আজ সকালে একজন এসেছিল। গল্প করতে করতে তার মনের কথা বলছিল। মন দিয়ে শুনছিলাম তার কথা। রবিবারের সকাল! তাই চায়ের আসরে জমে উঠেছিল কথা। সেই আসরে এসে যোগ দিয়েছিল আরও দুজন গুরুভাই। সঙ্গে ছিল পরিবার। সেই গল্প কথার মধ্যে ছিল অভাব অভিযোগ। অভাবের কথার চেয়ে ছিল বেশী অভিযোগ। মানুষ চিনতে না পারার অভিযোগ, অনুযোগ। শুনতে শুনতে মনে হ'লো এই অভিযোগ, অনুযোগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার সমগ্র জীবন। তাকে কিছু বললাম না। কারণ তাকে কিছু বললে সে মনে করতো যে তার কথা আমি কাটছি। তাই তাকে আমি কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। তারপরে অনেক কথার পরে তাকে যে কথাগুলি বলেছিলাম তা এখানে লেখার আকারে তুলে ধরতে ইচ্ছে হ'লো। তাই কি বোর্ডে আঙ্গুল রাখলাম। এছাড়াও মাঝে মাঝে ফেসবুকে দেখতে পাই 'মানুষ চেনা বড় কঠিন', 'ছোটোবেলায় গরু রচনা পড়েছিলাম তাই গরু চিনতে ভুল হয়না, মানুষ রচনা পড়িনি তাই মানুষ চিনতে ভুল হয়'---এমন ধরণের নানা পোষ্ট।
তখন ভাবি, আমরা ভুলে যাই এই সব কথা যারা বলে ও পোষ্ট করে সে নিজেও একজন মানুষ আর আমি আপনি যারা শেয়ার করছি বা কমেন্ট করছি তারাও সেই মানুষ।
আমি মনে করি আমি নিজেই নিজেকে চিনতে পারলাম না এখনো এই বয়স পর্যন্ত অন্য মানুষকে চিনবো কি করে? কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখায়। যে নিজেকেই চিনতে পারেনি, যে নিজের স্বভাবের মধ্যেই যে কালো অন্ধকার দিকগুলি আছে তার সন্ধান পায়নি, যে নিজের মধ্যে যে মনুষত্বের অভাব সেই অভাবের ঘাটতিকে পূরণ করতে পারেনি, পারেনি অমানুষ সুলভ ব্যবহারকে দূর করতে, যে পারেনি নিজের অনিয়ন্ত্রণ মনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, যে পারেনি নিজের জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত কিটকে খুঁজে বের ক'রে হত্যা করতে, যে মানুষ মানুষ অর্থই জানেনি, জানেনি মানুষ শব্দের মধ্যে আছে মান এবং হুঁশ আর সেই মান মানে যে অস্তিত্ব (Existence) হুঁশ মানে যে চেতনা (Conciousness) সেই জ্ঞানই যখন নেই যে মানুষের সেই মানুষ কি ক'রে চিনবে অন্য মানুষকে!? সে তো নিজেকেই চেনে না, জানে না, বোঝে না, দেখে না, শোনে না নিজের বিবেকের কথা (অবশ্য বিবেক ব'লে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে) সেই মানুষ চিনবে কি ক'রে অন্য মানুষকে? জানবে কি ক'রে অন্য মানুষের মনের মধ্যে কি আছে লুকিয়ে? বুঝবে কি ক'রে অন্য মানুষের চরিত্র? আমার চরিত্রই যেখানে গিরগিটির চেয়েও ভয়ঙ্কর, গিরগিটি কি আর রঙ পাল্টায় তার চেয়েও ভয়ঙ্কর রকমের ঘনঘন রঙ পাল্টায় আমার যে চরিত্র সেই আমি কি মানুষ চিনবো? অবশ্য যে মানুষ নিজেই হাজার দোষে দোষী সে কি অন্য মানুষের দোষ ধরতে পারে নাকি ধরা শোভা পায়? এইটাই দূর্ভাগ্য যে, যে মানুষের চোখ বৃত্তি-প্রবৃত্তির জন্ডিস রোগে আক্রান্ত, যে মানুষ বৃত্তি-প্রবৃত্তির রসে টইটম্বুর, টানে বেসামাল সে সেই হলুদ চোখ দিয়ে, রসে টইটম্বুর বেসামাল জীবন দিয়ে
অন্যের জীবনের, অন্যের মনের বেসামাল অবস্থা ধরবে কি ক'রে? ধরতে পারে না।
