Powered By Blogger

Tuesday, June 20, 2023

উপলব্ধি ৪৫

পরিবেশ, বৃক্ষরোপন ও আমরা।

আকাশ কালো মেঘের চাদরে ঢেকে গেছে। এই বুঝি নাবলো অঝোর ধারায়! এখন বৃষ্টি নাবলেই ভয় জাগে। এই বুঝি প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে তছনছ হ’য়ে যাবে চারপাশ। ভেঙে পড়বে বড় বড় গাছ বাড়ীর ওপর, পথের ওপর, ইলেকট্রিক তার, পোস্টের ওপর। গাছ আজ এক ভয়ের ব্যাপার অথচ এই গাছ আমাদের দেয় অক্সিজেন! আবার সেই গাছ হ’য়ে দাঁড়ায় যন্ত্রণার কারণ! কেন!? আসুন একটু পিছন ফিরে দেখা যাক।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে নেওয়া হয়েছিল নানা কর্মদ্যোগ। প্রতি বছর এই দিনটি (৫ই জুন) বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য জল, স্থল, বায়ু সমস্ত কিছুকে দূষণ মুক্ত করার প্রয়াসে বিশ্বজুড়ে নেওয়া হয়েছে, হচ্ছে ও আগামীতেও হবে নানা পদক্ষেপ। যেমন কলে কারখানায় নির্গত ক্ষতিকর গ্যাস, গাড়ির কালো ধোঁয়া, প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার, নদীর জলে নোংরা ক্ষতিকর বর্জ্য, পাহাড় কাটা, গাছ কাটা ইত্যাদি নানা বিষয় আজ পরিবেশ দূষণের ভয়ংকর কারণ হ'য়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে বিশ্বজুড়ে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বৃক্ষরোপণ একটা কর্মসুচী। তাই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে গাছ লাগানোর একটা কর্মসুচী ছিল এলাকায়। টিভিতেও দেখেছি নানা অনুষ্ঠানের ছবি। সেদিন বেড়িয়েছিলাম একটা কাজে। গন্তব্যস্থল খড়দা। আমরা কয়েকজন যাচ্ছিলাম ২৪ তারিখের (২৪/০৬/১৮) ‘বিশেষ সৎসঙ্গ’ সম্পর্কিত আলোচনার জন্য। যাওয়ার সময় দেখলাম পথের ধারে বৃক্ষরোপণের এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে আমার পরিচিত কয়েকজনকে দেখতে পেলাম। যাওয়ার সময় তাদের সংগে চোখাচোখি হ’ল। ভদ্রতাবশতঃ দাঁড়িয়ে দু’এক কথা বললাম। পাশে একজায়গায় দেখলাম কিছু গাছের চারা জড়ো ক’রে রাখা রয়েছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলার পর বিদায় জানিয়ে চলে এলাম। একটা টোটো ধ’রে এগিয়ে চললাম রিষড়া ফেরিঘাটের উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে মনে হ’লো বৃক্ষরোপণের উপকারিতা ও অপকারীতার কথা।
এই বিষয়ে চারপাশের যত্রতত্র বৃক্ষরোপণ মনকে বিব্রত ক'রে তোলে। প্রত্যেক বছর কালবৈশাখীর দাপটে তছনছ হ'য়ে যায় শহুরে সভ্যতা। অন্ধকারে ডুবে যায় শহর, গ্রাম, জনপদ। কেন? দেখা যায় লাইটপোস্টের ঠিক নীচে বা রাস্তার ধারে যেখানে সেখানে গাছ লাগানো হয়েছে বা আপনা থেকেই মাটি ফুঁড়ে উঠেছে। তারপর সেই গাছ বড় হ’তে হ’তে লাইটপোস্ট এবং ইলেকট্রিক লাইনের তার ঢেকে দিয়েছে। গাছের পাতা বা ডালপালা ভেদ ক’রে সেই লাইটপোস্টের আলো এসে পড়ে না আর রাস্তায়। অল্পবয়সী উঠতি ছেলেরা মোড়ে মোড়ে যৌবনের উচ্ছ্বাসে, উৎসাহ ও উদ্দীপনার আতিশয্যে, আবেগে বট অশ্বত্বের চারা লাগিয়ে শিবের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে ধূমধাম ক’রে শিবপূজার আয়োজন করছে আর তারপর সেই চারা জল, আলো ও বাতাস পেয়ে ধীরেধীরে মাথা ছাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার জন্য উঠছে বেড়ে। চারিদিকে ডালপালা ছড়িয়ে সে জানান দিচ্ছে তার বিরাটের উপস্থিতি, বিশালত্বের মহিমা! তারপর দেখা গেল চোখের পলকে সবার অগোচরে সে ঢেকে ফেলেছে মাথার উপরে বিরাট আকাশ, আশেপাশের বাড়িঘর পড়ে গিয়েছে ঢাকা, ইলেকট্রিকের তারের উপর দিয়ে, ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে মোটা মোটা ডাল। অক্টোপাশের মত তার ডালপালা দিয়ে ঘিরে ফেলেছে লাইটপোস্টের মাথা! যান চলাচলের ব্যস্ত রাস্তার পাশে ধর্মের নামে ঈশ্বরের সুড়সুড়িতে শিব কালী শনির মূর্তি বসিয়ে তার পিছনে বট অশ্বত্বের গাছ পুঁতে রাতারাতি ইট বালি সিমেন্ট দিয়ে মন্দির বানিয়ে ফেলেছে আর সেই গাছ একদিন বিরাট মহীরুহ হ’য়ে ধর্মীয় আখড়া বা জাগ্রত মা বা বাবা বা শনিদেবতার পীঠস্থান হ’য়ে গেল! এই যে যেখানে সেখানে জনবহুল রাস্তার ধারে ধারে, মোড়ে মোড়ে, অলিতে গলিতে, লাইটপোস্টের নীচে, ইলেকট্রিক ট্রান্সফর্মারের পাশে ধর্মের নামে, অক্সিজেনের নামে অপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগানো হয় আর তার ফলে যখন ধীরেধীরে বেড়ে ওঠা সেই প্রকান্ড গাছ প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড়ের দাপটে ভেঙে পড়ে রাস্তার উপর, লাইটপোস্টের উপর, ইলেকট্রিক তার ছিঁড়ে যখন আছড়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে, কোনও বাড়ীর উপরে তখন চতুর্দিকের অন্ধকারময় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি পরিবেশের কথা ভাবলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রতিনিয়ত ঝড়ের রাতের ভয়ঙ্কর বিপদজনক দৃশ্য, মনে পড়ে যায় দুঃখজনক, বেদনাদায়ক চোখের জলে ভেসে যাওয়া মায়ের কোল হারানো, স্ত্রীর মাথার সিঁদুর হারানো অন্তহীন ঘটনাবলী।
কেন এর কোনও সমাধান হয় না? কেন হয় না এই অব্যবস্থার কোনও সুরাহা? সমাধান বা সুরাহা হ’তে গেলেই আসবে নানা বাধা। ধর্মীয় বাধা, পরিবেশবিদদের বাধা, সরকারি বাধা, পাড়ার দাদাদের বাধা! হাজার বাধায় বিপর্যস্ত জনজীবন। ঘন্টার ঘন্টা অন্ধকারে বন্দী জীবন। বিদ্যুতের অভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা আলো নেই, জল নেই। প্রচন্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ধর্মের দোহাই দিয়ে ধান্দাবাজ ধর্মব্যবসায়ীরা এবং অন্ধ কুসংস্কারছন্ন ভীরু, মূর্খ, দুর্বল হৃদয়ের ঈশ্বর বিশ্বাসী ধর্মীয় বালখিল্য মানুষেরা এই যত্রতত্র গাছ লাগানোর যে প্রোগ্রাম নিয়ে চলেছে কিম্বা তাকে সমর্থন ক’রে এই অরাজকতার ও অজ্ঞানতার সংস্কৃতিকে পুষ্ট ক’রে চলেছে আজ তা’তে মানুষের জন্য লেখা থাকে ভবিষ্যৎ চরম যন্ত্রণা। এই ধর্মীয় বাধা থেকে মুক্তির উপায় নেই কারণ এই বাধার জন্মদাতা স্বয়ং ঈশ্বর বিশ্বাসী অজ্ঞ, মূর্খ, ভীরু এবং শারীরিক ও মানসিক দুর্বল মানুষ!
পরিবেশবিদদের আবার পরিবেশ রক্ষার বিরাট দায় আছে। যখন তখন যেমন তেমন গাছ কাটা চলবে না। অভিযোগ এলেই হ’লো অমনি তড়িঘড়ি গাছ রক্ষার আন্দোলনে নেবে পড়বে! সরকারী দপ্তরের বাধা তা’তে যোগাবে অক্সিজেন! আর এই আইনি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ময়দানে নেবে পড়ে কায়েমী স্বার্থরক্ষার দালালরা।
