'তুমি শুধু প্রভুর জন্য'-২ লেখার শেষে লিখেছিলাম আসুন ঠাকুরের বাণীর শেষ লাইন "তুমি একমাত্র প্রভুর জন্য আর তাই তুমি সকলের জন্য" আমাদের জীবনে কতটা প্রভাব রেখেছে তা পরবর্তী 'তুমি শুধু প্রভুর জন্য'-৩ আর্টিকেলে দেখে নিই!
ঠাকুরের বাণীর শব্দ, লাইন ধ'রে ধ'রে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে কি দেখবো? আমি, আমরা কি সত্যিই একমাত্র প্রভুর জন্য হ'তে পেরেছি!? আমি, আমরা কি সত্যি সত্যিই সকলের জন্য!? যদি আমি একমাত্র প্রভুর জন্যে হ'য়ে থাকি , প্রভু ছাড়া যদি আর আমার কেউ না থেকে থাকে, প্রভু যদি আমার একমাত্র লক্ষ্য বা আদর্শ হয়, প্রভুই যদি আমার একমাত্র আশ্রয় হ'য়ে থাকে তাহলে কি আমি আমরা সকলের জন্যে হতে পেরেছি!? আর আমি যদি সকলের জন্যে হ'য়ে থাকি বা হ'তে পেরে থাকি তাহলে আমি নিশ্চয় প্রভুর জন্যে হ'তে পেরেছি।
আমি কি সত্যি সত্যিই প্রভুর জন্যে হ'তে পেরেছি!? বারবার একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে! কেন? খেতে থাকে এইজন্যে যে লড়াইটা নিজের সঙ্গে নিজের। বিবেকের মুখোমুখি! বিবেক নামক আয়নায় নিজের মুখটা একবার দেখে নেওয়া যাক মুখ কতটা কালো আর কতটাই বা ফর্সা! সেই যে কোন ছোটবেলায় ৫বছর বয়সে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির যে মূল মরকোচ সেই মরকোচ অর্থাৎ যাকে আমরা বীজনাম বলি সেই সর্বোচ্চ বীজনাম পেয়েছি আর ১২ বছর বয়সে পেয়েছি পূর্ণ দীক্ষা অর্থাৎ জানতে পেরেছি বাঁচাবাড়ার পথ, গ্রহণ করেছি বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার সর্বোচ্চ নিয়ম-নীতি। এই ৬৬ বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে অভিজ্ঞতার আলোকে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছি সেই অভিজ্ঞতার আলোর আয়নায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখে নিতে চেয়েছি আমার গুরু, আমার প্রভু, আমার ঈশ্বর, আমার দয়াল, আমার ঠাকুরের 'তুমি শুধু ঈশ্বরের জন্য আর কারো জন্য নও, তুমি ঈশ্বরের জন্য বলেই তুমি সবার জন্য'' বাণী কতটা আমার জীবনকে করতে পেরেছে আলোকিত! নাকি ৬৬ বছরের দীর্ঘ সফরটায় অন্ধকারে ভরা!
