আজ, ২০১৬ সালের একটা ঘটনার কথা বলি, সেবারও গিয়েছিলাম প্রতিবারের মতো ঠাকুরবাড়ি। প্রতিবারের মতো সেবার গিয়েছিলাম ছেলেমেয়ের দু'জনের নোতুন আর এক জায়গায় চাকরীতে জয়েন করার কথা শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কাছে নিবেদনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন শ্রদ্ধেয় শান্তিদার কাছে খবর নিয়ে জানলাম শ্রীশ্রীবাবাইদাদা সেদিনই বেরিয়ে গেছেন বাইরে। এক ঝটকায় মনটা ভেঙে চুরমার হ'য়ে গেল। হতাশা আর অবসাদে ঢেকে গেল শরীর-মন। ছেলেমেয়ে অস্থির হ'য়ে পড়লো। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। কান্না ভেজা গলায় মেয়ে বললো, বাবা কি হবে? আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না। ছেলে চুপ ক'রে আছে কোনও কথা বলছে না। কারণ এখান থেকে ফিরে গিয়েই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ছেলেমেয়ে দু'জনকেই নোতুন জায়গায় জয়ন করবে কি করবে না। স্ত্রী ছেলেমেয়েদের আশ্বাস দিয়ে বললো, চিন্তা করিস না। কোনওবারই খালি হাতে ফিরে যাইনি। এবারও ঠাকুর একটা কিছু নিশ্চয়ই ব্যবস্থা ক'রে রাখবে। বরাবরই স্ত্রীর বিশ্বাস একটু গভীর। সেসময় আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদার কাছে নিবেদনের পরিবর্তে শ্রীশ্রীবাবাইদাদার কাছে সমস্ত কিছু নিবেদন করতে হ'তো। তাই স্ত্রীর কথা শুনে মনে মনে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলাম, যে মানুষটার কাছে নিবেদন করবো সেই মানুষটাই যখন নেই তখন কা'কে আর নিবেদন করবো?
যাই হ'ক, ঠাকুর, বড়মা ও বড়দা প্রণাম ক'রে এসে উঠলাম সেন্টিনারিতে। সেখানে এসে নাম অ্যাড্রেস এন্ট্রি ক'রে নির্দিষ্ট ঘরে এসে বসলাম। শ্রীশ্রীবাবাইদাদা নেই শুনে আর কারও কিছু খেতে ইচ্ছে করলো না। সঙ্গে যা ছিল তাই-ই সামান্য খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো না। এমনভাবে রাত কেটে গেল।
ঘড়িতে তখন ভোর সাড়ে চারটে। কিন্তু তখনও অন্ধকার। মেঘলা আকাশ। ঝিরঝির ক'রে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সেন্টিনারির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেয়ে আছি বাইরের রাস্তার দিকে। প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে ছুটে চলে যাচ্ছে ট্রাক। ট্রাকের আলোয় বৃষ্টির ধরণটা চোখে ধরা পড়ছে। বাইরে ফাঁকা। কেউ কোথাও নেই। একটানা শুধু বৃষ্টির শব্দ। মনের ভিতরটা বড় অস্থির হ'য়ে রয়েছে। হালকা বাতাস বইছে। চোখে মুখে এসে বাতাস তার ঠান্ডা হাত বুলিয়ে যেন শুষে নিচ্ছে দুশ্চিন্তাযুক্ত ক্লান্তির মেঘ! মনে হ'ল যেন আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম ঐ বৃষ্টিঝরা আলোআঁধারি ভোরের আকাশে প্রভু যেন বাতাস হ'য়ে এসে কানে কানে ব'লে গেলো, 'চিন্তা কিস বাত কি? হাম হ্যাঁয় না!' আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়েছিলাম রাস্তা ও আশপাশের গাছগাছালি, বাড়িঘর ও আকাশের দিকে। কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেমেয়ে বুঝতে পারিনি। ওদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। 