Powered By Blogger

Tuesday, June 13, 2023

প্রবন্ধঃ রোগীর মৃত্যু ও ডাক্তার নিগ্রহ!

নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে রোগী মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ডাক্তার নিগ্রহের ঘটনা আজ আর নতুন বা আশ্চর্যের কিছু নয়। বাংলা আর বাঙালির কৃষ্টি-সংস্কৃতি আজ বহুদিন আগেই খিচুড়ি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। টিভিতে যখন দেখি এই বিষয় নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে সবাই তাদের বিভিন্ন মতামতের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেবে পড়েছে ময়দানে তখন ভাবি এই তো কয়েকদিন আগে নির্বাচনকে কেন্দ্র ক'রে কত অপ্রীতিকর, অসুস্থ ঘটনা ঘটে গেল সেই অসুস্থ সংস্কৃতিরই তো ক্রমাগতির প্রতিফলন নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের এই দুঃখজনক ঘটনা! তা নয়কি!? ঈশ্বরের কাছে ডাক্তারের দ্রুত সুস্থতা প্রার্থনা করি। প্রার্থনা করি এই ভয়ঙ্কর ভাঙনের ধ্বংসকৃষ্টি থেকে বাংলাকে রক্ষা করার।
কিন্তু কে রক্ষা করবে? ঈশ্বর কেন রক্ষা করবে? ঈশ্বরের কি দায় পড়েছে? ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তা; তাই? কে মানে? এই ভাঙন ও ধ্বংসের কৃষ্টি-সংস্কৃতির যারা জনক ও যারা অনুগামী তারা মানে? নাকি যারা এই কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রতিবাদে সামিল তারা মানে? যারা মানে তারা ঈশ্বরের সীন-আনসীন যে অস্তিত্বই মানুক না কেন তাঁদের চরিত্র, তাঁদের জীবন, তাঁদের বৈশিষ্ট্য, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, কথা মানে না। নিজেদের স্বার্থেই ঈশ্বরের উপস্থিতিকে, সে জীবন্ত ঈশ্বর হ'ক আর বোবা-অমূর্ত ঈশ্বর হ'ক, ব্যবহার করে। আর যারা প্রগতিবাদী ও অতি প্রগতিবাদী তারা কোনও ঈশ্বরতিশ্বর মানে না, বিশ্বাস করে না। তাই ঈশ্বর নিরুপায়!
তাহ'লে ডাক্তার বা রোগীকে কে রক্ষা করবে?
ডাক্তার নিগ্রহের এই অমানুষিক ঘটনার পিছনের কারণ কি?
আসুন দেখা যাক ঘটনা পর্যালোচনা করে। কারণ হিসেবে যা জানা যায় তা হ'ল বৃদ্ধের চিকিৎসায় গাফিলতি, দেরিতে চিকিৎসা শুরু এবং ইনজেকশন প্রয়োগের পর মৃত্যু। আর এই মৃত্যুই ডেকে আনে গন্ডগোল ও এই মর্মান্তিক পরিণতি। এই যে অসহিষ্ণুতা এর উৎস কি? খবরে যা জানা যায় তাতে মনে হয় এই অসহিষ্ণুতার জন্ম হয় দেড় ঘন্টা রোগীকে নিয়ে হয়রানি ও চিকিৎসা না হওয়া। পরবর্তীতে মৃত্যু এই অসহিষ্ণুতার স্ফুলিঙ্গকে দাবানলে পরিণত করে। আম আদমির মানসিক অস্থিরতা আজ আর নতুন কিছু বিষয় নয়, মানসিক চরম অসহিষ্ণুতা ও অস্থিরতার বারুদের স্তূপের ওপর বসে আছে রাজ্য তথা দেশ! পক্ষ-বিপক্ষ সে যে বা যাই হ'ক!
এই ধরণের ঘটনার জন্য কে বা কারা দায়ী? ডাক্তার? রোগীর লোকজন? প্রশাসন? সরকার? শাসন বা সমাজব্যবস্থা? অসহিষ্ণুতা? অস্থিরতা? ইত্যাদি ইত্যাদি?
জানি না; আমি জানি না। শুধু একটা অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি।
গত রবিবার জামাই ষষ্ঠীর পরের দিন সকালে গুরুভাইদের সঙ্গে বসে জামাই ষষ্ঠীর দিন শনিবার ৮ই জুন'১৯ শ্রীশ্রীবাবাইদাদার ৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত ভদ্রকালী সৎসঙ্গ কেন্দ্র দ্বারা পরিচালিত 'বিশেষ সৎসঙ্গ' নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। সেই সময় স্ত্রী এসে জানালো আমার বৌদির জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! ১০৪ ডিগ্রির উপরে জ্বর! প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি আমার বৌদি গত দু'বছর ধরে বিছানায় শায়িত। প্যারালাইজড। পিয়ারলেস হসপিটালে সেরিব্রাল অপারেশন শেষে আজ বিছানায় শায়িত বৌদি আর পিয়ারলেসের চূড়ান্ত চিকিৎসা খরচায় আর্থিক পঙ্গুতার কারণে শায়িত আজ দাদা ও ভাইপো। এই অবস্থায় ডাক্তারকে ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বড়দা ও বড় বৌদি যান ডাক্তারকে ডাকতে। চেম্বারে ব্যস্ততার কারণে তিনি অসম্মত হন, রোগীকে নিয়ে আসতে বলেন। তাঁকে জানানো হয় রোগীর অবস্থার কথা। অনুরোধ করা হয় আসার জন্য। অনুনয় বিনয় শেষে তিনি আসতে রাজি হন। তিনি আসেন, রোগী দেখেন এবং হাসপাতালে ভর্তি করে দেবার পরামর্শ দিয়ে চলে যান। কোনও চিকিৎসায় করলেন না। এলেন, দেখলেন ও চলে গেলেন। মুহূর্তে ঘটে গেল আসা, দেখা ও চলে যাওয়ার ব্যাপারটা। এই উপস্থিতি স্বরূপ ভিজিট ৫০০টাকা!
তারপর এম্বুলেন্সে ক'রে নিয়ে যাওয়া হ'লো আর জি কর হাসপাতালে। বাইরে প্রচন্ড গরম। দাবদাহে জ্বলে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক-পিঠ! কপালে জল পট্টি দিতে দিতে নিয়ে যাওয়া হ'লো বৌদিকে। হাসপাতালে যাওয়ার পর ডাক্তার দেখলেন, পাঠিয়ে দিলেন ছ'তলায়, লিফটে ক'রে নিয়ে যাওয়া হ'লো সেখানে। সেখানেও ডাক্তার দেখলেন কিন্তু কোনও বেড খালি না থাকায় মাটিতে রাখার কথা বলায় ভাইপো দ্বিধাগ্রস্থ হওয়ায় একজন জুনিয়ার ডাক্তার মাটিতে রাখলে ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানালেন। বরং উত্তরপাড়া এলাকার সরকারী হাসপাতালে রাখার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সিনিয়ার ডাক্তার রোগীকে মাটিতে রাখা না রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা একান্তই পেশেন্টের বাড়ির লোকেদের, সে কথা জানিয়ে বললেন যে, তাঁরা বলবেন না রোগীকে নিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হাসপাতালের অবস্থা দেখে মন চাইলো না এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাটিতে পেশেন্টকে ফেলে রাখার। এত নোংরা চারিদিকে দেখে অবাক হ'য়ে যেতে হয় এ আমরা কোন রাজ্যে বাস করছি! মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, আজ ৭০ বছর পার হ'য়ে গেল দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ পর্যন্ত মিনিমাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আশা করতে পারে না রাজ্যের মানুষ হাসপাতালগুলিতে!? এই নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে যত্রতত্র বিড়াল ঘুরে বেড়ানো পরিবেশে ফেলে রেখে আরও সংক্রামিত ক'রে মেরে ফেলার চেয়ে বাড়িতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুস্থ পরিবেশে মরা ভালো। তখন মনে হ'লো আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর হাসপাতালগুলিতে সাডেন ভিজিট করার কথা! তাহ'লে সেই ভিজিটগুলো কি লোকদেখানো ছিল!? নাকি সেই সৎ উদ্যোগ কায়েমী স্বার্থ রক্ষাকারীদের অসুবিধার কারণ হ'য়ে দাঁড়িয়েছিল!? আর তার ফল স্বরূপ একেবারে খুব কাছের লোকেরা মুখ্যমন্ত্রীকে কানে ফুরফুর দিয়ে দিয়ে সেই সৎ উদ্যোগ থেকে সুকৌশলে সরিয়ে এনেছিল!? কোনটা?
যাই হ'ক আমরা চিন্তা ভাবনা ক'রে ঠিক করলাম এখানে পেশেন্টকে ফেলে রেখে কুকুর বিড়ালের মাঝে ইনফেকশনে আক্রান্ত হ'য়ে মেরে ফেলার চেয়ে নিজের এলাকার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করায় ভালো।
আমরা আবার রওনা দিলাম এম্বুলেন্স ভাড়া ক'রে উত্তরপাড়া জেনারেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে অসুস্থ বৌদিকে নিয়ে। অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকা বৌদির মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না! প্রচন্ড গরমে মনে হচ্ছে আমরা নিজেরাই ঝলসে যাবো সেখানে সেন্সলেস বৌদিকে শরীরের ভিতরের এবং বাইরের প্রকৃতির অসহ্য তীব্র দাবদাহে সহ্য করতে হচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, এ মাথা থেকে ও মাথা, ও মাথা থেকে সে মাথায় ছুটে চলার অন্তহীন কষ্ট!!!!!!
ক্রমশঃ
( লেখা ১৩ই জুন' ২০১৯ )

No comments:

Post a Comment