কাল একটা সৎসঙ্গে গিয়েছিলাম। ভাদ্রমাস। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের জন্মমাস। তাই সারামাস ব্যাপী চলছে সৎসঙ্গ। এটা এখন কালের প্রবাহে সৎসঙ্গের পবিত্র চল বা রেওয়াজ হ'য়ে দাঁড়িয়েছে। এই মাসে সৎসঙ্গীরা ঘরে ঘরে সৎসঙ্গ দেয়। তাদের প্রায় সকলেরই ভাদ্রমাসে সৎসঙ্গ দেওয়ার মানসিক ইচ্ছা ও ধারণার সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে একাদশী বা পূর্ণিমা তিথিতে সত্যনারায়ণ পুজোর সঙ্গে। যে কোনও দিনেই সত্যনারায়ণের পুজো করা যায়। তবে একাদশী ও পূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের পুজো করা বিশেষ শুভ বলে মনে করে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। ঠিক তেমনি সৎসঙ্গীরা সারা বছর সৎসঙ্গ পালন করলেও শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মমাস ভাদ্র মাসে সৎসঙ্গ দিয়ে বিশেষ একটা আনন্দ ও তৃপ্তি অনুভব করে। যেন এ মাসে সৎসঙ্গ দিলেই ঘরের সব রোগ, শোক, গ্রহদোষ, বুদ্ধি বিপর্যয় ও দারিদ্রতা শ্রীশ্রীঠাকুরের অপার দয়ায় খন্ডন হ'য়ে যাবে আর না দিতে পারলে একটা অতৃপ্তি থেকে যাবে।
তবে বর্তমানে এটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে সৎসঙ্গের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তা গৌণ ও মূল্যহীন হ'য়ে পড়েছে সৎসঙ্গীদের কাছে। সৎসঙ্গ যে দেড় ঘন্টা থেকে দু'ঘন্টার একটা স্কুলিং সেটা ভুলেই গেছে; বিশেষ ক'রে এই ভাদ্র মাসে। যেনতেনপ্রকারেণ ভাদ্রমাসে সৎসঙ্গ দিতেই হবে তা' সে যখনই বা যে সময়ই হ'ক না কেন। কারণ হাতে বরাদ্দ মাত্র এই পবিত্র মাসের ৩১টি দিন। ফলে সকাল থেকে শুরু হয়ে যায় সৎসঙ্গের আয়োজন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে ভাদ্রমাসে সৎসঙ্গ বাড়ি বাড়ি। ঠিক যেন সরস্বতী বা লক্ষী পুজোর দিনের মতো। আর ঋত্বিকেরাও হ'য়ে যান পুরোহিতদের মতো। একটা বাড়িতে শেষ করেই দৌড় লাগান দলবল সমেত কিংবা একা অন্য আর এক বাড়িতে। ভাদ্রমাসে লক্ষী পূজা বা সরস্বতী পূজার দিনের পুরোহিতদের মতো ঋত্বিকদের গুরুত্বও বেড়ে যায় এই মাসে। যদিও এখন ঋত্বিক ছাড়াও সৎসঙ্গ আয়োজন করা যায় সৎসঙ্গে উপস্থিত বয়োজ্যেষ্ঠ, সম্মানীয়, প্রবীণ, গুণী, ঠাকুর ও ঠাকুর দর্শন সম্পর্কে অবহিত ইষ্টপ্রাণ সৎসঙ্গী দ্বারা। ঋত্বিক ছাড়া সৎসঙ্গ হয় না এ ধারণা খারিজ। এটা বর্তমান আচার্যদেবের নির্দেশ। কিন্তু সেটা সাধারণ সৎসঙ্গীরা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। আর বুঝে উঠলেও তাদের বক্তব্য কেন্দ্র মন্দিরের কর্তাব্যক্তিদের নিয়েই তাদের চলতে হবে। নতুবা সৎসঙ্গ হবে না। ফলে বহু বাড়িতে সৎসঙ্গ বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবর্তে মূর্তি পূজার প্রচলন বেড়েছে। তাদের অসহায় বক্তব্য কিছু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান তো করতে হবে বাড়ির মঙ্গলের জন্য!