'বাবা! কি হবে!? বৃষ্টি যে প'ড়েই চলেছে।' উৎকণ্ঠা গলায় কথা বললো মেয়ে। আমি চেয়ে দেখলাম মেয়ে আমার খুবই চিন্তিত। কারণ আজ যদি সকালে বেরোতে না পারি তাহ'লে কাল বাড়ি ফিরে যাবার দিন। খালি হাতে ফিরে যেতে হবে এবার ঠাকুরবাড়ি থেকে! ছেলে বললো, 'বাবা প্রার্থনার সময় হ'য়ে গেছে আর বাইরেও বৃষ্টি পড়ছে জোরে, আজকে আর যাওয়া যাবে না। ঘরে চলো।' আমি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মতি জানিয়ে ঘরে প্রবেশ ক'রে বিছানার উপর বসে পড়লাম। আর তার কিছুক্ষণ পরেই ভেসে এলো ঠাকুরবাড়ির সমবেত প্রার্থনা। সত্যি বলতে কোনও লজ্জা নেই, প্রার্থনায় মন বসছিল না; শুধু মনে মনে বলছিলাম, 'ঠাকুর! বৃষ্টি থামিয়ে দাও। প্রার্থনার শেষে যেন মন্দিরে যেতে পারি।' একসময় প্রার্থনা শেষ হ'লে আমরা বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম বৃষ্টি থেমে গেছে কিন্তু আকাশ বাদল মেঘে ঢেকে আছে। আমরা সবাই ঘরে তালা দিয়ে মন্দিরে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম এই ভোরের বৃষ্টিভেজা রাস্তায় লোক সমাগম কম। আমরা আশ্রমের গেট পেরিয়ে সোজা হেঁটে চললাম। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, কার কাছে যাচ্ছি কিছুই জানা নেই কারণ বাবাইদাদা তো আজ দর্শন দেবে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত এক অমোঘ টানে আমরা তিনজনে এগিয়ে চলেছি। স্ত্রী সঙ্গে নেই। সে অনেক আগেই প্রার্থনা শেষ হতেই বেরিয়ে পড়েছে বাবাইদাদা বসবেন কিনা তা জানবার জন্যে। আশা, যদি বসেন। মেমোরিয়ার পাশ দিয়ে যাবার সময় ছেলে বললো, 'বাবা কাল একটা স্বপ্ন দেখলাম।' সঙ্গে সঙ্গে মেয়েও বিস্ময়ে ব'লে উঠলো, 'তুই দেখেছিস! আমিও স্বপ্ন দেখেছি! তুই আগে বল, তারপরে আমি বলবো।' ছেলে ব'লে চললো তার স্বপ্নের কাহিনী। আমি বললাম, চল আগে ঠাকুর প্রণাম করে আসি। ঠাকুর, বড়মা, বড়দা প্রণাম সেরে এগিয়ে চললাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। ছেলে শুরু করলো তার স্বপ্নের কথা। প্রথমে আমি স্বপ্নে দেখা গল্পে মন দিতে পারছিলাম না। মন পড়ে রয়েছিল অন্য এক জায়গায়; শুধু মন বলছিল, 'ঠাকুর! কি হবে! কি করবো ঠাকুর!' হঠাৎ মনটা আটকে গেল এক জায়গায়। ছেলে আমার সঙ্গে পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলছে, 'বাবা! ঐ জায়গায়! ঐ জায়গায়!' মুখ ঘুরিয়ে বললাম, 'কি ঐ জায়গায়? ছেলে বললো, 'এই যে এতক্ষণ বললাম, তুমি শোনোনি?' আমি একটু লজ্জিত হ'য়ে বললাম, 'না, মানে ইয়ে.........।' ছেলে বললো, 'ও বুঝেছি।' আমি বললাম, 'বল না কি বলছিলি। আমি একটু অন্যমনস্ক হ'য়ে গেছিলাম। তাই......, এই জায়গায় কি হয়েছে? ছেলে বললো, কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, ঠিক এই মেমোরিয়ার পাশ দিয়ে আমি বাবাইদাদার সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছি। বাবাইদাদা আমাকে খুব বকছে। জোরে ধমক দিয়ে বলছে, 'কোথাও যেতে হবে না। এখন যেখানে আছো সেখানেই থাকো। চুপ ক'রে মুখ বুঝে সেখানেই কাজ করো মন দিয়ে। কেন এখানে কি ভালো লাগছে না? এখানে কি হয়েছে? এখন কোথাও চেঞ্জ করার দরকার নেই।'
