Powered By Blogger

Thursday, March 9, 2023

প্রবন্ধঃ নির্বাচন, ধর্ম ও ঈশ্বর পূজা।

নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে ততই ধর্মপ্রাণ হ'য়ে পড়ছে সমস্ত দলের প্রার্থীরা। মন্দিরে মন্দিরে সেজে উঠছে বিগ্রহ! মন্দির-মসজিদ-গির্জা ইত্যাদি সব যেখানে যা আছে ছোটো বড় ঠাকুর দেবতার স্থান তা সে দালান হ'ক আর বটতলা হ'ক সেজে উঠছে! সেজে উঠছে নানা রঙে, নানা ঢঙে! বালাই ষাট! ভোট বড় বালাই! বড়ই দায়!

কাল যাচ্ছিলাম গঙ্গার ওপারে লঞ্চে ক'রে খড়দা যাবো ব'লে। একজন খিটকেল মার্কা আধা পরিচিত লোক আমাকে দেখে 'জয়গুরু' ব'লে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাচ্ছি। আমি 'জয়গুরু' ব'লে আমার গন্তব্যস্থল বললাম। সে কথা শুনে সে বললো, 'সৎসঙ্গে'? আমি মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লাম। তারপর একেবারে বিনয়ের সঙ্গে বললো, "দাদা, নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে তত মন্দিরে-মসজিদে-গির্জায় সমস্ত ধর্মস্থানে ঈশ্বরের কাছে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের" এই পর্যন্ত ব'লে একটু থেমে গিয়ে হ্যা হ্যা ক'রে ইঙ্গিতপূর্ণ বাঁকা দৃষ্টিতে হেসে বললো, ------- আটকে যাচ্ছে! আমি শুনেও না শোনার ভান ক'রে একটু বিরক্ত হ'য়ে জোরে পা ফেলে এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে।

আজকাল বেশী কথা বলার ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষ ক'রে 'জয়গুরু' শব্দটা শুনলে সেই লোকের সঙ্গে কথা বলার উৎসাহ উদ্দামতাটা যেন কেমন যেন স্তিমিত হ'য়ে যায়, ঝিমিয়ে যায়! বিশেষ ক'রে সেই সৎসঙ্গীদের মুখে 'জয়গুরু' শুনলে এমনটা হ'য়ে থাকে যাদের দেখে কবি সুকান্তর 'অবাক পৃথিবী' কবিতাটা মনে পড়ে। ভেসে ওঠে চোখের সামনে কবির এই কবিতা লেখার সময়ের মুখটা। বারো লাইনের একটা কবিতায় তৎকালীন মানুষ, মানুষের স্বভাব, সমাজ ও সভ্যতা দেখে তিনি নয় নয়বার অবাক শব্দটা লিখেছেন! বর্তমান সৎসঙ্গীদের দেখে একই রকম অবস্থা আমারও। 'জয়গুরু'-র উত্তরে 'জয়গুরু' বলতে ইচ্ছে করে না। কখনও কখনও সৎসঙ্গীদের 'জয়গুরু'-র উত্তরে মুখ দিয়ে উৎসাহে-উদ্দীপনায় 'পরাজয়গুরু' শব্দটা বেরিয়ে আসে। 'পরাজয়গুরু' শুনে থতমত খেয়ে যায় সামনের জন! অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। পরে মাথা চুলকাতে চুলকাতে চ'লে যায় 'কি হ'লো ব্যাপারটা?' এইভেবে। এরকম ভাবতে ভাবতে কিম্বা মনে মনে একটা জম্পেশ খিস্তি দিয়ে চলে যায়। অনেকে আছে 'পরাজয়গুরু' শুনে 'ব্যাপারটা কি হ'লো? কথাটা কি বললো?' না বুঝেই নিজের ধান্দার উদ্দেশ্যে চলে যায়। আসলে এরা বুঝতে পারা, না পারা সব মানুষেরা ব্যস্ত নিজের বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রবল টানে।