একদিকে ডি পি ওয়ার্কের মাধ্যমে চলছে ছিন্ন হ'য়ে যাওয়া সম্পর্ককে জোড়া লাগানোর নয়া উদ্যোগ, উৎসাহ, উদ্দীপনা ও তীব্র প্রচেষ্টা একই সঙ্গে অন্যদিকে চলছে দূরে সরে যাওয়ার প্রবণতা। এই প্রবণতার পিছনে আছে সৎসঙ্গীদের ও ঋত্বিকদের আত্মপ্রতিষ্ঠার ভয়ংকর বিষাক্ত বিষের ক্রিয়া।
যাই হ'ক, পুরুষোত্তম পরমপিতা জীবন্ত ঈশ্বর জীবন্ত নারায়ণ শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রও ভাদ্রমাসে অমূর্ত ভগবান, আকাশের ভগবান, বোবা ভগবান ও মূর্তি পূজার স্ট্যান্ডার্ডে নেবে আসে। তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন উচ্চ আদর্শ, তাঁকে ও তাঁর চলনকে মাথায় নিয়ে যে চলতে হবে, তাঁর চলন দিয়ে নিজের চরিত্রকে গড়ে তুলতে হবে এইসব কথা বা ধারণা এখন ব্রাত্য। পরিবর্তে সত্য নারায়ণ কিংবা শনিপূজার মত ভাদ্রমাসে শ্রীশ্রীঠাকুরের পুজা হয় ঘরের মঙ্গলের জন্য। আর এই ট্রাডিশান শ্রীশ্রীঠাকুরের সব রূপের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যেমন শ্রীশ্রীরামের চৈত্রমাস, শ্রীশ্রীকৃষ্ণের ভাদ্রমাস, শ্রীশ্রীবুদ্ধের আষাঢ় মাস ইত্যাদি।
এখন আসি কালকের সৎসঙ্গের কথায়। যে বাড়িতে সৎসঙ্গ সেই বাড়িতে গিয়ে দেখলাম তখনও কেউ আসেনি। সময় ঘোষণা করা ছিল ৭টা ১৫মিঃ-এ সৎসঙ্গ শুরু হবে। কিন্তু অন্য জায়গায় সৎসঙ্গ থাকার কারণে তখনও কেউ এসে পৌঁছতে পারেনি সৎসঙ্গীরা। আমার পরিবারের বৌ, বৌদি, ছেলে আর আমার ছোট্ট সোনাবাবা যারা আমার সঙ্গে গিয়েছিল সবাই সৎসঙ্গের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে রইলাম। ঠাকুর সাজানোটা ভুল হওয়ায় সেটা ঠিক ক'রে দিল আমার স্ত্রী। তারপর ঋত্বিক এলেন; সঙ্গে একে একে সৎসঙ্গী দাদা ও মায়েরা আসতে লাগলেন। ঘর ভর্তি হ'য়ে গেল। বুঝতে পারলাম আগের সৎসঙ্গ শেষ হয়েছে তাই সবাই আসছে। গৃহকর্তার ভাই এসে ঋত্বিকের বসার জন্য আলাদা আসন বিছিয়ে দিল। তিনি তার ওপর পরিপাটি ক'রে বসলেন। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের ক'রে রাখলেন শ্রীশ্রীআচার্যদেবের আসনের পাশে। প্রার্থনা দিয়ে সৎসঙ্গ শুরু হ'লো।
