পরবর্তী অংশঃ
যাই হ'ক, শারীরিক মানসিক নিরাময়ের প্রক্রিয়া শুরু হ'লো তখন থেকে শ্রীশ্রীআচার্যদেবের সান্নিধ্যে ও প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে। কিন্তু তখনও তিনি আচার্য হননি। আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা তখনও বর্তমান। অথচ বাকসিদ্ধ পুরুষের মতো অলৌকিক ঘটনা সব ঘটতে লাগলো আমাদের পরিবারের প্রত্যেকের জীবনে। ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী তাদের পড়াশুনা, চাকরী, সংসার ইত্যাদি যখনি কোনও সমস্যার মুখোমুখি হয় তখনি ছুটে চলে যেতো শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কাছে আর সমাধান নিয়ে চলে আসতো তারা। কি অদ্ভুত! তাঁর প্রতিটি পরামর্শ, প্রতিটি কথা, প্রতিটি সমাধান মুক্ত করতো আমাদের সংকট থেকে! আজও জানি না কি ক'রে কোন অলৌকিক উপায়ে তা সম্ভব হ'তো!
একবার একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। চাকরী সংক্রান্ত সমস্যায় সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হওয়ায় ছেলেমেয়ে উভয়েই দৌড়ে গেছিল ঠাকুরবাড়ি শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কাছে। সালটা ছিল সম্ভবত ২০১৬। ঠাকুরবাড়ি পৌঁছে জানতে পেরেছিলাম আগের দিন শ্রীশ্রীবাবাইদাদা কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন বিশেষ শারীরিক কারণে। মনটা ভেঙে গেল ছেলেমেয়ের। আমাদেরও মনটা বিষন্ন হ'য়ে গেল।
পরদিন ভোরবেলা শীতের ভোর কুয়াশা ঢাকা আকাশ চারপাশ। পুষ্পবৃষ্টির মত হালকা শিশির কণা চোখেমুখে ঝ'রে পড়ছে! প্রার্থনা শেষে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম যেখানে আচার্যদেব বসতেন সেইখানের উদ্দেশ্যে। স্ত্রী অনেক আগে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল। আমরা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। গত রাত থেকে প্রার্থনা করছিলাম আমরা সবাই শ্রীশ্রীবাবাইদাদার দেখা যদি না পাই দয়াল অন্তত যেন শ্রীশ্রীঅবিনদাদার দেখা পাই। কিন্তু অবিনদাদা তখন কোথাও দর্শন দিত না।
তখন আমরা চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। স্নানকুন্ডের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি হঠাৎ মেয়ে আমার বললো, বাবা, বাবা অবিনদাদা যাচ্ছে। চেয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই অবিনদাদা শ্রীশ্রীবড়দা বাড়ির দিক দিয়ে এসে আমাদের পাশ দিয়ে বাইক চালিয়ে স্নানকুন্ডের পিছনে বাইক থামিয়ে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ কোথাও নেই! ফাঁকা চারপাশ। ভোরের কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। ফাঁকা জায়গায় অবিনদাদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর তখনি মনে হ'লো যেন দয়াল আমাদের গতরাতে এবং সকালের প্রার্থনা শুনেছে! আর কোনও কিছু না ভেবে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঐ ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অবিনদাদার সামনে হাজির হলাম। হাতজোড় ক'রে প্রণাম ক'রে ঠাকুরবাড়ি আসার কারণ ও শ্রীশ্রীবাবাইদাদার অনুপস্থিতির কথা তুলে ধরলাম। বললাম, আপনি যদি ওদের সমস্যার কথা শোনেন। হাসিমুখে অবিনদাদা ছেলেমেয়ে উভয়ের কাছে সমস্যার কথা জানতে চাইলে দু'জনেই তাদের অন্য কোম্পানিতে চাকরী পাওয়ার কথা জানিয়ে জানতে চাইলো সেখানে জয়েন করবে কিনা।