প্রশ্ন জাগতে পারে পাঠক মহলে বিশেষ ক'রে সৎসঙ্গী মহলে, এমন কেন হয়? ঐ খিটকেল মার্কা লোকটাকেই বা 'জয়গুরু' কেন বললাম?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি, এমনটা হয় অর্থাৎ 'জয়গুরু'-র উত্তরে 'জয়গুরু' বলতে ইচ্ছে করে না তার কারণ এখন সব গুরুদের শিষ্যরাই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে দেখা হ'লে জয়গুরু বলে এবং অন্য গুরুর পরিচিত শিষ্যদেরও জয়গুরু বলে। 'জয়গুরু' এখন আর সৎসঙ্গীদের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। 'জয়গুরু' এখন ইউনিভারসাল ওয়ার্ড, আন্তর্জাতিক বা সার্বজনীন শব্দ। 'জয়গুরু' এখন পথ চলতি কথা। এছাড়া 'জয়গুরু' শব্দটা এখন একটা খিল্লি শব্দ হ'য়ে দাঁড়িয়েছে পথেঘাটে একশ্রেণীর ছেলেমেয়ের কাছে এবং টিভিতে অংশগ্রহণকারী 'বি' গ্রেড তথাকথিত সেলিব্রিটিদের কাছে। আর 'জয়গুরু'-র উত্তরে ভেসে আসে তাদের মুখে 'এনজয় গুরু'। আর উৎসাহের সঙ্গে এই 'জয়গুরু' বা 'এনজয় গুরু' বলার ধরণ, তার মুখভঙ্গী, শরীরের ভাষা আজও কানে বাজে, চোখে ভেসে আসে। বিশেষ ক'রে যখন কেউ 'জয়গুরু' বলে।

আর সৎসঙ্গীদের মধ্যে যখন কেউ 'জয়গুরু' বলে তখন তাদের (ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে বেশীরভাগ) প্রতিদিনকার ঠাকুরকে নিয়ে যে জীবন চলনা, যে কপট ভক্তি, কেন্দ্রে কেন্দ্রে যে দুরারোগ্য 'আমি প্রধান, আমি প্রধান' ব্যাধি, যে আচার্য না মানার প্রবণতা কিম্বা লোকদেখানো আচার্য মানার ঠগবাজি, শিষ্য সেজে ঠাকুরকে আয়ের উপকরণ বানিয়ে যে ভক্তিবাজি সেসব দেখে মনে প্রশ্ন জাগে আমরা প্রতিমুহূর্তে আমাদের অসৎ ধান্দাবাজি কপট চলনা দিয়ে, মিথ্যাচার ক'রে ঠাকুরের সঙ্গে যখন বেঈমানি করছি, করছি নেমকহারামী, ঠাকুরের দয়ায় ভরপুর হওয়ার পরও হচ্ছি অকৃতজ্ঞ, কৃতঘ্ন তখনও তাদের 'জয়গুরু'-র উত্তরে আমাকে বলতে হবে 'জয়গুরু'? জয়গুরু মানে গুরুর জয় হ'ক। আমার জীবন যখন বলছে আমি প্রতিমুহূর্তে আমার গুরুর পরাজয়ের ডঙ্কা বাজাচ্ছি, গুরুকে হারিয়ে দেবার পথ প্রশস্থ করছি তখন কি আমার মুখে 'জয়গুরু' বলা শোভা পায়? এটা কি গুরুর সঙ্গে মিথ্যাচার নয়? তাই সেইসমস্ত মিথ্যাচার করা মানুষগুলোর মুখে যখন শুনি 'জয়গুরু' শব্দ তখন এর উত্তরে মাঝে মাঝে বেড়িয়ে পড়ে এককথায় 'পরাজয়গুরু' শব্দ। কারণ গুরুর কি জয় হচ্ছে? গুরুর কি আমাদের কারণে প্রতিনিয়ত পরাজয় হচ্ছে না? এতসব প্রশ্ন করার ইচ্ছে জাগে না।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলতে পারি, ঐ খিটকেল মার্কা লোকটাকে 'জয়গুরু' বলার কারণ আধা পরিচিত লোকটি সৎসঙ্গী নয়। খড়দহে ঠাকুরের কাজে যাতায়াত করার সুবাদে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তেমনি লঞ্চ যাত্রী হিসেবেও দু'পারের ঘাট সংলগ্ন বহু মানুষের সঙ্গে কমবেশি পরিচিত মুখের সঙ্গে দেখা হয়। সামান্য হাসি বিনিময়, হাত দেখানো, ভালো আছি, জয়গুরু ইত্যাদি অল্পবিস্তর হ'য়ে থাকে যাতায়াতের পথে। ঠিক তেমনি পরিচিত, আধা পরিচিত অদীক্ষিত সৎসঙ্গী নন এমন মানুষের মুখে 'জয়গুরু'-র উত্তরে জয়গুরু বলা উচিত ব'লে মনে করি আর তাই বলি। আর আধা পরিচিত বা পরিচিত অদীক্ষিত কারও 'জয়গুরু' বলার সময় অবশ্যই তাদের 'জয়গুরু' বলার ধরণ স্বাভাবিকভাবেই মার্কিং করা হ'য়ে থাকে আর তার উপরই নির্ভর করে জবাব দেওয়া না দেওয়া। যদিও তেমন বিসদৃশ আচরণ করার সুযোগ পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাও থাকে না তাদের। উত্তর দেওয়া-না দেওয়া প্রশ্নকর্তার গ্রহণযোগ্যতার উপর নির্ভর করে।