আর পাড়ার দাদাদের বাধা? একদিন ছেলের সংগে গিয়েছিলাম এক ইলেকট্রনিক্সের দোকানে কম্পিটারের কিবোর্ড কিনতে। একটা ফ্ল্যাটের নীচে দোকান। পাশাপাশি তিনটে দোকান। ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানের সামনে যখন দাঁড়ালাম জিনিস কিনতে তখন দেখতে পেলাম রাস্তার ধারে ঠিক ফ্ল্যাটের সামনে একটা বড় গাছ। গাছের ডালপালা চারতলা ফ্ল্যাটের সামনের চারদিকে ছড়িয়ে গেছে। একটা ডাল বেঁকে অদভুত ভাবে দোকানের সামনে রাস্তার উপরে রয়েছে। সবচেয়ে অবাক লাগলো যেটা দেখে তা হ’লো গাছটা লম্বা উঠে গিয়ে সামনের তিনতলার ফ্ল্যাটের বারান্দার সামনে ডালপালা ছড়িয়ে ফ্ল্যাটটার ঠিক সামনের দিকটা ঢেকে দিয়েছে; ফলে না নীচ থেকে ফ্ল্যাটের উপরের সামনের অংশ দেখা যায়, না উপরের বারান্দা থেকে নীচে রাস্তার কিছু দেখতে পাওয়া যায়! একটা অদভুত পরিবেশ! কৌতুহলবশত দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এরকমভাবে গাছ যে ঢেকে দিয়েছে বিল্ডিং- এর সামনের অংশটা এর জন্য আপনারা কেউ কিছু বলেন না? দোকানদার সাবধানী ভঙ্গীতে যা বললো তা’তে যা বোঝা গেল তা’ হ’লো এই গাছটা লাগিয়েছে এখানকার ছেলেরা। তারা এই গাছটার একটা ডালও ভাঙতে বা কাটতে দেয়নি আর দেবেও না। আমি বললাম, তাহ’লে আপনারা পৌরসভায় জানান। আমাকে এর উত্তরে দোকানের ভিতর থেকে একজন বললেন, আস্তে বলুন দাদা। তারপর বললো, মিউনিসিপ্যালিটি অফিস থেকে এসেছিল গাছ কাটতে কিন্ত এলাকার দাদারা তা কাটতে দেয়নি!
আমি অবাক হ’য়ে ভাবলাম, এমনও আবার হয় নাকি! পৌরসভারও হাত বাঁধা!? তাদের কোনও অধিকার ও ক্ষমতা নেই শহরকে সুন্দর ক'রে রাখতে ও মানুষকে স্বস্তি দিতে!? বিদ্যুৎ পর্ষদ বা সিইএসসি তাহ’লে কি করতে আছে!? তারা কি করে বা করছে!? ইলেকট্রিক অফিসের কোনও দায়বদ্ধতা নেই!? লাইটপোস্ট, ট্রান্সফর্মার, ইলেকট্রিক তার সবকিছুকে গাছ ঢেকে দিচ্ছে শহরের সর্বত্র অবলীলায় অবহেলায় অথচ কোনও হেলদোল নেই ইলেকট্রিক ডিপার্ট্মেন্টের!? আগাম কোনও পরিকল্পনা নেই!? সরকার কেন অন্ধ!? কেন তারা শহর সৌন্দর্য্যের মিনিমাম যে শর্ত তার জন্য মাথা খাটায় না!? বা খাটালেও (যদি খাটায়) তাহ’লে তৎপরতার সঙ্গে তা কেন বাস্তবায়িত করে না!? তারপর যখন ঝড় তুফানে সব ওলটপালোট হ’য়ে যায়, অন্ধকারে ডুবে যায় শহর গ্রাম তখন শুরু হ’য়ে যায় মানুষের নারকীয় যন্ত্রণা সংগে টিভিতে কাগজে জ্ঞানের আস্ফালন!!!!!
কিছুক্ষণ পর অবাক হওয়ার ঘোর কেটে গেলে কেনাকাটা শেষে দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম আর উপর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঐ উপরের ডালপালায় ঘেরা বারান্দার ফাঁক দিয়ে একজন মানুষের আবছা মুখ দেখা যাচ্ছে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে নীচে রাস্তার দিকে তাকাবার! কিন্তু জানি তা সম্ভব হচ্ছে না! এই অসম্ভব কাজের যারা জনক তারা হ’লো পাড়ার দাদা। এই হ’লো পাড়ার দাদাদের গাছ কাটার বাধা!!!!!!!! কেন!? কেন বাধা!?
এই এত বাধার পাহাড় ঠেলে জানি না কবে কখন সচেতনতার সূর্য উঠবে আম আদমি আর প্রশাসকদের। হয়তো ঈশ্বর জানেন।
( লেখা ২০শে জুন'২০১৮)

No comments:

Post a Comment