আমি এই কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক হ'য়ে গেলাম। ছেলে কি বলছে! উৎসাহে, আনন্দে, বিস্ময়ে আমি আবার শুনতে চাইলাম স্বপ্নের বিষয়। ছেলে আবার বললো স্বপ্নে দেখা ঘটনা। বললো, আমি বারবার নানাভাবে কোম্পানি চেঞ্জ করার মনোভাব প্রকাশ করায় বাবাইদাদা রেগে গেলেন। আমি চুপ ক'রে গেলাম। তারপর পিঠে তাঁর হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে খুব নিচুস্বরে মিষ্টি ক'রে বললেন, 'এখানেই থাক, কোথাও এখন যাবার দরকার নেই; যা হবার এখানেই হবে, ভালো হবে।' বাবাইদাদার কোমল হাতের স্পর্শে শরীরে শিহরণ খেলে গেল। মনে হ'ল হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ যেন বইয়ে গেল শরীরের শিরায় শিরায় এক লহমায়। চমকে মুখ তুলে তাকালাম বাবাইদাদার মুখের দিকে। দেখলাম স্মিথহাস্যে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আর হাসিতে ঝরে পড়ছে হাজার চাঁদের আলোর ঝর্ণা! আর তখনই ঘুমটা ভেঙে গেল। এক নিশ্বাসে কথাগুলি ব'লে থামলো ছেলে আমার। আমি অবাক হ'য়ে শুনছিলাম কথাগুলি। মনে মনে ভাবলাম একেই কি বলে, Divine dictation!? তারপর আর কিছু ভাবতে পারলাম না। মনে মনে খুব খুশী হ'লাম। যাক ঠাকুর মুখ তুলে অন্তত চেয়েছে। ঠাকুর শুনেছে আমার প্রার্থনা। আজ আর কিছু হ'ক আর না হ'ক, বাবাইদাদার দর্শন.............. পাই আর নাই পাই, চাকরীর ব্যাপারে ছেলে আমার সিদ্ধান্ত পেয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হীনতায় আর আমার ছেলেকে ভুগতে হবে না বা ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার হাত থেকে ছেলে আমার বেঁচে গেল। ঠাকুর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। চলতে চলতে দু'হাত জোর ক'রে তাঁর উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালাম। আর তখনই কানের পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে ভর ক'রে কে যেন ব'লে গেলো, 'যার জীবনে যত ভুল কম, তার জীবনে তত সুখ বেশী।'
আমরা তখন চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি বাবাইদাদা যেখানে দর্শন দেন সেখানের উদ্দেশ্যে যদি হঠাৎ দর্শন দেন এই আশায়। তখন যেতে যেতে মেয়েকে বললাম, 'তুই কি স্বপ্ন দেখেছিস?' মনের মধ্যে লাড্ডূ ফুটে চলেছে অনবরত যদি এমন কিছু মেয়ের বেলায় হয় এই লোভে। মেয়ে তার ভাইয়ের মুখের দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। মুখে কোন কথা নেই। মনে হচ্ছে যেন, ভাইয়ের কথা বিশ্বাসই করতে পাচ্ছে না। বিস্ময়ে জোরে চেঁচিয়ে ছেলেকে ব'লে উঠলো, তুই সত্যি বলছিস? ছেলে বললো, হ্যাঁ। মিথ্যা বলবো কেন? ভাইয়ের কথা শুনে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে মেয়ে বললো,'বাবা! আমাকেও বাবাইদাদা বলেছে, কিন্তু আমাকে বকেনি।' আমি বিস্ময়ে বলে উঠলাম, তাই নাকি!? 