আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা দয়ালদেশে চলে গেলেন। সঙ্গে আমাদেরও দয়ালদেশের চাবিকাঠি দিয়ে ব'লে গেলেন, নামের তরীতে চ'ড়ে বস। নামের তরীতে চড়ে ভবসাগর পার হ'য়ে যা আর চলে যা দয়ালের সাথে দয়ালের দেশে। সাথে রেখে গেলেন আমাদের সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তাঁরই সুযোগ্য জ্যেষ্ঠাত্মজ বাকসিদ্ধ পুরুষ বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদাকে।
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গুরুভাই গুরুবোন নিয়ে এতবড় বিশাল সৎসঙ্গ পরিবার। সেই পরিবারের অভিভাবক ছিলেন আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা। তাঁর মহাপ্রয়ানে এতটুকু টলে উঠলো না সৎসঙ্গ পরিবার! মহা নক্ষত্রের যে পতন হ'লো, সৃষ্টি হ'লো মহাশূন্যর তা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারলো না শোকে কাতর কোটি কোটি সৎসঙ্গী! মাখনে ছুরি চলার মতো বিরাট বিশাল সৎসঙ্গ পরিবারের ভয়ংকর ভার মসৃণভাবে এসে পড়লো শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কাঁধে ! আচরণসিদ্ধ পুরুষ বাবাইদাদা প্রতিক্রিয়াহীন সহজ স্বাভাবিক আচরণের মধ্যে দিয়ে সবার হৃদয়ে আচার্যের আসনে অধিষ্ঠিত হ'লেন। বর্তমান সৎসঙ্গের আচার্যদেব হ'লেন শ্রীশ্রীবাবাইদাদা।
আচরণসিদ্ধ পুরুষ আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদা আচরণের মধ্যে দিয়ে সবাইকে বললেন, তোমাকে যদি কেউ গালি দেয়, তোমাকে যদি কেউ ঢিল মারে তখন তুমি ভেবে দেখো ঠাকুরকে গালি দিলে, ঠাকুরকে ঢিল মারলে ঠাকুর কি করতেন? তুমি যদি মিত্রকে বিপদের সময় পাঁচ টাকা দাও তাহ'লে তুমি শত্রুকে দশ টাকা দিও। তুমি সবার মধ্যে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে হাটে মাঠে ঘাটে যেখানে যাবে, যার সঙ্গে কথা বলবে সেখানে তার সঙ্গে তোমার প্রিয়পরমের, তোমার ইষ্টের কথা ব'লো, গল্প ক'রো, সবার মাঝে তোমার প্রিয়কে বিতরণ ক'রো।
তিনি বললেন,
প্রিয় বিতরণ করে যেইজন
সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
তিনি আমাদের প্রতিকূল পরিস্থিতি পরিবেশের মোকাবিলা প্রসঙ্গে আরো বললেন, "ঠাকুরকে যখন তাঁর জীবদ্দশায় এবং এখনও চরম অপমান, অশ্রদ্ধা, কুৎসা, নিন্দা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছে ও হচ্ছে তাহ'লে আমরা তাঁর সন্তান হ'য়ে অপমান, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করবো না?" আচার্যদেব আমাদের হাসিমুখে সব অপমান, বিরুদ্ধ প্রচার, কুৎসা সহ্য করতে শেখাচ্ছেন। তিনি বললেন, "ঠাকুরকে কেন ধরেছি? একটা হ'লো ঠাকুর তোমাকে ভালো লাগে তাই তোমাকে ধরেছি, আর একটা হ'লো তোমার মতো হবো ব'লে তোমাকে ধরেছি।"
আচার্যদেব নিজের জীবন দিয়ে আচরণ ক'রে ক'রে আমাদের প্রতিমুহূর্তে শেখাচ্ছেন কেমন ক'রে ঠাকুরের মতো হ'য়ে উঠবো। আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদাকে দেখলে আজ কোটি কোটি সৎসঙ্গী ঠাকুরকে জীবন্ত অনুভব করে; তাঁর মধ্যে ঠাকুরকে দেখতে না পাওয়ার স্বাদ পূরণ করে। আচার্য পরম্পরা না থাকলে এবং আচার্যদেব আমাদের সামনে না থাকলে আজ ঠাকুর তাঁর তামাম বইয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতো। লাইব্রেরীতে বইয়ের তাকে, ঘরের ড্রয়িং রুমের আলমারিতে, শো কেসে, টেবিলে, আনাচে কানাচে যত্রতত্র পড়ে থাকতো বইগুলি অবহেলায় ধুলোয় ঢেকে। এখন আর বই পড়ার ধৈর্য্য, অভ্যাস বা সময় কারোও নেই। আমাদের ভাগ্য ভালো এবার