তাই কাউকে চেনার আগে নিজেকে চেনা অত্যন্ত জরুরী। যেটা কেউ আমরা করি না। শুধু অন্যের দিকে আঙ্গুল তুলি আর ভুলভাল কথা ব'লে ভুল ক'রে চলেছি জীবনভর আর দুঃখ কষ্টের জালে জড়িয়ে পড়ছি ক্রমশ অক্টোপাশের মত। আসুন আগে নিজেকে চিনি, জানি, বুঝি তারপর অন্যকে নাহয় চিনতে যাবো, জানতে যাবো, বুঝতে যাবো। নিজেকে যে প্রতিমুহূর্তে নিজের চলায়, বলায়, করায়, ভাবনায় নিরখ পরখ করে, নিজের দোষত্রুটি খুঁজে নিয়ে নিজেকে শুধরে নেয় তখন সে অন্য মানুষকে চিনতে পারে, জানতে পারে, বুঝতে পারে।
তাই মনকে বলি, মন চলো নিজেকে পাল্টাই।
আবার প্রশ্ন জাগে মনে, নিজেকে পাল্টাবো কি ক'রে? চলো পাল্টাই, বললেই তো আর নিজেকে পালটানো যায় না। যায় কি? যায় না। অনিয়ন্ত্রিত বৃত্তি-প্রবৃত্তির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। একজন জীবন্ত মানুষ থাকতে হয় জীবনে যাকে আমরা জীবন্ত আদর্শ বলি সেরকম একজন মানুষের প্রয়োজন হয় জীবনে। সে যে কেউ হ'তে পারে। মা-বাবা বা অন্য কেউ গুরুজন হ'তে পারে, শিক্ষক বা কোনও ধর্মগুরু বা আধ্যাত্মিক গুরু হ'তে পারে। কিন্তু যেই-ই হ'ন না কেন তাঁকে নিজের বৃত্তি-প্রবৃত্তির ওপর দখল থাকতে হবে।
কিন্তু যিনি বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধীশ্বর, ষড়রিপু যার করায়ত্ত সেই তিনিই একমাত্র হ'তে পারেন মানুষের জীবনে আদর্শ, শ্রেষ্ঠ আদর্শ, সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাঁর ওপরে কেউ নেই। সেই তিনিই জীবন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ, জীবন্ত ঈশ্বর, তিনি পুরুষোত্তম। আবার বলি তিনি কিন্তু মহাপুরুষ নন, তিনি পুরুষোত্তম।
আর, তাঁকে জীবনে গ্রহণ ক'রে তাঁর চলনপূজায়----চরণপূজায় নয়----- নিজেকে নিয়োজিত করতে হবে। তবেই মানুষ বুঝবে মানুষের অর্থ, তবেই মানুষ পারবে তাঁর চলনকে নিজের চলনে রাঙ্গিয়ে নিতে। তখনি হবে চলো নিজেকে পাল্টাই স্লোগানের স্বার্থকতা। নতুবা সবটাই হবে ভস্মে ঢালা ঘি।
এখন অন্তিম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সেই বৃত্তি-প্রবৃত্তির অধীশ্বর, ষড়্রি্রিপু যার করায়ত্ত সেই তিনি কে? কে সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ? কে সেই সেই জীবন্ত ঈশ্বর? কে সেই পুরুষোত্তম?
উত্তরঃ সেই তিনি হ'লেন পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীরামচন্দ্র, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, যীশু, মোহাম্মদ, মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ ও সেই যুগে যুগে আসা একই রূপ কলিযুগের সর্বশেষ রূপ পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র।
সেই তাঁকে গ্রহণ করতেও পারে মানুষ আবার নাও পারে, মানতে পারে আবার নাও মানতে পারে, বিশ্বাস-অবিশ্বাস যা ইচ্ছা করতে পারে তাতে সৃষ্টির কালচক্র থেমে থাকবে না। সে ছুটতে থাকবে তার আপন নিয়মে। আপন গতিতে। মানা, না-মানা, গ্রহণ-বর্জন, বিশ্বাস-অবিশ্বাস ব্যক্তিগত। কারণ মানুষ স্বাধীন আর পরমপিতা এই জায়গায় তাঁর সৃষ্ট জীবদের স্বাধীনতা দিয়েছেন। পুরুষোত্তম একমাত্র গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ আর গণতান্ত্রিক তাঁর ব্যবস্থা। তাই যার যা ইচ্ছা সে তাই করতে পারে। ফল হবে কর্মানুযায়ী।
তাই আবার বলি, চলো সময় থাকতে পাল্টাই।
No comments:
Post a Comment