'কি বলেছে বল, বল!' আমার আর ধৈর্য ধরলো না। আমি মেয়েকে ব'লে উঠলাম। মেয়ে আনন্দে যা বললো তা'তে মাথা ঘুরে গেল। বাবাইদাদা দুজনকেই তাদের সমস্যার সমাধান দিয়ে দিয়েছেন। যদি বিশ্বাস করি তাহ'লে যে সমাধান তিনি সামনে উপস্থিত থেকে দিতেন সেই সমাধান তিনি দিয়েছেন স্বপ্নে! এর থেকে আর কি বড় আশীর্বাদ হ'তে পারে আমাদের জীবনে বাস্তবে! মেয়ে বলতে লাগলো, 'আমি বাবাইদাদাকে নতুন কাজের জায়গায় জয়েন করার অফার গ্রহণ করবো কিনা জিজ্ঞেস করলাম। বাবাইদাদা ঐ নতুন কোম্পানী সম্পর্কে জানতে চাইলেন বিস্তারিত। আমি 'ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড' সম্পর্কে, কাজের সম্পর্কে, স্যালারী সম্পর্কে সব বললাম। সব শুনে তিনি হাসি মুখে সম্মতি দিলেন ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড'-এ জয়েন করতে।'
আমি চুপ ক'রে শুনছিলাম কথাগুলি। আমরা কথা বলতে বলতে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি। একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে যেন চলেছি আমি। এও কি সম্ভব! এইভাবেও কি সমাধান পাওয়া যায়! চারপাশে ঠান্ডা একটা বাতাস ব'য়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস মন প্রাণ দেহ সব জুড়িয়ে দিচ্ছে। ভোরের আলো তখনও মেঘলা আকাশের জন্য ফুটে উঠতে পারছে না। মুখের ওপর হালকা হাওয়া হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে পুষ্পবৃষ্টির মত ঝিরঝিরে বৃষ্টি ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে মিশে এসে চোখে মুখে পড়ছে। একটা হালকা আলো অন্ধকারের চাদর যেন গোটা আশ্রমটাকে ঘিরে রেখেছে। চারপাশের গাছগাছালির ঘিরে আলোআঁধারি ঠান্ডা নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন রুপকথার রাজ্যে নিয়ে এসেছে আমাদের। মনে হচ্ছে আমি যেন স্বর্গের বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছি। আমি হাঁটছি না, আমায় যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই ঘোর লাগা অবস্থাটা যেন চেপে বসছে ক্রমশঃ। আমার এইরকম চলা দেখে ছেলে বললো, 'বাবা, তোমার শরীর খারাপ লাগছে?' আমি থতমত খেয়ে ব'লে উঠলাম, 'না, না।' ঠিক সেই সময় হঠাৎ পাশ দিয়ে একটা এনফিল্ড বাইক হুশ ক'রে বেরিয়ে গেল। মেয়ে সেদিকে তাকিয়ে উত্তেজনায় বলে উঠলো, 'বাবা! বাবা! অবিনদাদা গেল, অবিনদাদা গেল।' আমি কথাটা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম। চমকে বলে উঠলাম, 'কোথায়!? কোথায়!? দেখলাম, বাইকটা আমাদের যাওয়ার পথের উল্টো দিকের সামনের গোশালার পাশ দিয়ে এসে ফোয়ারার দিক দিয়ে গিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। তারপর রাস্তার বাঁ পাশের শ্রীশ্রীঠাকুরের সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে পিছনে ভিতরের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো। আমি