প্রথমে মেয়ের কথা শুনে তাকে নোতুন কোম্পানী ও বর্তমানে যেখানে কাজ করে সেই কোম্পানি সম্পর্কে, কাজ সম্পর্কে, বেতন সম্পর্কে একের পর এক এত ডিটেইলসে আলোচনা করলেন তা দেখে আমি হতভম্ব হ'য়ে গেলাম! মনে মনে অবাক হ'য়ে ভাবছিলাম অবিনদাদার বয়সের কথা আর নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছিলাম, অবিনদাদার মাত্র ১৬বছর বয়স। এই বয়সে কোম্পানী সম্পর্কে, চাকুরী সম্পর্কে এত জ্ঞান!? এত পরিণত? মন বললো, ১৬বছরের একজন পরিণত কিশোর নয়, যুবক নয় একজন লোক! অনেকক্ষণ কথা বলার পর মেয়েকে নোতুন কোম্পানীতে জয়েন করার আশীর্বাদ করলেন। তারপর বাবা যখন আসবে তখন জয়েন ক'রে এসে বাবাকে জানিয়ে আশীর্বাদ নিতে বললেন। তারপর ছেলেকে হেসে জিজ্ঞেস করলেন ওর সমস্যা কি? ছেলেরও ছিল নোতুন কোম্পানিতে চাকরীর অফার। ছেলের কাছে সব শুনে ছেলেকে সরাসরি না ক'রে দিল। বললো, এখন পকেটে যা ঢুকছে তা ভালোলাগছে না? আরো চাই? তারপর টাকার লোভে নোতুন জায়গায় গিয়ে ৬মাস পরে যদি বের ক'রে দেয় তখন কি হবে? জিজ্ঞেস করলো ছেলেকে। তার থেকে বরঞ্চ এখানেই থাক। এখানেই প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি সব হবে। ঠিক আছে? আরো অনেক কথা, অনেক উদাহরণ, অনেক ঘটনা তুলে ধ'রে দীর্ঘ আলোচনার শেষে ছেলেকে বললো, কি কিছু বুঝলি? ছেলে মাথা নেড়ে খুশী মনে সম্মতি জানালো। তারপরে বললো, আর কিছু? তাহ'লে আসি? আমরা খুশী মনে তাঁকে প্রণাম ক'রে সরে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনি একজন বন্ধু এলে তাকে এনফিল্ড বাইকের পিছনে বসিয়ে চোখের নিমেষে চলে গেলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাঁর যাওয়ার পথে দিকে চেয়ে রইলাম।
ছেলেমেয়ের সে কি আনন্দ! যাক আসা বৃথা হয়নি। দয়াল ঠাকুর প্রার্থনা শুনেছেন। একটা দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তির চাপ মাথা থেকে নেবে গেল দু'জনের। মনে পড়ে গেল, দয়াল ঠাকুর প্রায়ই বলতেন, "আজও লীলা ক'রে গৌর চাঁদ রায়, কোনও কোনও ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।" আজ আরো একবার প্রমাণ হ'লো এই বাণীর সত্যতা! প্রমাণ হ'লো সৎসঙ্গে আচার্যদেবের লীলা! ভেসে উঠলো আচার্য পরম্পরার প্রথার মধ্যে দিয়ে পিতাপুত্রের লীলার জ্বলন্ত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সংকেত!
ছেলেমেয়ের আনন্দে আমারও আনন্দ হ'তে লাগলো। সারাক্ষণ কে যেন মনের মধ্যে এসে ব'লে যেতে লাগলো, আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা আছেন দেওঘরে কিন্তু বর্তমানে যাকে নিবেদন করা হয় তিনি নেই এখন দেওঘরে, তিনি কলকাতায় অথচ সমাধান দিলেন ১৭বছরের একটি অত্যাশ্চর্য ছেলে, যাকে সৎসঙ্গীরা অবিনদাদা ব'লে ডাকেন। কেন তিনি কুয়াশা ঢাকা অত ভোরে বাইক চালিয়ে ঠিক আমাদের সামনে এলেন!? আর আশেপাশে কেন কেউ ছিল না সেখানে অত ভোরে!? আর কেনই বা কথা শেষ ক'রেই একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন আবার যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথ ধ'রে!? কে উত্তর দেবে এর?