ছোটবেলায় ঠাকুরবাড়ি যেতাম মা-বাবার হাত ধ'রে। তখন আজকের মত এত উন্নত ও বিস্তৃতি লাভ করেনি। স্মৃতিবাহী চেতনা এত স্ট্রং ছিল না বা এখনও নয় যে সেই সময়ের ঘটনা মনে থাকবে বা ছবি মনে পড়বে! আবছা ভাবে কিছু কিছু মনে পড়ে বা ভেসে ওঠে! যেমন ঠাকুরের আবছা হালকা অস্পষ্ট ছবি ভেসে ওঠে কখনো সখনো। তারপরে যখন বড় হ'লাম, সামান্য বুদ্ধি হ'লো, বাবা মারা গেল ৭৯ সালে তখন মায়ের সঙ্গে সরাসরি এক মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত হ'লাম যে মন্দিরের সঙ্গে আমার বাবা-মা যুক্ত ছিল। যুক্ত ছিল একেবারে গোড়ার সময় থেকে ওতপ্রোতভাবে। এই মন্দিরের একেবারে গোড়ায় ছোটখাটো মন্দির নির্মাণকাজের সময় আমাদের বাড়ির নির্মাণ কাজের জন্য আনা নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহৃত হয়। সেই থেকে বাবা-মায়ের পিছন পিছন ছিলাম ঠাকুরের কাজে। পরবর্তী ৭৯ সালে বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সঙ্গে সেই মন্দিরে যাওয়া শুরু ও সরাসরি সামনে থেকে মন্দিরের কাজ পরিচালনায় যুক্ত হ'ই। আর সেই ৭৯ সাল থেকে আজ ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর মন্দির পরিচালনা, বিভিন্ন কেন্দ্র মন্দিরের সৎসঙ্গ অনুষ্ঠান ও উৎসবে যোগদানের মধ্যে দিয়ে বহু গুরুভাইবোন-এর সান্নিধ্যে আসি। আর সেই আসার মধ্যে দিয়ে বহু নামী- দামী-অনামী, প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত গুরুভাইবোন শুধুমাত্র প্রভুর জন্য নাকি অন্য আরও কারও জন্যে সেই অভিজ্ঞতা লাভ করি ও উপলব্ধি হয়! সেই মনে থাকা কিছু কিছু ঘটনা তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে দেখে নেবো আমরা কে কতটা সত্যি সত্যিই প্রভুর জন্যে হ'তে পেরেছি, কে কতটা 'ছাড়োরে মন কপট চাতুরী-----------' গানের লাইনের সঙ্গে একাত্ম হ'য়ে গানের লাইনের অন্তর্নিহিত অর্থকে জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি!
অভিজ্ঞতা *
সালটা ছিল ২০১৮। একবার শরীর খারাপ লাগার জন্যে এক ডাক্তারের কাছে চেক আপে গিয়েছিলাম। জায়গাটার নাম ও ডাক্তারের নাম উহ্য রাখলাম। কারণ মূল কথাটা আমার বলার মূল উদ্দেশ্য অন্য কিছু উদ্দেশ্য নয়। স্ত্রীকে নিয়ে যখন ডাক্তারের চেম্বারে গেলাম দেখলাম ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে আরও কয়েকজন পেশেন্ট বসে আছে। ডাক্তারের চেম্বার তার বাড়ির মধ্যেই। নামকরা হার্টের ডাক্তার। ডাক্তারবাবু শ্রীশ্রীঠাকুরের দীক্ষিত ও ঋত্বিক মানুষ।
মাঝেমাঝেই বুকে একটু ব্যাথা করে। সেই ব্যথা গ্যাস অম্বলের জন্য নাকি ঘুমানোর দোষে জানি না। আর এটাও জানি না সত্যি সত্যিই বুকের ব্যথা নাকি অন্য কিছু। যাই হ'ক ডাক্তারের চেম্বারে বাইরে যেখানে পেশেন্টদের বসার জায়গা সেখানে গিয়ে যখন উপস্থিত হ'লাম তখন অন্য পেশেন্টদের জিজ্ঞেস ক'রে জানলাম ডাক্তারের কম্পাউন্ডার চেম্বারের ভিতরে আছে, বাইরে এলে তার কাছে নাম লেখাতে হবে। যাই হ'ক বাইরে বসার জায়গায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর কম্পাউন্ডার বাইরে বের হলো, তাকে বললাম নাম লেখাবার কথা। সে আমাকে অপেক্ষা করতে ব'লে আবার ভিতরে চলে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর বাইরে বেরিয়ে আমার নাম লিখে নিলো আর বললো তিনশো টাকা দিতে এবং বাকী সবাইকে টাকা বের ক'রে রাখতে ব'লে আবার চেম্বারে ঢুকে গেল। আমার কাছে বড় নোট থাকায় আমি