প্রার্থনা চলাকালীন কার যেন ফোন বেজে উঠলো। প্রার্থনা চলেছে সঙ্গে বেজে চলেছে ফোন। তারপর ভেসে এলো কথা বলার শব্দ। চোখ মেলে দেখলাম ঋত্বিক ফোনে কথা বলছে। কথা বন্ধ হওয়ার পর শ্রীশ্রীআচার্যদেবের পাশে রাখা বোতল থেকে জল খাচ্ছে আবার আসনের পাশে রেখে দিচ্ছে। ঋত্বিকের পাশে আর একজন দেখলাম ফোনে কথা বলা শুরু করলো। তারও কথা বলা শেষ হ'লো। আমার পাশে যে বসেছিল সে দেখলাম প্রার্থনার মধ্যেই যারা ঢুকছে তাদের বাইরে থেকে ভিতরে আসতে বলছে। প্রার্থনা করতে করতেই দেখলাম ঋত্বিকের পেছনের দিকে বসা ব্যক্তিরা মাথা নাবিয়ে নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কি যেন কথা বলছে আর মাঝে মাঝে একে তাকে পিছনে বসা ব্যক্তিকে সামনে ডেকে নিচ্ছে। এমনিভাবেই প্রার্থনা শেষ হ'লো। ঘোষণা হ'লো নামের। নাম চলতে চলতে ভেসে এলো সেই ফোনের আওয়াজ আর কথাবার্তা। কথা হ'লো শুরু, আর নামের হ'ল কাম সারা।
তারপর শুরু হ'লো সঙ্গীতাঞ্জলী। প্রথমে এক মা গাইলেন। তারপরে আমার স্ত্রীকে গান গাইতে বললেন ঋত্বিক। গান শুরু করার সময় ঋত্বিকের ফোন এলো, তিনি কথা শেষ করতেই পাশে আর একজন ফোনে কথা শুরু ক'রে দিলেন। স্ত্রী তার মধ্যেই গান শুরু করতে গেলে আমি তাকে ফোনে কথা শেষ হওয়ার পরে গান শুরু করতে বললাম। আমার ওপর অসন্তুষ্ট হ'লো ফোনে বাক্যালাপ করা ইষ্টপ্রাণ সৎসঙ্গীরা। কথা শেষ হওয়ার পর স্ত্রী গান শুরু করলো। গান শেষ হ'লে কীর্তন শুরু হ'লো। পরপর তিনটে কীর্তন হ'লো। একটা কীর্তন প্রাণ মাতানো হ'লো আর বাকী দু'টো ঠিক কি হ'লো বুঝলাম না আর তার মাঝে মাঝেমাঝেই চললো ফোনে কথা। এবার পিছনের দিকে মায়েরাও ফোনে কথা বলা শুরু করলো। বোধহয় একেই সঙ্গগুণ বলে। আমার পাশে যে বসেছিল বাড়িরই এক সদস্য সে দরজা দিয়ে যারা ঢুকছিল বা বাইরে দাঁড়িয়েছিল তাদের ভেতরে আসার জন্য বারবার হাত নাড়িয়ে ডাকছিল। আমি তাকে বললাম সৎসঙ্গে মন দেওয়ার জন্যে। কীর্তন শেষে আলোচনা চললো। যারা আলোচনা করলো তারা বয়স্ক। তারা ইষ্টপ্রাণতার কথা বললো। ভালোবাসার কথা বললো। স্বতঃ অনুজ্ঞা পাঠের কথা বললো। শ্রীশ্রীঠাকুরের অনুশাসন পালনের কথা বললো। একে অপরকে কথার জাগলারিতে ঠেস দিতে লাগলো। কিন্তু তাদের পরণে নিত্য নৈমিত্তিক পোশাক, তারা বসে ফোনে কথা বললো, পরস্পরের মধ্যে গান, বক্তৃতা চলাকালীন কথা বললো।
এরপরে আমাকে ঋত্বিক কিছু বলার অনুরোধ করলো। আমি উঠে দাঁড়ালাম কিছু বলবো ব'লে। ইদানীং সৎসঙ্গে যাওয়ার আগ্রহ ও উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। গেলেও কিছু বলার ইচ্ছা হয় না। কারণ সৎসঙ্গের সেই পবিত্র পরিবেশ থাকে না। প্রবীণ যোগ্য ও দক্ষ, ঠাকুর দর্শন সম্পর্কে অবহিত শিক্ষিত লোকেরা প্রায় সৎসঙ্গে থাকে না বললেই চলে। কেন্দ্র ও মন্দির থেকে তারা উচ্ছেদ। প্রায় বাড়ির ইয়ং ছেলেরা, মেয়েরা বা বৌমারা সৎসঙ্গে থাকে না। তারা অফিসে, ব্যবসা কিংবা নিজের বা ছেলেমেয়ের টিউশান বা পরীক্ষা থাকার জন্য নাকি থাকতে পারে না। কিংবা বাড়িতে থাকলেও সৎসঙ্গে বসে না। সৎসঙ্গে বসতে নাকি ইন্টারেস্ট পায় না। আর বসলেও একটু পড়েই উঠে চলে যায়। তাদের কাছে এই এক দেড় ঘন্টার অনুষ্ঠান নাকি যন্ত্রবৎ মনে হয়, একঘেয়েমি লাগে।