যাই হ'ক পরবর্তীতে যা হয়েছিল সেটা ব'লে এই লেখা শেষ করবো। মেয়ের নোতুন কাজের জায়গায় সবকিছু মেয়ের ফেভারে ছিল। ছেলেও তার পুরোনো জায়গায় র'য়ে গেল এবং সেখানেই ধীরে ধীরে নিজের জমি শক্ত হতে লাগলো। আজও ২০২২ সালে এই লেখা পর্যন্ত সে ঐ কোম্পানিতে আছে অবিনদাদার কথামতো 'এইখানেই তোর সব হবে' বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, যে কোম্পানিতে যাওয়ার ব্যাপারে অবিনদাদা নিষেধ করেছিলেন সেই কোম্পানিতে যে প্রোজেক্টের জন্য ছেলেকে চাকরী অফার করেছিল সেই প্রোজেক্ট ঠিক ছয় মাস পর কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে চ'লে যায়। ফলে যারা ব্যাঙ্গালোরে যাবার জন্য রাজী তারা যেতে পারে আর যারা যাবে না বা যেতে পারবে না তাদের জন্য কলকাতায় কোনও জায়গা নেই। অতএব পশ্চাদদেশে পদাঘাত। ছেলের ক্ষেত্রে যা হ'য়ে দাঁড়াত সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা। যেটা অবিনদাদা আগেই জানতো। ভাগ্যিস সেদিন ছেলেমেয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি নোতুন চাকরীতে জয়েন করবে কিনা তার অনুমতি ও আশীর্বাদ নিতে! ভাগ্যিস সেদিন ঐ প্রচন্ড কুয়াশা ঢাকা শীতের ভোরে বর্তমান আচার্যদেব আশ্রমে নেই জেনেও অজানা এক টানে আমরা স্বামীস্ত্রী, পুত্রকন্যা সহ চারজনে হেঁটে চলেছিলাম নাম করতে করতে আর মনে মনে বলছিলাম, হে দয়াল! তুমি দয়া করো! বাবাইদাদা নেই, দয়া ক'রে তুমি অবিনদাদার সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও।
কোথায় জানি ঠাকুরের কোন গ্রন্থে পড়েছিলাম, বিশ্বাস আর আকুল প্রার্থনা সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। সেদিন দয়াল দয়া ক'রে অবিনদাদার মধ্যে দিয়ে ঐ অতি প্রত্যুষে এসে দেখা দিয়ে সমস্যা সমাধান ক'রে দিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস অবিনদাদার আদেশ মতো ছেলে পুরোনো কোম্পানীর চাকরী ছেড়ে নোতুন কোম্পানীর লোভনীয় অফার গ্রহণ করেনি। অবিনদাদার নির্দেশ আদেশ উপেক্ষা ক'রে যদি সেদিন ঐ অফার গ্রহণ করতো তাহ'লে হয় ছেলেকে চাকরী বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হ'তো অন্য রাজ্যে; নতুবা, চাকরী ছেড়ে বসে থাকতে হ'তো ঘরে। দয়াল সেদিন পূজনীয় শ্রীশ্রীঅবিনদাদার আচরণের মধ্যে দিয়ে দয়া ক'রে বাঁচিয়ে দিলেন, রক্ষা করলেন পুত্রের বর্তমান চাকরী ও পিতামাতার সঙ্গে পুত্রের বিচ্ছেদ।
কে এই শ্রীশ্রীঅবিনদাদা? শ্রীশ্রীঅবিনদাদা কি অন্তর্যামী!?