যাই হ'ক, যতই ঐ খিটকেল মার্কা লোকটার বিদ্রুপাত্মক কথা "দাদা! নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে------------আটকে যাচ্ছে" না শুনে বা না শোনার ভান ক'রে এগিয়ে যায় না কেন ঐ কথাটা কানের মধ্যে বেজেই চলেছে সেদিন থেকে। তাই আজ লিখতে বসলাম মাথা থেকে বোঝাটা নামাবার জন্য।

নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের চরণ পূজার রমরমা নতুন কিছু নয় এটা বরাবরের একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া মাত্র। এটা সবক্ষেত্রেই হ'য়ে থাকে। কি ধর্ম, কি শিক্ষা, কি ক্রীড়া, কি চাকরি, কি ব্যবসা, কি সিনেমা, নাটক, যাত্রা, অভিনয় ইত্যাদি ইত্যাদি সবক্ষেত্রের মত রাজনৈতিকক্ষেত্রেও চরণ পূজার চলন অবিসংবাদিত। ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে এবং কিছু না ক'রে পাওয়ার মানসিকতার মানুষদের কাছে ঈশ্বরের চরণ পূজা হাজার বছরের জন্মজন্মন্তরের আদত। আর যারা ধর্ম মানে না, ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানে না, হিন্দু ধর্মের দেবদেবী নিয়ে কটুক্তি করে, বিকৃত পোষ্ট করে ফেসবুকে যেমন শিবলিঙ্গে কনডোম পড়ানো আবার সেই পোষ্টের পক্ষে দাঁড়িয়ে নানারকম অজুহাত খাড়া ক'রে সাফাই গায় যারা তারা ভুলে যান ফেসবুকে পোষ্ট করা ছবিতে শিবলিঙ্গে কনডোম পড়াচ্ছে যে বুলাদি সেই বুলাদির বিজ্ঞাপন ছিল এইচআইভি আর এইডস সংক্রমণ নিয়ে। সরকারি এই অ্যানিমেটেড চরিত্রটি এইচআইভি আর এইডস সংক্রমণ নিয়ে অবিরাম সচেতনতার বার্তা বিলিয়ে চলতেন ১৯৯৮ সাল থেকে ৷ তাহ'লে কি শিবলিঙ্গ এইচআইভি আর এইডস সংক্রমণ ছড়ায় যার জন্য অ্যানিমেটেড চরিত্র বুলাদিকে দিয়ে ঐ লিঙ্গের মাথায় কনডোম পড়াতে হ'লো অভিনেত্রী তথা নির্বাচনী প্রার্থী সায়নী ঘোষকে!? কি বলেন অভিনেত্রী সায়নী ঘোষের ঐ বুলাদিকে দিয়ে শিবলিঙ্গের মাথায় কনডোম পরানো পোষ্টের স্বপক্ষে বিশ্লেষণকারীরা? ভোটের