আজ সকাল থেকে পরপর কয়েকটি ঘটনায় মন ডুবে গিয়েছিল বিষণ্ণতায়। যার সংগে কথা বলছি তাকেই দেখছি বিষয়ের মূল থেকে সরে গিয়ে ডালপালা নিয়ে মত্ত। এমনটা যে আজই শুধু ঘটেছে তা নয় এ প্রতিদিনের ব্যাপার। ঘরে বাইরে যে বিষয় নিয়েই আলোচনা হ'ক না কেন আলোচনা মূল থেকে সরে যায় অনেকদূর, মূলে কেউ যেতে চায় না, থাকতে চায় না। সময় নেই কারও অত কথা শোনার কিন্তু চায় চটজলদি জোড়াতালি দিয়ে সমাধান আর ফলস্বরুপ সমাধান আর আসে না কোনোদিনই। আর একটা বিষয়, আলোচনা যখন হয় তখন কেউ কারও কথা শোনে না সবাই ব’লে যায় যে যার মতন সে বুড়ো বাচ্চা যেই হ'ক না কেন। ফলে অবশেষে চুপ ক'রে যেতে হয় মানে মানে নইলে মান থাকে না। যতক্ষণ কথা না বলা যায় ততক্ষণ ভালো আর কথা বলতে গেলেই একটু সময় যেতে না যেতেই শুরু হ'য়ে যায় গন্ডগোল, বিপত্তি। চারপাশ ঘেঁটে ঘ হ'য়ে যায় মুহূর্তে।
এমনই কয়েকটি ঘটনায় বিপর্যস্ত হ'য়ে বিষন্নতায় ভরে গিয়েছিল মন। সকাল সকাল পারিবারিক সমস্যা নিয়ে এসেছিল কয়েকজন আলোচনার জন্যে। ইচ্ছা ছিল না আলোচনায় বসার; আজকাল আর ভালো লাগে না কোনও আলোচনায় বসতে। কারণ আলোচনা মানেই কয়েকজন সীমাহীন ভাঙাচোরা মানুষের উপস্থিতি যারা নিজের বাড়ীর পারিবারিক জটিল সমস্যায় নাজেহাল। তারাই আবার পড়শির উদ্ধারকর্তা!!!!! একজায়গায় কয়েকজনের উপস্থিতি মানেই হাটে পরিণত হওয়া। কথায় আছে সেই 'একে মিনমিন, দু'য়ে পাঠ, তিনে গণ্ডগোল, চারে হাট'। তবু অনিচ্ছাসত্ত্বেও বসতে হ'লো। স্বাভাবিক নিয়মেই আলোচনা শুরু হ'লো; বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, চেষ্টা করেছিলাম ধীরে ধীরে সুতোর গিঁট খুলতে। কিন্তু তা সম্ভব হ'লো না। হ'লো না প্রতিপক্ষের অসহিষ্ণুতার কারণে। যার সমস্যা তারও সময় নেই সমস্যা সমাধানে ধৈর্য ধ'রে সমস্যা জটের গিঁট খোলার আর যারা মধ্যস্থাতাকারী তাদেরও সময় নেই দীর্ঘ সময় ধরে উভয় পক্ষের কথা শুনে সমস্যার গভীরে পৌঁছে সমাধানের সূত্র খোঁজার অথচ বিচারক হ'য়ে বসেছে সমস্যা সমাধানে মানুষের আদালতে। যে দোষ করেছে আর যে দোষ করেনি উভয় পক্ষকেই মেনে নিতে হবে ঝোলের লাউ আর অম্বলের কদু সিদ্ধান্ত। সবাই গোড়া কেটে আগায় জল দিতেই অভ্যস্ত। অত সময় নেই দোষ গুণ বিচার করার। কে দোষী আর কে নির্দোষী ওইসব দেখতে যেও না গুরু। সমস্যা মেটাও। ঠিক এমনি যখন অবস্থা তখনি একজন আচমকা ব'লে উঠলো, জয়গুরু! চলো চলো চলো সব মিটে গ্যাছে। জয়গুরু! জয়গুরু! আজকের মত এখন সব মিটে গ্যাছে। বাকী সব পরে দেখা যাবে। জয়গুরু প্রকাশদা, কি তাই তো? আমি প্রশ্নকর্তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হ'য়ে ভাবলাম, এখানে জয়গুরুর কি হ'লো!? সমস্যা মেটানোর ক্ষমতা কারও নেই শুধু শালা কূটকচালের কুটকুটানি আর অকারণ জয়গুরু ধ্বনি!