বললাম, 'ঠিক দেখেছিস তো?' ছেলে তার উত্তরে সম্মতি জানিয়ে বললো, 'হ্যাঁ বাবা, অবিনদাদাই গেলো।' মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম রাস্তার ভিতরের ঐ ফাঁকা জায়গায় গাছের নীচে বাইকটা দাঁড় করিয়ে বাইকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অবিনদাদা; মনে হ'লো কারও জন্য অপেক্ষা করছে। আমি তখন দ্বিধাগ্রস্থ। অবিনদাদার কাছে যাবো কি যাবো না, কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে মনে ভাবলাম, ঠাকুর তুমি এত দয়াময়! তুমি কি আমার প্রার্থনা শুনেছো! বাড়ি থেকে আসার সময় এবং এখানে এসে গতকাল বাবাইদাদার শরীরের কারণে দর্শন না দেওয়ার কথা জানতে পেরে যা ভেবেছিলাম, ঠাকুরের কাছে যা প্রার্থনা করেছিলাম এইটা কি তারই ইঙ্গিত!!!!! মনে মনে ভাবছি, যাবো, কাছে যাবো? এই ভোরের আলোআঁধারির চাদরে ঢেকে থাকা মেঘলা আকাশের নির্জন ফাঁকা জায়গায় অবিনদাদা দাঁড়িয়ে আছেন একেলা, কাছে পিঠে কেউ নেই, রাস্তা দিয়েও কেউ যাচ্ছে না। আমি অবাক হ'য়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম অবিনদাদার দিকে চেয়ে। মনে মনে একটা লজ্জাও লাগছিল; কি জানি তিনি কি মনে করছেন। আমাদের দিকে চেয়ে আছেন তিনি। একটা রহস্যময় পরিবেশ যেন মুহূর্তে তৈরী হ'য়ে গেলো। মনের মধ্যে তোলপাড় হ'তে লাগলো, এত ভোরে কেন তিনি এখানে, কেন তিনি!? 'এখন কি করবো' এইকথা ছেলেমেয়েদের বলাতে তারাও বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে, কি বলবে। দেখলাম, অবিনদাদা স্থির দাঁড়িয়ে আছে ঐ গাছের আলোআঁধারি ছায়ায়। একবার দেখলাম, মুখ ঘুরিয়ে যেন আমাদের দিকে তাকালো। আমি আর কোনওকিছু না ভেবেই অনেকটা নেশাগ্রস্থের মত ছেলেমেয়েদের নিয়ে হেঁটে চললাম অবিনদাদার দিকে। যা হবে হ'ক। ঠাকুরের এইটাই ইচ্ছা। নইলে এইসময় এই প্রাকৃতিক পরিবেশে তিনি এখানে এলেন কেন!? তবে কি আমার প্রার্থনা পূরণ ক'রে দিলেন দয়াল ঠাকুর!?
'তাঁর ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা' এইভেবে এগিয়ে গেলাম ছেলেমেয়েদের নিয়ে; কাছে গিয়ে প্রণাম করলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ' এরা আমার ছেলেমেয়ে। বাবাইদাদার কাছে এসেছিলাম ছেলেমেয়ের চাকুরী সংক্রান্ত বিষয়ে কি করবে সেই সম্পর্কে আশীর্বাদ নিতে। কিন্তু এসে শুনলাম বাবাইদাদা শরীরের কারণে দর্শন দেবেন না। তিনি নেই। তাই কি করবো বুঝতে পারছি না। প্রতিবার তাঁর কাছে ওরা নিবেদন করে। আজ ছেলেমেয়ে খুব হতাশ হ'য়ে পড়েছে, খুব চিন্তাগ্রস্থ, তাই আপনার কাছে এলাম।' অবিনদাদা বললেন, 'হ্যাঁ, বাবার শরীরটা একটু খারাপ, তাই ক' দিন দর্শন দেবেন না। কলকাতায় গেছেন'। তারপর খুব মিষ্টি ক'রে ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, 'কি হয়েছে?'
অবিনদাদার মুখের হাসির দিকে চেয়ে মনে হ'ল, এই আলোআঁধারি মাঝে হাজার সুর্যের জ্যোতিঃ যেন ঝরে পড়ছে। মুহূর্তে যেন অন্ধকার কেটে আলোয় ঝলমল ক'রে উঠলো চারপাশ!!!!!!