লড়াইয়ে জেতার জন্য সেই ইশ্বরকে না মানা, ধর্মকে না মানা অবিশ্বাসীরা, বামপন্থীরা লুকিয়ে বাড়িতে পুজো দেয়, ঈশ্বরকে কলঙ্কিত করতে বুক ও হাত পা না কাঁপা অভিনেত্রী ও অন্য মানুষেরা আবার মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে নির্বাচনী প্রচারের যাত্রা শুরু করে। সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঈশ্বরকে নিয়ে ল্যাজেগোবরে হ'তে এদের লজ্জা লাগে না, দ্বিধা করে না। এরা ঈশ্বরের চলন পুজোর ধার ধারে না। এদেরই বা দোষ কোথায়? এরা তো এদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকেই এই শিক্ষা পেয়ে এসেছে। ভালো শিক্ষা থেকে খারাপ শিক্ষার সংক্রমণ বেশী ও দ্রুতগতিতে ছড়ায় এবং ছড়ায় তা বংশ পরম্পরায়। তাই সাবধান হ'তে হয়, সাবধান থাকতে হয়। পরবর্তী বংশধর, পরবর্তী প্রজন্ম এই লিঙ্গে কন্ডোম পরানো ছবি দেখে দেখে শিখে যায় লিঙ্গ কি? লিঙ্গের কাজ কি? লিঙ্গ দিয়ে কি হয়? লিঙ্গে কেন কনডোম পরানো হয়? লিঙ্গে কনডোম পরালে কি হয়? বুলাদি কে? বুলাদি কেন লিঙ্গে কনডোম পড়ালো? কনডোমের সাফল্য কিসের ওপর নির্ভর করে? এরকম হাজারো প্রশ্ন নিয়ে বড় হবে আগামী বংশধর, আগামী প্রজন্ম।

ঠিক তেমনি সৎসঙ্গীদের কাছেও (ব্যতিক্রম আছে। ব্যতিক্রম ব্যাতিক্রমই আর ব্যতিক্রমরাই ঠাকুরের আশা) ফুল বেলপাতা ঘট ধুপধুনো প্রদীপ চন্দন তুলসীই ইত্যাদি সেই শেষ কথা। এইসমস্ত উপকরণ সাথে সেই পুরোহিত প্রথার মাধ্যমে সৎসঙ্গীদের মন্ত্র পাঠ, সেই পাঁচালি পাঠ সহযোগে আকুতি ভরা হৃদয়ে সেই চরণ পূজার হাজার রকম রকমারিতে সেজে উপেক্ষার হৃদয় দিয়ে চলন পূজার জলাঞ্জলি দিয়ে ঠাকুরের মনের মত সোনার মানুষ হ'তে গিয়ে আমরা তাঁর সোনার সৎসঙ্গীরা হ'লাম গরু।

আসলে চলন পূজার ধার কেউ ধারে না। শুধুই মিথ্যাচার আর ঢাকঢোল পিটিয়ে চরণ পূজা! চরণ পূজা!! চরণ পূজা!!!
( লেখা ১০ই মার্চ'২০২১)

All r

No comments:

Post a Comment