জানি না আমি। তবে একটা কথা বলে যাই, যদিও অলৌকিকতা ব'লে কিছু নেই। যতদিন না তুমি ঘটনার কার্যকারণ জানতে পারছো ততদিন তোমার কাছে অলৌকিক। আর যে মুহূর্তে তুমি ঘটনার কার্যকারণ জানতে পারছো তখনি তা হ'য়ে যাচ্ছে লৌকিক। যখনই জানাটা হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে তখনি সেটা হ'য়ে যাচ্ছে বাস্তব। আর যতক্ষণ জানতে পারছো না ততক্ষণ তা অলৌকিক, অবাস্তব বা কাকতালীয়।
কিন্তু এ ছাড়া এমন এমন ঘটনা আজও ঘটে যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। আমার দয়াল ঠাকুরের কয়েকটা পছন্দের কোটেশান আছে যা তিনি প্রায়ই বলতেন। তার মধ্যে একটা শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের অংশ। ঠাকুর প্রায়ই রহস্য ক'রে বলতেন, " There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosopy." যার অর্থ, স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত।"
আজও আমার ভোরের কথাটা মনে পড়লে (আর মনেও পড়ে সবসময়) কেমন জানি রহস্যময় এক জগতে চলে যায় শরীর মন। এ জোর ক'রে কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না। কুয়াশা ঢাকা সেই শীতের ভোর! চারিদিক আবছা আলো আঁধারে ঢাকা প্রকৃতি! মাথার ওপরে বেশ ঝ'রে পড়ছে ঝিরঝিরিয়ে কুয়াশা! চোখেমুখে এসে লাগছে কুয়াশার সেই হালকা জলের ছিটা। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না! চারপাশটা ফাঁকা! নিস্তব্ধ! আর কেনই বা কেউই নেই তাও জানি না। আমরা পরিবারের চারজন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছি। কেন চলেছি, কি জন্য চলেছি, কার জন্যে চলেছি এই অতি প্রত্যুষে পাঠক বিশ্বাস করুন আমরা কেউ জানি না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি! মনে হচ্ছিল কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐ ঠাকুরের সুইমিং পুলের দিকে। আর তারপরেই ঐ অতি প্রত্যুষে আলোআঁধার পরিবেশে ঘটেছিল ঘটনাটা! হঠাৎ কুয়াশার ঘন আচ্ছরণ ভেদ ক'রে সামনে এসে হাজির হয়েছিল সেই বিশাল এনফিল্ড বাইক আর বাইকের ওপর সওয়ারি। একে কি বলবো পাঠক জানি না। বিশ্বাস করা আর না করা আপনাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা সেদিন দয়াল ঠাকুরের দয়ায় সাক্ষাৎ প্রমাণ পেয়েছিলাম ঠাকুরের প্রায় সময় রহস্য ক'রে বলা শেক্সপিয়ারের সেই 'হ্যামলেট' নাটকের অংশ বিশেষ, " There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy." যার অর্থ, স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত।" যা আজও আমাদের রোমাঞ্চিত করে! যখনই মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস মুহূর্তের জন্য বিন্দুমাত্র হানা দেয় তখনি যেন মনে দয়াল মিষ্টি হেসে রহস্য ক'রে বলছেন তাঁর প্রিয় কোটেশানটা।
ক্রমশঃ
( ২৭শে নভেম্বর' ২০২২)
একবার একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। চাকরী সংক্রান্ত সমস্যায় সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হওয়ায় ছেলেমেয়ে উভয়েই দৌড়ে গেছিল ঠাকুরবাড়ি শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কাছে। সালটা ছিল সম্ভবত ২০১৬। ঠাকুরবাড়ি পৌঁছে জানতে পেরেছিলাম আগের দিন শ্রীশ্রীবাবাইদাদা কলকাতার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছেন বিশেষ শারীরিক কারণে। মনটা ভেঙে গেল ছেলেমেয়ের। আমাদেরও মনটা বিষন্ন হ'য়ে গেল।
পরদিন ভোরবেলা শীতের ভোর কুয়াশা ঢাকা আকাশ চারপাশ। পুষ্পবৃষ্টির মত হালকা শিশির কণা চোখেমুখে ঝ'রে পড়ছে! প্রার্থনা শেষে আমরা হেঁটে যাচ্ছিলাম যেখানে আচার্যদেব বসতেন সেইখানের উদ্দেশ্যে। স্ত্রী অনেক আগে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছিল। আমরা ভাবতে ভাবতে যাচ্ছি। গত রাত থেকে প্রার্থনা করছিলাম আমরা সবাই শ্রীশ্রীবাবাইদাদার দেখা যদি না পাই দয়াল অন্তত যেন শ্রীশ্রীঅবিনদাদার দেখা পাই। কিন্তু অবিনদাদা তখন কোথাও দর্শন দিত না।
