আজ দোলপূর্ণিমা। এ'কে ফাল্গুনীপূর্ণিমাও বলা হয়। এই দিন পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে তাঁর ভক্তদের সংগে রং খেলেছিলেন। সেই থেকেই রং বা দোল খেলা শুরু হয়। এ'কে হোলিও বলা হয়। উত্তর ভারতে আগামীকাল হোলি উৎসব পালন করা হবে। ভারতে বিভিন্ন ভাবে এই উৎসব পালন করা হ'লেও মূল অর্থ এক আর তা'হ'ল শ্রীকৃষ্ণকে জড়িয়ে ভজন আর ভোজন।
আবার এ'কে বসন্তোৎসব বলা হ'য়ে থাকে। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই এই উৎসবের শুরু। শান্তিনিকেতনে নাচ গানের আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এই বসন্তোৎসব পালন করা হয়।
হোলি উত্তর ভারতে দোলের পরদিন অনুষ্ঠিত হয়। ঠিক তেমনি দোলের আগের দিন গাছের শুকনো ডাল, পাতা, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে আগুন জ্বালানো হ'য়ে থাকে তাঁকে আগুনের উৎসব বা বহ্ন্যুৎসব বলা হয়। এই আগুন জ্বালানোর খেলাকে বাচ্চাবুড়ো সবাই নেড়াপোড়া ব'লে উপভোগ করে। দোলের কয়েকদিন আগে থেকেই ছোট ছোট ছেলেরা প্রবল উৎসাহে বহ্ন্যুৎসবের সামগ্রী যোগার করতে থাকে। তারপর দোলের আগের দিন ছোট, বড়, মাঝারী নানা আকারে বিভিন্ন জায়গায় এই আগুন উৎসবে মেতে ওঠে মানুষ। আগুন যখন লকলক ক'রে ক্রমশঃ উঁচু থেকে উঁচুতে উর্ধ্ব আকাশের দিকে ধাবিত হ'তে থাকে তখন নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে ও ঐ দৃশ্য উপভোগ করে আবালবৃদ্ধবনিতা।
একেই কি বলে আগুন নিয়ে খেলা!? এইভাবেই কি নিজের অজান্তে নির্মল আনন্দের আড়ালে আগুন নিয়ে খেলার প্রবৃত্তি চুপিচুপি মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় ও ভয়ঙ্কর ভাবে অন্যরুপে আত্মপ্রকাশ করে গ্রাম থেকে শহরে, নগরে, বন্দরে আসমুদ্রহিমাচলব্যাপি!?
এই আগুন খেলার আরও একটা মানে আছে। একে যেমন বহ্ন্যুৎসব বা আগুন উৎসব কিম্বা নেড়াপোড়া বলে আবার এই উৎসবকে হোলিকাদহনও বলা হয়। হোলিকাদহন অর্থাৎ হোলিকাকে পোড়ানো। হোলিকা কে বা কি? হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দিতির কন্যা আর হিরণ্যকশিপু ছিল তাঁদের পুত্র। হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার বর লাভ করেছিলেন। সেই বরে অহংকারী হিরণ্যকশিপু দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। প্রহ্লাদ ছিল তাঁর পুত্র। তিনি বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। হিরণ্যকশিপু বিষ্ণুকে মানতেন না তাই ক্রূদ্ধ হ'য়ে তিনি প্রহ্লাদকে মেরে ফেলার জন্য ভগ্নী হোলিকাকে আদেশ দেন। হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে ক'রে আগুনে প্রবেশ করলে সেই আগুনে পুড়ে হোলিকার মৃত্যু হয় এবং বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ রক্ষা পান। দোলের আগের দিন এই বহ্ন্যুৎসব অর্থাৎ আগুনের উৎসবকেই হোলিকাদহন বলা হয়।
যাই হ'ক এই দোলপূর্ণিমাকে গৌরপূর্ণিমাও বলে। কারণ এই পূর্ণিমা তিথিতেই বিশ্বব্রহ্মান্ডের মালিক পরমপিতা পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীচৈতন্য বা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্ম হয়েছিল। সেই হিসেবে আজকের এই দিনটি অতি পবিত্র দিন।
আজকের দিনে মহাপ্রভুর মন্দিরে কম বেশী তাঁর জন্মদিন পালন হয়। কিন্তু তার চেয়ে আজকের দিন বেশী পরিচিত ও প্রচলিত রং খেলাকে ঘিরে। রং খেলাকে ঘিরে মেতে ওঠে মানুষ, মেতে ওঠে দিকে দিকে শান্তিনিকেতনি ঢঙে। কিন্তু সেই উন্মাদ সদৃশ মেতে ওঠার কোথাও সৃষ্টিকর্তার মানুষ রূপে আগমনের উল্লাসের ছিটেফোঁটাও নেই। সেখানে আজকের দিনে স্বয়ং ঈশ্বরের আবির্ভাব গৌণ, ব্রাত্য!!!!! তাঁকে নিয়ে নেই কোনও মাতামাতি, নেই কোনও স্মরণ উৎসব, নেই কোনও দেশজুড়ে আনন্দউল্লাস!!!!! শয়নে, স্বপনে, জাগরণে কোথাও তাঁর জায়গা নেই তাঁর সন্তানদের হৃদয়ে। নেই কোনও স্মরণ, মনন, চিন্তন!!!!! দেশজুড়ে নেই কোনও তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি!!! নেই কোনও রক্তমাংসসংকুল বিশ্ববিধাতার প্রচার, প্রসার!!! হৃদয় জুড়ে শুধু রং খেলার নামে বৃত্তি প্রবৃত্তির রং খেলার উন্মাদনা ও সুড়সুড়ি আর সুরার দাপাদাপি আর সুরার রসে মত্ত হোলি ভক্তের আসুরিক হুঙ্কার!!! এটাই দোলপূর্ণিমার বিশেষত্ব!
বাঃ!!!! চমৎকার!!!! চমৎকার মানবকুল ও তাদের আচার বিচার!!!! হে জীবন্ত ঈশ্বর! হে পরমপিতা আমরা তোমার অভাগা, দুর্ভাগা সন্তান, আমাদের তুমি ক্ষমা ক'রে দিও। কারণ ক্ষমাই যে ঈশ্বর!!! তাই নিশ্চিত, তুমি আমাদের ক্ষমা করবেই করবে।
বিশ্বব্রহ্মান্ডের মালিক, পরমপিতা, সৃষ্টিকর্তা পরমপ্রেমময় রক্তমাংসসংকুল আমান ঈশ্বর নীরবে নির্জনে গোপনে চোখের জল ফেলেন আর ভাবেন, এই জন্যই বুঝি বলে, "পঞ্চ ভূতের ফাঁদে ব্রহ্মা পড়ে কাঁদে।" ঠিক তেমনি ভক্তকুলের ফাঁদে পরমপিতা কাঁদে।
(লেখা ১লা মার্চ'২০১৮)
No comments:
Post a Comment