বেলা হ'তে দোকানে গেছি কিছু জিনিস কিনতে। গিন্নির নির্দেশ মত কয়েকটা জিনিস পনির, মুগ ডাল, পাউরুটি, বাটার আর হলদিরামের ভুজিয়া আনতে। মেঘলা আকাশ। বেশ ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার উপরে সুর্যিমামার চোখ রাঙ্গানি নেই। তাই প্রসন্ন মনেই গিন্নির কথামত বেরিয়েছিলাম জিনিস আনতে। দোকানে জিনিস নিচ্ছি হঠাৎ কানে ভেসে এলো, জয়গুরু গুরু! ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম আমারই একজন পরিচিত আর একজনকে বলছে কথাটা। উত্তরে অন্যজন বললো, এনজয় গুরু! পরিচিতজন প্রত্যুত্তরে বললো, কবে আর হবে এনজয়, গুরু? আজকের ওয়েদারটা গুরু জয়গুরু ব'লে হ'য়ে যাক সেলিব্রেট। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, শালা সবেতেই জয়গুরু! মালের প্রোগ্রামেও জয়গুরু!? জয়গুরুর আজ এই হাল!!!!!!
কাল সন্ধ্যেবেলা সবে বসেছিলাম চায়ের কাপ হাতে টিভিতে কুঞ্জকলি দেখবো ব’লে। টিভি খুলতেই কানে ভেসে এলো ‘জয়গুরু, জয়গুরু’! এমনিতে টিভি দেখি না, দেখার সময়ও পাই না। মাঝে মাঝে ভালো প্রোগ্রাম বা সিরিয়াল হ’লে দেখি তাও কয়েকটা এপিসোড পরে ইন্টারেস্ট চলে যায়। চুইংগামের মত টানতে থাকে সিরিয়াল তারপর একসময় ছিঁড়ে যায় সিরিয়ালের গল্পের সুর অতএব আর দেখার ধৈর্য থাকে না। ‘কুঞ্জকলি আর রাণী রাসমণি’ সিরিয়াল দেখি, দেখার চেষ্টা করি সন্ধ্যেবেলা। মাঝে মাঝে কাজের চাপে বাদ পড়ে যায়। দুটো সিরিয়ালই এখনও পর্যন্ত দেখার জন্য ধৈর্য নষ্ট হয়নি তবে বোধহয় ‘কুঞ্জকলি’ ধৈর্য নষ্ট ও বিরক্ত উৎপাদনের জন্য ঘুঁটি সাজাচ্ছে। যদি তাই হয় তাহ’লে বোধহয় আরও একটা সিরিয়ালের অপমৃত্যু ঘটতে চলেছে। অকারণ চরিত্র সংযোজনের কি দরকার পড়ে পরিচালকের তা’ বুঝতে পারি না। কুঞ্জকলি সিরিয়ালে একটা বিরক্তিকর বোরিং চরিত্র তান্ত্রিক পিসির হঠাৎ হঠাৎ অকারণ বিদ্ঘুটে গলায় ‘জয়গুরু, জয়গুরু’ ব’লে বিরক্তিকর চীৎকার শালা কান ঝালাপালা ক’রে দেয়। ‘জয়গুরু’ সবার বাপের সম্পত্তি হ’য়ে গ্যাছে নাকি!? মনে হয় তাই। অত সুন্দর সিরিয়ালটার কৈশোরের শুরুতেই বলাৎকার ক’রে না ছাড়লে পরিচালকের চলছে না। শালা সব চার অক্ষর। জয়গুরু কি সস্তা হ’য়ে গেলো!? টিভিতেও দেখেছিলাম ‘এনজয় গুরু’ ব’লে ‘জয়গুরু’র কাউন্টার করতে। ‘জয়গুরু’ আজ খিল্লি হ’য়ে দাঁড়িয়েছে!!!
তারপরে রাতে খাওয়া সেরে কম্পিউটার খুলে বসেছিলাম। ফেসবুকে ‘ভদ্রকালী সৎসঙ্গ কেন্দ্র’ ও ‘খড়দা সৎসঙ্গ কেন্দ্র’ এবং বিভিন্ন কেন্দ্রের পেজ খুলে দেখি কোথায় কে কি মন্তব্য পেশ করেছে, কোথায় কি আপডেট খবর আছে তা জানার জন্য। পেজ খুললেই কমেন্টের ঘরে শুধু ‘জয়গুরু, জয়গুরু, আর জয়গুরু’। কারও কোনও মন্তব্য নেই!!!!!! ঠিক একই রকম পথেঘাটে হাটে বাজারে সর্বত্র দেখা হ’লেই জয়গুরু, জয়গুরু আর জয়গুরু। জয়গুরুর তুফান চলেছে!!!!!!!