তাকে বললাম টাকা ভাঙিয়ে দিতে। সে টাকা ভাঙিয়ে দিয়ে আর অন্যদের কাছে ভিজিট সংগ্রহ ক'রে চলে গেল আবার ভিতরে। আমার একটা জিনিস দেখে খুবই অবাক লাগলো যে চেম্বারে আসার সময় থেকে এই ডাক্তারের ভিজিট দেওয়া পর্যন্ত কম্পাউন্ডার-এর ব্যবহার অদ্ভুত! চোখেমুখে কথাবার্তায় একটা কর্কশ বিরক্তি ভাব ঝরে পড়ছে! ভিজিট চাওয়ার ধরণ ও নোট ভাঙানি নিয়েও তার বিরক্তি প্রকাশ ছিল বেশ অপমানজনক! তবুও খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলাম ব্যাপারটাকে। যাই হ'ক বাইরে অপেক্ষা করছি আর যেহেতু আমি নতুন তাই পাশের পুরোনো পেশেন্টদের সঙ্গে একটু কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণ পর কম্পাউন্ডার বাইরে বেরিয়ে এসে অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় ধমকে উঠলো চুপ ক'রে থাকার জন্য ও কোনও কথা না বলার জন্যে! নিজেকে খুব অপমানিত ও ছোট ব'লে মনে হ'লো! কম্পাউন্ডারের রাফ এন্ড টাফ ব্যবহারে নিজেকে মনে হ'লো আমি যেন একটা রাস্তার লোক! নিজেকে সংযত রেখে আমি বিস্ময়ের সঙ্গে কম্পাউন্ডারকে বললাম, আপনি ওরকম ভাবে কথা বলছেন কেন!? কম্পাউন্ডার হিন্দি ভাষী তাই হিন্দিতে বললো, গলা উঁচা নেহি, গলা নিচা করো। ইঁহা বাত করনা মানা হ্যায়। আমি অবাক হ'য়ে বললাম, ম্যায়নে তো উঁচা গলামে বাত নেহি কি! আপ ঝুটমুট হামে ধমকি দে তে হো! কম্পাউন্ডার আরো কর্কশ স্বরে মুখ বিকৃত ক'রে বললো, মু বন্ধ করো আউর চুপ করকে আপনা জায়গা মে বৈঠ যাও। আমি অবাক বিস্ময়ে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, এ আমি কোথায় এসেছি!? ডাক্তারখানা নাকি গুন্ডাখানা!? আমি তার ব্যবহারে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললাম! মনে মনে ভাবলাম এই ব্যবহার যদি আমার রাজ্যে আমার এলাকায় হ'তো!? তারপর বললাম, আপ আইসা ব্যবহার করতে হ্যাঁয় কি লাগতা হ্যাঁয় কি ম্যায় আদমি নেহি হুঁ!
এরকম যখন কথা হচ্ছে তখন পর্দার ওপাশ থেকে ডাক্তারবাবুর গলা ভেসে এলো। চেম্বারটা মাঝখানে পর্দা দিয়ে পার্টিশন দেওয়া। পর্দার ওপাশে ডাক্তারবাবু বসেন আর একপাশে পেশেন্টদের বসার জায়গা। শুনতে পেলাম ডাক্তারবাবু কম্পাউন্ডারের নাম নিয়ে কর্কশ গলায় বলছেন, কৌন ইতনা বহেস কর রহা হ্যাঁয়! রূপীয়া ওয়াপস দে কে নিকাল দো! কম্পাউন্ডার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল আর একটু পড়েই বাইরে বেরিয়ে ৩০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধমকে বললো, নিকলো।
আমি স্তম্ভিত হ'য়ে গেলাম ডাক্তারের ব্যবহারে আর কথা শুনে! এও সম্ভব!? স্ত্রীকে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। দরজার বাইরে খুলে রাখা জুতো পড়তে পড়তে অপমানে লজ্জায় চোখে জল এসে গেল! জল এলো অকারণ অপমানে! জল এলো স্ত্রীর সামনে অপমানিত হওয়ায়! জল এলো এই বয়সে অপমানিত হওয়ায়! চোখে জল এলো, বুকের ব্যথাটা বেড়ে গেল এই ভেবে, ডাক্তার কোনও কিছুই শুনলো না, জানলো না, শোনার ও জানার চেষ্টাই করলো না কি ব্যাপার, কার দোষ অথচ ভেতর থেকেই পেশেন্টের মুখ না দেখেই চেম্বার থেকে বিনা চিকিৎসায় বের ক'রে দেবার নির্দেশ দিল! মাথা নিচু ক'রে অপরাধীর মত রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মনে হ'লো অকারণ অপমানিত হ'লাম অথচ কিছুই বলতে পারলাম না স্থান মাহাত্ম্যর খাতিরে কিন্তু এই ঘটনা যদি আমার রাজ্যে আমার এলাকায় হ'তো!!!!!!!!