তখন আমরা চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। স্নানকুন্ডের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি হঠাৎ মেয়ে আমার বললো, বাবা, বাবা অবিনদাদা যাচ্ছে। চেয়ে দেখলাম সত্যি সত্যিই অবিনদাদা শ্রীশ্রীবড়দা বাড়ির দিক দিয়ে এসে আমাদের পাশ দিয়ে বাইক চালিয়ে স্নানকুন্ডের পিছনে বাইক থামিয়ে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কেউ কোথাও নেই! ফাঁকা চারপাশ। ভোরের কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। ফাঁকা জায়গায় অবিনদাদাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর তখনি মনে হ'লো যেন দয়াল আমাদের গতরাতে এবং সকালের প্রার্থনা শুনেছে! আর কোনও কিছু না ভেবে ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঐ ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা অবিনদাদার সামনে হাজির হলাম। হাতজোড় ক'রে প্রণাম ক'রে ঠাকুরবাড়ি আসার কারণ ও শ্রীশ্রীবাবাইদাদার অনুপস্থিতির কথা তুলে ধরলাম। বললাম, আপনি যদি ওদের সমস্যার কথা শোনেন। হাসিমুখে অবিনদাদা ছেলেমেয়ে উভয়ের কাছে সমস্যার কথা জানতে চাইলে দু'জনেই তাদের অন্য কোম্পানিতে চাকরী পাওয়ার কথা জানিয়ে জানতে চাইলো সেখানে জয়েন করবে কিনা।
প্রথমে মেয়ের কথা শুনে তাকে নোতুন কোম্পানী ও বর্তমানে যেখানে কাজ করে সেই কোম্পানি সম্পর্কে, কাজ সম্পর্কে, বেতন সম্পর্কে একের পর এক এত ডিটেইলসে আলোচনা করলেন তা দেখে আমি হতভম্ব হ'য়ে গেলাম! মনে মনে অবাক হ'য়ে ভাবছিলাম অবিনদাদার বয়সের কথা আর নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছিলাম, অবিনদাদার মাত্র ১৬বছর বয়স। এই বয়সে কোম্পানী সম্পর্কে, চাকুরী সম্পর্কে এত জ্ঞান!? এত পরিণত? মন বললো, ১৬বছরের একজন পরিণত কিশোর নয়, যুবক নয় একজন লোক! অনেকক্ষণ কথা বলার পর মেয়েকে নোতুন কোম্পানীতে জয়েন করার আশীর্বাদ করলেন। তারপর বাবা যখন আসবে তখন জয়েন ক'রে এসে বাবাকে জানিয়ে আশীর্বাদ নিতে বললেন। তারপর ছেলেকে হেসে জিজ্ঞেস করলেন ওর সমস্যা কি? ছেলেরও ছিল নোতুন কোম্পানিতে চাকরীর অফার। ছেলের কাছে সব শুনে ছেলেকে সরাসরি না ক'রে দিল। বললো, এখন পকেটে যা ঢুকছে তা ভালোলাগছে না? আরো চাই? তারপর টাকার লোভে নোতুন জায়গায় গিয়ে ৬মাস পরে যদি বের ক'রে দেয় তখন কি হবে? জিজ্ঞেস করলো ছেলেকে। তার থেকে বরঞ্চ এখানেই থাক। এখানেই প্রমোশন, বেতন বৃদ্ধি সব হবে। ঠিক আছে? আরো অনেক কথা, অনেক উদাহরণ, অনেক ঘটনা তুলে ধ'রে দীর্ঘ আলোচনার শেষে ছেলেকে বললো, কি কিছু বুঝলি? ছেলে মাথা নেড়ে খুশী মনে সম্মতি জানালো। তারপরে বললো, আর কিছু? তাহ'লে আসি? আমরা খুশী মনে তাঁকে প্রণাম ক'রে সরে দাঁড়ালাম। আর ঠিক তখনি একজন বন্ধু এলে তাকে এনফিল্ড বাইকের পিছনে বসিয়ে চোখের নিমেষে চলে গেলেন। আমরা অবাক বিস্ময়ে তাঁর যাওয়ার পথে দিকে চেয়ে রইলাম।
ছেলেমেয়ের সে কি আনন্দ! যাক আসা বৃথা হয়নি। দয়াল ঠাকুর প্রার্থনা শুনেছেন। একটা দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তির চাপ মাথা থেকে নেবে গেল দু'জনের। মনে পড়ে গেল, দয়াল ঠাকুর প্রায়ই বলতেন, "আজও লীলা ক'রে গৌর চাঁদ রায়, কোনও কোনও ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।" আজ আরো একবার প্রমাণ হ'লো এই বাণীর সত্যতা! প্রমাণ হ'লো সৎসঙ্গে আচার্যদেবের লীলা! ভেসে উঠলো আচার্য পরম্পরার প্রথার মধ্যে দিয়ে পিতাপুত্রের লীলার জ্বলন্ত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সংকেত!