এমনি প্রতিদিনই এমন হয়; কাল হয়েছিল, আজ সকালে হয়েছে আর আগামী সকাল, সন্ধ্যে আর রাতেও হবে। এ যেন ট্রাডিশানে পরিণত হ'য়ে গ্যাছে।
চারদিকে পথেঘাটে, চায়ের দোকানে, মোড়ে মোড়ে, সিনেমা, সিরিয়ালে শুধু ‘জয়গুরু’ নিয়ে ঢোল বাজছে ও বাজাচ্ছে আর ইয়ার্কি ছ্যাবলামো হচ্ছে। দীক্ষিত-অদীক্ষিত, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধার্মিক-অধার্মিক সবাই শালা শুধু দেখা হলেই পরস্পর পরস্পরের সাথে বলছে ‘জয়গুরু, জয়গুরু’।
গুরুভাই গুরুভাইয়ের সংগে দেখা হ’লে বলছে জয়গুরু। এটা প্রথা হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সব গুরুর শিষ্যরা পরস্পর পরস্পরকে দেখা হলেই বলে জয়গুরু। একদিন শুনছিলাম একজন নামী প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পী যিনি পরবর্তী সময়ে রাজনীতির জগতে এসে নাম লিখিয়ে এমএলএ ইলেকশানে দাঁড়িয়েছিলেন ও জিতেছিলেন তিনি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় দাবী করছিলেন তিনি যে গুরুর শিষ্য এই ‘জয়গুরু’ সেই সংগঠনের পেটেন্ট!
যাই হ’ক এই ‘জয়গুরু’ শব্দের ব্যাপকতা এমনই যে এই শব্দ শুনলেই লোকে বুঝতে পারে এবং ধ’রেই নেয় এরা সৎসঙ্গী। এই সৎসঙ্গী গুরুভাইয়েরা পরস্পর পরস্পরের সংগে দেখা হ’লেই বলে ‘জয়গুরু’। সেদিন সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে একজন আর একজনকে চীৎকার ক’রে ঠাকুরের কথা বলতে বলতে যাচ্ছে আর আমাকে দেখে চীৎকার ক’রে চলন্ত অবস্থায় চীৎকার ক’রে ‘জয়গুরু’ ব’লে চলে গেল যেন ‘জয়গুরু’ শব্দটা একটা খোরাকের বস্তু! আমি কয়েকজন ব্যক্তির সংগে যাচ্ছিলাম বিশেষ একটা কাজে উত্তরপাড়া থানায়। যাওয়ার পথে এরকম উৎকট ভক্তি দেখে তাদের একজনের মুখ দিয়ে বিরক্তিতে বেরিয়ে এলো, যত্তসব আবাল! খারাপ লাগলো ব্যাপারটা; মনটা বিষন্ন হ’য়ে পড়লো হঠাৎ এমন ঘটনায়। এই যে সৎসঙ্গী গুরুভাইয়েরা পরস্পরের সংগে দেখা হ’লেই ‘জয়গুরু’ বলে এই বলার সময় এরা গুরুর জয় হচ্ছে কি পরাজয় হচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখে না। তোতাপাখির শেখানো বুলির মত শুধু দেখা হলেই বলে ‘জয়গুরু’। জয়গুরুর অর্থ যে “ গুরুর জয় আর সেই জয় আসে যে শিষ্যের জীবনের সার্থক প্রতিফলনে সেদিকে শিষ্যের চোখ নেই, মন নেই নেই কোনও ধ্যান আর জয়গুরু বলার পরমুহূর্তে নিজের চালচলন, হাবভাব, আদবকায়দা, আচারব্যবহার, কথাবার্তা, ভাবনাচিন্তার প্রতিফলনে যে গুরু অসম্মানিত হচ্ছেন, নিন্দিত হচ্ছেন, হচ্ছেন অপমানিত ফলে গুরুর প্রতিমুহূর্তে যে পরাজয় ঘটে চলেছে সেদিকে ধার ধারে না এইসমস্ত আবাল সৎসঙ্গী। ঈশ্বরকে আয়ের উপকরণ বানিয়ে নিয়ে দিব্যি মৌরসী পাট্টা জমিয়ে বসেছে। ঠাকুরকে দাবার ছকের বোড়ে বানিয়ে নিজের বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে হাতিয়ার ক’রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ইষ্টপ্রতিষ্ঠার নামে আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, অর্থ, মান, যশের তীব্র কামনায়। কেউ বা অতিভক্তিতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। বেশিরভাগই সাধারণ বেকুব গুরুভাইবোন ঠাকুরকে কুলুঙ্গিতে তুলে রাখা দুনিয়ার ভগবানের মাঝে, কুসংস্কারের মাঝে বেঁধে ফেলে নিজেকে বেঁধে ফেলেছে অশিক্ষার অন্ধকারে। জানি না এর পরিণতি কোথায়! ঠাকুরের সব ব’লে যাওয়ার পরেও, আচার্য পরম্পরার সাহচর্যে এত শোনার পরেও, বাবাইদাদার নিত্য সত্যকে তুলে ধরার পরেও কোথায় জানি মনে হয় আমরা সবাই ঠিক ক’রে নিয়েছি নিজের বৃত্তি-প্রবৃত্তির ইশারায় আমরা চলেছি, চলছি ও শেষদিন পর্যন্ত চলবোও!!!
( লেখা ৭ই জুলাই, ২০১৮)
No comments:
Post a Comment