ডাক্তার এমন হয়!? আজ পর্যন্ত কোনও ডাক্তার তাঁর চেম্বার থেকে পেশেন্তকে তা সে যতই নটরিয়াস হ'ক না কেন চিকিৎসা না ক'রে বের ক'রে দেওয়ার মত ক্ষমার অযোগ্য ঘৃণ্য অপরাধ করেছে!? তার উপরে ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সৎনামে দীক্ষিত নামী প্রতিষ্ঠিত মানুষ, ডাক্তার মানুষ, তার উপরে ঋত্বিক মানুষ এমন চরিত্রের হয়!? এমন ব্যবহার!? চিকিৎসার আগেই পেশেন্টের কাছ থেকে ভিজিট নিয়ে তাকে অপেক্ষায় রেখে পরবর্তী সময়ে কম্পাউন্ডারের অন্যায়কে স্বীকৃতি দিয়ে পেশেন্টকেই যার বয়স প্রায় ৬৫ বছরের উপর তাকে (তার উপরে হার্টের পেশেন্ট) অপমান ক'রে তাড়িয়ে দিলেন!?
এমন মানুষ ঋত্বিক!? এমন মানুষ ঠাকুরের সৎনাম প্রদান করে!? এমন মানুষ আবার সৎসঙ্গ মেডিক্যাল সেমিনারে, বিভিন্ন সৎসঙ্গ উৎসবে ঠাকুরের বাঁচা-বাড়া সম্পর্কিত বিষয়ে গুরুগম্ভীর ভাষণ দেয়!? এমন মানুষ ঠাকুরের প্রেমের কথা বলে!?
এমন মানুষ কি প্রভুর জন্যে উৎসর্গকৃত প্রাণ!? এমন মানুষ কি 'তুমি শুধু প্রভুর জন্য' বাণীর উজ্জ্বল উদাহরণ!? এমন মানুষ কি '------------ তুমি সকল মানুষের জন্য' হ'তে পারে!? এমন মানুষ সত্যিই কি 'ছাড়ো রে মন কপট চাতুরী' গান থেকে শিক্ষা লাভ ক'রে কপট মুক্ত হ'য়ে সৎসঙ্গের মিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সৎসঙ্গের পতাকা কাঁধে নিয়ে মানুষকে, সমাজকে ঠাকুরের স্বপারিপার্শ্বিক বাঁচা-বাড়ার পথ ব'লে দেবার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে!!!!?
কি বলেন সৎসঙ্গীবৃন্দ!?
আসুন মহাঅষ্টমীর শুভ লগ্নে পরবর্তী 'তুমি শুধু প্রভুর জন্য-৪' লেখায় দেখে নিই নিজেকে নিজের বিবেকের আয়নায় আর অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে বের ক'রে আনি অভিজ্ঞতা- উপলব্ধির মণি মানিক্য আর শুধরে নিই নিজের স্বভাব-চরিত্রকে।
অভিজ্ঞতা **
ক্রমশঃ
( ২১শে অক্টোবর'২০২০ )
No comments:
Post a Comment