি ঐ কথার অর্থ বুঝতে পারিনি। অনেক অনেক পরে বুঝেছিলাম সেই কথার অর্থ। ততদিনে দাদা চলে গিয়েছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে আর আমি------। আমি কোথায় পৌঁছেছি সেটা পরবর্তী আত্মকথনে তুলে ধরবো।
তারপরে দাদা ঐ দু'জনকে ডেকে বললো, শোন, তোদের দু'জনের নাম বাপি ঠিক ক'রে দিয়েছে। এখানে আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই। কাল কি করবি আর না করবি, কখন যাবি, না যাবি সব বাপির সঙ্গে কাল সকালে কথা বলে ঠিক ক'রে নিবি। এখন তোরা যা।
সবাই যে যার মতো ফিরে চললো। যে দু'জনের নাম ঠিক হ'লো তারা আনন্দে দাদাকে প্রণাম করতে গেলে দাদা সরে গিয়ে বললেন, আমাকে প্রণাম করছিস কেন? আমি কি করেছি? যদি কৃতজ্ঞ থাকতে হয় তো বাপির কাছে থাকবি। বাপি নিজের দাবী ছেড়ে দিয়েছে তোদের জন্য। কৃতজ্ঞ কি ছিল ওরা? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেটা ফুটে উঠবে আত্মকথনে।
যাই হ'ক, এইকথা শুনে ওরা নীরব রইলো। আমি বললাম, কাল আমার বাড়িতে তোরা সকাল ন'টায় চলে আয়; একসঙ্গে অফিসে যাবো।
সবাই চলে গেলে দাদা আমাকে কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চল, বাড়ি যাবি তো। আর কোনও কথা না ব'লে নীরবে দু'জনে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম। ততক্ষণে সব দোকানপাট বন্ধ হ'তে শুরু করেছে। নিস্তব্ধ হ'য়ে এসেছে চারপাশ। আমার বাড়ির কিছু দূরেই দাদার বাড়ি। বাড়ির কাছাকাছি আস্তেই দাদা বললো, যা, বাড়ি যা। আমি বললাম, আপনাকে একটু এগিয়ে দিই। উনি হেসে বললেন, না রে আমাকে এগিয়ে দিতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো। তুই যা। তবুও কিছু না ব'লে আমি উনার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। রাত হয়েছে, রাস্তা নিস্তব্ধ। দাদাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তারপর ফিরে চললাম নিজের বাড়ির দিকে।
(৩রা জুলাই,২০২৩)
No comments:
Post a Comment