ছেলেমেয়ের আনন্দে আমারও আনন্দ হ'তে লাগলো। সারাক্ষণ কে যেন মনের মধ্যে এসে ব'লে যেতে লাগলো, আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা আছেন দেওঘরে কিন্তু বর্তমানে যাকে নিবেদন করা হয় তিনি নেই এখন দেওঘরে, তিনি কলকাতায় অথচ সমাধান দিলেন ১৭বছরের একটি অত্যাশ্চর্য ছেলে, যাকে সৎসঙ্গীরা অবিনদাদা ব'লে ডাকেন। কেন তিনি কুয়াশা ঢাকা অত ভোরে বাইক চালিয়ে ঠিক আমাদের সামনে এলেন!? আর আশেপাশে কেন কেউ ছিল না সেখানে অত ভোরে!? আর কেনই বা কথা শেষ ক'রেই একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন আবার যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথ ধ'রে!? কে উত্তর দেবে এর?
যাই হ'ক পরবর্তীতে যা হয়েছিল সেটা ব'লে এই লেখা শেষ করবো। মেয়ের নোতুন কাজের জায়গায় সবকিছু মেয়ের ফেভারে ছিল। ছেলেও তার পুরোনো জায়গায় র'য়ে গেল এবং সেখানেই ধীরে ধীরে নিজের জমি শক্ত হতে লাগলো। আজও ২০২২ সালে এই লেখা পর্যন্ত সে ঐ কোম্পানিতে আছে অবিনদাদার কথামতো 'এইখানেই তোর সব হবে' বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
কিন্তু সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, যে কোম্পানিতে যাওয়ার ব্যাপারে অবিনদাদা নিষেধ করেছিলেন সেই কোম্পানিতে যে প্রোজেক্টের জন্য ছেলেকে চাকরী অফার করেছিল সেই প্রোজেক্ট ঠিক ছয় মাস পর কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে চ'লে যায়। ফলে যারা ব্যাঙ্গালোরে যাবার জন্য রাজী তারা যেতে পারে আর যারা যাবে না বা যেতে পারবে না তাদের জন্য কলকাতায় কোনও জায়গা নেই। অতএব পশ্চাদদেশে পদাঘাত। ছেলের ক্ষেত্রে যা হ'য়ে দাঁড়াত সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা। যেটা অবিনদাদা আগেই জানতো। ভাগ্যিস সেদিন ছেলেমেয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি নোতুন চাকরীতে জয়েন করবে কিনা তার অনুমতি ও আশীর্বাদ নিতে! ভাগ্যিস সেদিন ঐ প্রচন্ড কুয়াশা ঢাকা শীতের ভোরে বর্তমান আচার্যদেব আশ্রমে নেই জেনেও অজানা এক টানে আমরা স্বামীস্ত্রী, পুত্রকন্যা সহ চারজনে হেঁটে চলেছিলাম নাম করতে করতে আর মনে মনে বলছিলাম, হে দয়াল! তুমি দয়া করো! বাবাইদাদা নেই, দয়া ক'রে তুমি অবিনদাদার সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও।
কোথায় জানি ঠাকুরের কোন গ্রন্থে পড়েছিলাম, বিশ্বাস আর আকুল প্রার্থনা সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। সেদিন দয়াল দয়া ক'রে অবিনদাদার মধ্যে দিয়ে ঐ অতি প্রত্যুষে এসে দেখা দিয়ে সমস্যা সমাধান ক'রে দিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস অবিনদাদার আদেশ মতো ছেলে পুরোনো কোম্পানীর চাকরী ছেড়ে নোতুন কোম্পানীর লোভনীয় অফার গ্রহণ করেনি। অবিনদাদার নির্দেশ আদেশ উপেক্ষা ক'রে যদি সেদিন ঐ অফার গ্রহণ করতো তাহ'লে হয় ছেলেকে চাকরী বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হ'তো অন্য রাজ্যে; নতুবা, চাকরী ছেড়ে বসে থাকতে হ'তো ঘরে। দয়াল সেদিন পূজনীয় শ্রীশ্রীঅবিনদাদার আচরণের মধ্যে দিয়ে দয়া ক'রে বাঁচিয়ে দিলেন, রক্ষা করলেন পুত্রের বর্তমান চাকরী ও পিতামাতার সঙ্গে পুত্রের বিচ্ছেদ।
কে এই শ্রীশ্রীঅবিনদাদা? শ্রীশ্রীঅবিনদাদা কি অন্তর্যামী!?