যাই হ'ক, কিছু বলবার জন্য দাঁড়িয়েছি। সবে শুরু করেছি বলা, এমনিতেই জানি বেশি কিছু বলবো না, তবুও দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ঋত্বিক মোবাইলে টাইম দেখে ব'লে দিলেন দু'তিন মিনিটের মধ্যে বলার জন্য। সময় বেঁধে দিলেন। মুচকি হেসে তাঁর কথায় ঘাড় নেড়ে 'ঠিক আছে' ব'লে সম্মতি দিলাম। ভাবলাম আন্দাগুন্দা তো ব্যাট চালাতে পারি না। সাপ ব্যাঙের গল্প ব'লে যে ঠাকুরের জীবন দর্শন তুলে ধরবো তা'তেও শালা দক্ষ না। কি করি? সময় এগিয়ে যচ্ছে ক্রমশঃ। ঠাকুরের নাম নিয়ে বলতে লাগলাম। মিনিট দু'য়েক হয়েছে কানে কার যেন কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলান ঋত্বিক বিন্দাস ফোনে কথা বলছেন। আমি বলা বন্ধ ক'রে উনাকে সুযোগ ক'রে দিলাম ফোনে কথা বলার জন্য। তারপরে উনার কথা শেষ হ'লে আমিও দু'এক কথা ব'লে আমার বক্তব্যের ইতি টানলাম।
এরপরে ঋত্বিক উঠলেন, ফোনে কথা বলার স্বপক্ষে সাফাই দিলেন, চেষ্টা করলেন অযৌক্তিক কথায় নিজেকে জাস্টিফাই করার। তারপরে চলে এলেন ঠাকুরের জন্মদিন পালনের জন্য অর্ঘ দেবার কথায়। তারপরে ধ্বনি দিয়ে The greatest phenomenon of the world SriSriThakur Anukulchandra-এর সোনার সৎসঙ্গীদের সোনার সৎসঙ্গ শেষ হ'লো।
তারপর এতক্ষণ একসঙ্গে ব'সে থাকা সবাই সবার অপরিচিতের মতো ঠাকুরের প্রসাদ নিয়ে একে একে চলে গেল যে যার বাড়ির উদ্দেশ্যে ঝিমুনি মুরগির মতো। আর ঋত্বিকও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম নিষেধ সৎসঙ্গ জগতে তা জানা সত্ত্বেও নিতে লাগলেন, নিতে লাগলেন ঠাকুরের সামনেই প্রণাম আর পরে প্রণামী ও প্রসাদ। P3- এর মোক্ষম উদাহরণ।
আর, চলে যাওয়ার সময় কেউ কেউ এসে আমাকে একে অপরের বিরুদ্ধে তীব্র দ্বন্ধের কথা ব'লে গেল নীচু স্বরে ভয়ে ভয়ে।
আমি বসে বসে শ্রীশ্রীঠাকুরের দিকে চেয়ে ভাবলাম, আমার সেই কৈশোর যৌবনের দিনগুলি থেকে সৎসঙ্গে দেখা ও বইয়ে পড়া এস ওয়াজেদ আলির বিখ্যাত উক্তি 'সেই ট্রাডিশান সমানে চলেছে।'
তারপর ঘর ফাঁকা হ'লে আমিও ধীরে ধীরে পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে এলাম।----প্রবি।
No comments:
Post a Comment