দয়াল ঠাকুর দয়া ক'রে তাঁর ঔরসজাত ও কৃষ্টিজাত সন্তান রেখে গেছেন বিশ্বের সামনে! ঠাকুরের বাণীগুলি আমরা আচার্য পরম্পরায় আচার্যদেবের মধ্যে জীবন্ত দেখতে পায়। আচার্যদেব যেন ঠাকুরের চলমান বাণী! তাঁর কাছ থেকে জেনে নিই ঠাকুরের হাজার হাজার ছড়া, বাণী, সত্যানুসরণের অন্তর্নিহিত অর্থ। আজ আচার্যদেব না থাকলে আমরা কোটি কোটি সৎসঙ্গীরা মন্দিরে মন্দিরে পারস্পরিক কলহে জড়িয়ে ছিন্নভিন্ন হ'য়ে যেতাম। আচার্যদেব না থাকলে পোঙ্গা পন্ডিতদের দ্বারা ঠাকুরের বাণীর ভুল ব্যাখ্যা তামাম সাধারণ ভাঙাচোরা মানুষকে বিভ্রান্ত করতো, ভুল পথে চালিত করতো। আচার্যদেব না থাকলে আজ আমরা না বুঝে, না জেনে লক্ষী ছাড়া নারায়ণ নিয়ে মেতে থাকতাম। আচার্যদেব না থাকলে আজ দেওঘর শ্মশান হ'য়ে থাকতো। ট্যুরিষ্ট স্পটের মতো ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের উপস্থিতি ছাড়া প্রতিদিন হাজার হাজার উৎসব অনুষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের পদধূলি পড়তো না। সারা দেশ তথা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ রোগ শোক অভাব অনটন নানা সমস্যায় জর্জরিত দিশেহারা সৎসঙ্গীকুল উদভ্রান্তের মতো সমাধানের আশায়, মুক্তির আশায় ছুটে আসার কোনও জায়গা পেতো না।
আচার্য পরম্পরার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নিদর্শন শ্রীশ্রীঠাকুরের "এক আদেশে চলে যারা, তাদের নিয়ে সমাজ গড়া" বাণী! আজ আমরা বুঝতে পারছি আচার্যদেবকে দেখে। আচার্যদেব না থাকলে, আচার্য পরম্পরা না থাকলে শ্রীশ্রীঠাকুরের এই অমোঘ বাণী আজ মূর্ত হ'য়ে উঠতে পারতো না। আজ সৎসঙ্গ জগতে সৎসঙ্গ পরিবারের বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি সৎসঙ্গী আচার্যদেবের এক আদেশে শৃঙ্খলার সঙ্গে যে কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। তিনি নিজে আচরণের মাধ্যমে আমাদের ইষ্টের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার তুক শেখাচ্ছেন। শত্রুমিত্র সবাইকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছেন।
ইষ্টের সঙ্গে শত হাজার কোলাহলের মাঝে একাত্ম কি ক'রে হওয়া যায় সেই প্রসঙ্গে একদিন আমায় বললেন,
"আমার এখানে চারিদিকে কত মানুষ আছে। আমি যদি সবার দিকে সবার কথায় মাথা ঘামায় তবে দশবার জন্ম নিলেও আমি ঠাকুরের কাজ করতে পারবো না। আপনাকে অর্জুনের মতো হ'তে হবে, লক্ষ্যভেদের দিকে নজর রাখতে হবে" ইত্যাদি আরো অনেক কথা।
শ্রীশ্রীঠাকুর রেত শরীরে আচার্য পরম্পরায় প্রকট হ'য়ে উঠছেন ক্রমশঃ। শ্রীশ্রীঠাকুর রেত শরীরে বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার মধ্যে রূপে, গুণে, রসে আজ উদ্ভাসিত, বিদ্যমান! শ্রীশ্রীঠাকুর প্রায়ই বলতেন,
এইবার করিবো লীলা অতি চমৎকার!
আমিই বুঝিতে নারি অন্যে কি বা ছাড়।"
শ্রীশ্রীঠাকুর রেত শরীরে আচার্য পরম্পরায় প্রকট হ'য়ে উঠছেন ক্রমশঃ। শ্রীশ্রীঠাকুর রেত শরীরে বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার মধ্যে রূপে, গুণে, রসে আজ উদ্ভাসিত, বিদ্যমান! শ্রীশ্রীঠাকুর প্রায়ই বলতেন,
এইবার করিবো লীলা অতি চমৎকার!
আমিই বুঝিতে নারি অন্যে কি বা ছাড়।"
সত্যি সত্যিই লীলা হ'য়ে চলেছে দেওঘরের বুকে! পিতাপুত্রের লীলা। আচার্য পরম্পরার লীলা। সেই লীলা যে দেখেছে সেই মজেছে! মজেছে আচার্যদেবের মাঝে শ্রীশ্রীঠাকুরের সেই ভুবনভোলানো রূপে, অসীম গুণে, টইটম্বুর রসে!
প্রবি।
( লেখা ১৭ই ডীসেম্বর'২০২২ )
No comments:
Post a Comment