জানি না আমি। তবে একটা কথা বলে যাই, যদিও অলৌকিকতা ব'লে কিছু নেই। যতদিন না তুমি ঘটনার কার্যকারণ জানতে পারছো ততদিন তোমার কাছে অলৌকিক। আর যে মুহূর্তে তুমি ঘটনার কার্যকারণ জানতে পারছো তখনি তা হ'য়ে যাচ্ছে লৌকিক। যখনই জানাটা হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে তখনি সেটা হ'য়ে যাচ্ছে বাস্তব। আর যতক্ষণ জানতে পারছো না ততক্ষণ তা অলৌকিক, অবাস্তব বা কাকতালীয়।
কিন্তু এ ছাড়া এমন এমন ঘটনা আজও ঘটে যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। আমার দয়াল ঠাকুরের কয়েকটা পছন্দের কোটেশান আছে যা তিনি প্রায়ই বলতেন। তার মধ্যে একটা শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের অংশ। ঠাকুর প্রায়ই রহস্য ক'রে বলতেন, " There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosopy." যার অর্থ, স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত।"
আজও আমার ভোরের কথাটা মনে পড়লে (আর মনেও পড়ে সবসময়) কেমন জানি রহস্যময় এক জগতে চলে যায় শরীর মন। এ জোর ক'রে কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না। কুয়াশা ঢাকা সেই শীতের ভোর! চারিদিক আবছা আলো আঁধারে ঢাকা প্রকৃতি! মাথার ওপরে বেশ ঝ'রে পড়ছে ঝিরঝিরিয়ে কুয়াশা! চোখেমুখে এসে লাগছে কুয়াশার সেই হালকা জলের ছিটা। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না! চারপাশটা ফাঁকা! নিস্তব্ধ! আর কেনই বা কেউই নেই তাও জানি না। আমরা পরিবারের চারজন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছি। কেন চলেছি, কি জন্য চলেছি, কার জন্যে চলেছি এই অতি প্রত্যুষে পাঠক বিশ্বাস করুন আমরা কেউ জানি না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি! মনে হচ্ছিল কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐ ঠাকুরের সুইমিং পুলের দিকে। আর তারপরেই ঐ অতি প্রত্যুষে আলোআঁধার পরিবেশে ঘটেছিল ঘটনাটা! হঠাৎ কুয়াশার ঘন আচ্ছরণ ভেদ ক'রে সামনে এসে হাজির হয়েছিল সেই বিশাল এনফিল্ড বাইক আর বাইকের ওপর সওয়ারি। একে কি বলবো পাঠক জানি না। বিশ্বাস করা আর না করা আপনাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা সেদিন দয়াল ঠাকুরের দয়ায় সাক্ষাৎ প্রমাণ পেয়েছিলাম ঠাকুরের প্রায় সময় রহস্য ক'রে বলা শেক্সপিয়ারের সেই 'হ্যামলেট' নাটকের অংশ বিশেষ, " There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy." যার অর্থ, স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত।" যা আজও আমাদের রোমাঞ্চিত করে! যখনই মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস মুহূর্তের জন্য বিন্দুমাত্র হানা দেয় তখনি যেন মনে দয়াল মিষ্টি হেসে রহস্য ক'রে বলছেন তাঁর প্রিয় কোটেশানটা।
ক্রমশঃ
( ২৭শে নভেম্বর' ২০২২)
No comments:
Post a Comment