Powered By Blogger

Friday, March 17, 2023

প্রবন্ধঃ মানুষ-১

সেদিনটা ছিল শনিবার। ব্যাংকের কাজে যেতে হয়েছিল কলকাতা। পার্ক স্ট্রীটের জীবন দীপ বিল্ডিংয়ের এস বি আই শাখা ছিল গন্তব্যস্থল। দুপুরবেলা বেরিয়ে ছিলাম। পাঁচটার মধ্যেই ফ্রি হ'য়ে গিয়েছিলাম। কাজ শেষে গিয়েছিলাম এক্সাইড মোড়ের হলদিরামে। সঙ্গে ছিল পরিবার। ছেলে-মেয়ে-বউ আর ছিল আমার ভাইপোর ছোট্ট ১০বছরের নাতনি। আমি সচরাচর কোথাও যাই না কিন্তু এরকম অল্প সময়ের কোনও কাজে বেরোলে আর সেদিন যদি বাড়িতে সবাই থাকে তখন একসঙ্গে বেরোনো হয়। ছেলেমেয়েরা জোর করে বেরোবার জন্যে কিন্তু রাস্তাঘাটের ঝামেলা, প্রতিনিয়ত যানজট, অকারণ হঠাৎ হঠাৎ মিছিল-মিটিং ইত্যাদির কারনে বাইরে বেরোনোর ইচ্ছেটাই ম'রে গ্যাছে তবে ঠাকুরের কাজে বেরোতে দ্বিধা করি না। আর যদি বেরোয় তাহ'লে সঙ্গে ওই নাতনি থাকবেই।

যাই হ'ক ব্যাংকের কাজ শেষে পড়ন্ত বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় হলদিরামের দোকানে সিঙ্গাড়া, ঢোকলা, পাপরিচাট, মিষ্টি, আইসক্রিম ইত্যাদি খেয়ে (যদিও আমি একটা সিঙ্গাড়া খেয়েছিলাম মাত্র; আজকাল ভয় লাগে খেতে কিন্তু লোভ আছে ষোলআনা) যখন বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ির দিকে এগোচ্ছি তখন নাতনি বললো, তার গা বমি বমি করছে। গাড়িতে আসবার সময় একবার বলেছিল তার শরীরটা কেমন কেমন করছে, বলেছিল এসি বন্ধ ক'রে দিয়ে জানলা খুলে দিতে তখন অতটা বিষয়টা গ্রাহ্য করিনি। আসলে ওর ওই গাড়ির জানালা বন্ধ জায়গা ভালো লাগে না। যাই হ'ক ব্যাপারটা তখন সেরকম কোনও অসুবিধার কারণ ঘটায়নি কিন্তু এখনকার ব্যাপারটা মনে হ'লো আলাদা। গা গুলিয়ে উঠছে দেখে একটা ছোট স্প্রাইট কিনে দিলাম। তারপর হাঁটতে লাগলাম গাড়ির দিকে। একটু পরেই দেখলাম আমার নাতনি নিজের থেকে এগিয়ে গেল রাস্তার একটা কোনায় আর সেখানে গিয়ে বমি করতে লাগলো। আমি তাকে বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। তারপর তার বমি বন্ধ হ'য়ে গেল। বললো, দাদাই এখন ভালো লাগছে। মুখে তার হাসি ফুটে উঠলো। দেখলাম বমিতে কিছুই নেই; যা বেরিয়েছে মনে হ'লো আইসক্রিম সব বেরিয়ে গ্যাছে।

এবার আসি আসল কথায়। এরকম এক অবস্থায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই অবস্থায় একটু জল পেলে ভালো হ'তো কিন্তু কোথায় জল পাবো! ভাবছিলাম তাহ'লে রাস্তার ধারে রেস্টুরেন্ট গুলোতে আমাকে যেতে হয়। ঠিক এরকম অবস্থায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর মাঝখান থেকে বেরিয়ে এলেন একজন মানুষ! কাছে এসে বললো, একটু জল দেবো? তাঁর দিকে তাকিয়ে মনে হ'লো যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক দেবদূত! আমি এই অসহায় অবস্থার মধ্যে যেন মনে হ'লো হাতে চাঁদ পেলাম! বললাম, হ্যাঁ একটু দিন না। ভদ্রলোক গাড়ির দরজা খুলে একটা জলের বোতল বের ক'রে আমার হাতে দিল। আমি সেই বোতলের জল দিয়ে আমার নাতনির চোখেমুখ ভালো ক'রে ধুয়ে দিলাম তারপর কুলকুচি ক'রে মুখ ধুয়ে নিয়ে একেবারে ফ্রেস হ'য়ে গেল। তারপরে হাসি মুখে বললো, দাদাই, আমার এখন ভালো লাগছে। আর জল লাগবে না। আমি বোতলটা ভদ্রলোকের হাতে ফিরিয়ে দিলাম। কৃতজ্ঞতা জানাবার সেই মুহূর্তে ভাষা খুঁজে পেলাম না। শুধু খুব আন্তরিকভাবে হাসিমুখে বললাম, ধন্যবাদ। ভদ্রলোক জবাবে শুধু একটা নির্মল হাসি ফিরিয়ে দিলেন। আমরা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। গাড়িতে উঠে বসে যখন গাড়ি ঘুরিয়ে ওই ভদ্রলোক যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর পাশ দিয়ে যাবার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা হ'লো আমি হাত তুলে তাঁকে বুক ভরা অভিবাদন জানালাম আর আমার নাতনি তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে হাত নাড়লো। তিনিও প্রত্যুত্তরে হাসিমুখে হাত নাড়ালেন। গাড়ি ধীরে ধীরে তাঁকে পেরিয়ে এগিয়ে গেলো আর ছুটে চললো বাড়ির দিকে।

ফিরতে ফিরতে শুধু মানুষটার মুখটা ভেসে উঠছিল। ভাবছিলাম, মানুষ মানুষের জন্যে কথাটা মিথ্যে নয়! পরমপিতার শ্রীচরণে তাঁর সর্বাঙ্গীন মঙ্গল প্রার্থনা করলাম। আর সেদিন কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছিলাম না কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল মনের মধ্যে আর তাই আজ লিখে ফেললাম সেদিনের দেখা মানুষটার কথা। অল্প সময়ের জন্য পুরো মনটা কেড়ে নিয়েছিল যে মানুষটি তাঁর কথা লিখে মনটা জুড়িয়ে নিলাম মাত্র। জানি না এই লেখা তাঁর চোখে পড়বে কিনা!
( লেখা ১৮ই মার্চ' ২০১৯ )

No comments:

Post a Comment