অবিনদাদার প্রশ্নের উত্তরে আমি মেয়েকে দেখিয়ে বললাম, 'ও বাবাইদাদাকে ওর চাকরীর সমস্যার কথা বিস্তারিতভাবে আগে জানিয়েছিল। ও যেখানে বর্তমানে কাজ ক'রে সেখানে যেতে আসতে ছ’ঘন্টা সময় লাগে। ক্লান্ত হ'য়ে পরে। বাবাইদাদা সব শুনে মেয়েকে আশীর্বাদ ক'রেছিলেন। বলেছিলেন, সব ঠিক হ'য়ে যাবে। ঠাকুরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে, নির্ভর করতে। বাবাইদাদার আশীর্বাদের পরেই 'ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড' থেকে সেখানে জয়েন করার জন্য অফার এসেছে। পয়লা আগস্ট থেকে জয়েন করতে বলেছে। তাই এসেছিল বাবাইদাদাকে জানাতে সেখানে জয়েন করবে কিনা। কিন্তু এসে জানতে পারলো বাবাইদাদা দর্শন দেবেন না। তাই আপনি যদি............... বলেই চুপ করে গেলাম। শুধু মেয়েকে বললাম, 'তুই বল।‘
মেয়ে চোখের জল মুছে বললো, 'আমি এখন যেখানে কাজ করি সেখানে যেতে আসতে ছ’ঘন্টা লাগে। খুব কষ্ট হয়। বাবাইদাদাকে কষ্টের কথা সব জানিয়েছিলাম। আমি আর পারছি না। যেতে ৩ঘন্টা, আসতে ৩ঘন্টা, ৬ঘন্টা লেগে যায়। বাবাইদাদা সব শুনে বলেছিলেন, ‘এইভাবে কন্টিনিউ করলে জীবনীশক্তি ক’মে যাবে।‘ তখন আমি বলেছিলাম, আপনি আশীর্বাদ করুন যেন আমি কাছাকাছি পেয়ে যায়।‘ বাবাইদাদা বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, চেষ্টা কর। ঠাকুরের প্রতি বিশ্বাস রাখ।‘ বাবাইদাদা আশীর্বাদ করেছিলেন গত মাসে আর তারপরেই আমি কোনও যোগাযোগ না করা সত্ত্বেও ‘ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড’ থেকে অফার এসেছে সেখানে জয়েন করবার জন্য। তাই আমি জয়েন করবো কিনা বাবাইদাদাকে জানাতে এসেছিলাম; কিন্তু বাবাইদাদার.........‘ এই পর্যন্ত ব’লে মেয়ে আমার চুপ ক’রে গেল। তারপর বললো, ‘আমি জয়েন করবো?’ তখন অবিনদাদা মেয়ের কাছে জানতে চাইলেন চাকরী সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়। মেয়ে ‘ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড’ সম্পর্কিত বিষয় ও কাজের বিবরণ, ডিপার্টমেন্ট, পজিশান, মাহিনা, বাড়ি থেকে দূরত্ব, যেতে আসতে সময় ইত্যাদি সব একে একে যেমন যেমন অবিনদাদা জানতে চাইলেন ঠিক তেমনি তেমনি মেয়ে তাঁর কাছে তুলে ধরলো। আমি আর আমার ছেলে ওদের কথার মাঝে পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনলাম। আমি অবাক হ’য়ে মনে মনে ভাবছিলাম এই অল্প বয়সে (১৬ বছর) একজন কত পরিণত হ’লে, কত মেধার অধিকারী হ’লে চাকুরী সংক্রান্ত এত নিখুঁত আলোচনা করতে পারে! কত আত্মমগ্ন ধীরস্থির হ’লে, কত শারীরমানস ও আত্মিকতায় মিশে জমাট ক্ষীর হ’লে তাঁর চেয়ে বয়সে বড় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা দিশেহারা একজন চাকুরিরতা মেয়েকে সহজ নিখুঁত সমাধান দিতে পারে তা’ নিজের চোখে, নিজের কানে না দেখলে, না শুনলে বিশ্বাস হ’ত না! মেয়ের মুখে পরপর সব শুনে অবিনদাদা মেয়েকে হেসে বললেন, ‘আপনি ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ডে জয়েন করুন। পরে সময়মত একবার এসে বাবাকে জানিয়ে আশির্বাদ নিয়ে যাবেন।‘ মেয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অনেকদিন পর মেয়েকে এমন নির্মল হাসি হাসতে দেখে আমার মন আনন্দে ভরে উঠলো। তারপর হাসতে হাসতে ছেলের দিকে তাকিয়ে অবিনদা বললেন, ‘তোর কি হয়েছে?’ ছেলে একবার আমার দিকে আর একবার অবিনদার দিকে তাকালো, কি করবে বুঝে উঠতে সময় নিচ্ছিলো। আমি ছেলেকে হাত ধ’রে কাছে টেনে নিলাম। বললাম, অবিনদাদাকে বল তোর কথা। ছেলে সাহস ক’রে তার বর্তমানে যেখানে চাকরী করে সেই ফ্রেঞ্চ মাল্টিন্যাশানাল সারভিসেস অ্যান্ড বিজনেস কন্সাল্টিং করপোরেশানের ক্যাপজেমিনির কথা জানিয়ে অন্য আর এক আমেরিকান মাল্টিন্যাশানাল করপোরেশান আই টি সেক্টরে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় অবিনদা মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করেই সরাসরি বললেন, ‘কেন এখন যেখানে আছিস সেখানে কি খারাপ আছিস? কোনও অসুবিধা হচ্ছে? উত্তরে ছেলে যা বললো তা হ’লো,
এখন যেখানে চাকরী করছে সেই চাকরিটা বাবাইদাদার আশীর্বাদে পেয়েছিল। চাকরিটা পাবার পর কিছুদিন খুব অসুবিধা হয়েছিল, চাকরিতে টিকে থাকাটাই প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কেউ কো-অপারেট করতো না। একা একা বসে থাকতো। কাজ না বুঝতে পারলে কেউ এগিয়ে এসে কাজ বুঝতে সাহায্য করতো না। ভুল না হ’লেও বলতো ভুল হয়েছে আর সামান্য ভুল হ’লে বড় ক’রে দেখাতো। কাজ যাতে না বুঝতে পারে, না করতে পারে তার জন্য পুরোনো কর্মীরা সবসময় সচেষ্ট থাকতো। সারাদিন কাজ ক’রেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণিত হ’তো না, আর যারা কিছু করতো না, শুধু ম্যানেজারের ঘরে বসে থাকতো, ফাইফরমাশ খাটতো তারা হাইলাইট হ’তো। এমন অবস্থায় মানসিক বিপর্যস্ত হ’য়ে ঠাকুরবাড়ি ছুটে এসেছিল বাবাইদাদার কাছে। বাবাইদাদার কাছে নিবেদন করেছিল সমস্যার কথা। বাবাইদাদা তখন ছেলেকে বলেছিলেন, ‘যারা কাজ করে, যারা কাজে যোগ্য তাদের ম্যানেজারের দয়ার দরকার হয় না; ফেবার তাদের দরকার হয় যারা অযোগ্য ও অদক্ষ, যারা কাজে ফাঁকি দেয়। তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছে সেই কাজ তুমি মন দিয়ে ক’রে যাও। অন্য কোনও দিকে মন দিতে যেও না। তোমার কাজ শুধু তোমার কাজ মন দিয়ে করা আর সকলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা।‘ তারপর থেকে বাবাইদাদার নির্দেশ মতো শুধু কাজের দিকেই মন দিয়েছে ছেলে; আর, তার পুরস্কার স্বরূপ বাবাইদাদার আশীর্বাদে পরবর্তী ছ’মাসের মধ্যে ‘Employee of the year’ নির্বাচিত হয় এবং পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কৃত হয়। পরে কাজের ফলস্বরুপ উন্নতিও হয়। পরবর্তী সময়ে সেই কথা বাবাইদাদাকে নিবেদন করে এবং পুরস্কৃত অর্থ ঠাকুর প্রণামী হিসাবে ফিলান্থ্রপি অফিসে জমা দেয়। বাবাইদাদা খুব খুশী হন।
ছেলের সমস্ত কথা মন দিয়ে শোনার পর অবিনদা ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহ’লে কর্মস্থল পরিবর্তন করার দরকার কি? শোন, এখন পকেটে যা ঢুকছে তা’তে কি ভালো লাগছে না? ওখানে জয়েন করার কিছুদিন পরে লাথি মেরে বের ক’রে দিলে ভালো হবে? একূল, ওকূল দুকূল যাবে নাকি?
শোন, এখন যেখানে কাজ করছিস বা যেখানে যেতে মন চাইছে তা' যেখানেই থাক বা যা না কেন কোম্পানির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে হয়, যাতে পরে কোনও অসুবিধা না হয়। যদি যেতে হয় তাহ’লে কোম্পানিকে ব’লে যাওয়া উচিত। আর এক্ষেত্রে ঐ কোম্পানিকে যে কোম্পানি তোকে অফার দিয়েছে তাঁকে বলা উচিত এখন আমি যেতে না পারলেও ভবিষ্যতে আমি যোগাযোগ করবো। শোন, এখন এখানেই মন দিয়ে কাজ কর।‘ ঠিক আছে?
তারপরে প্রায় একই রকম এক ঘটনার কথা তুলে ধ’রে বললেন,
‘আমার এক পরিচিত মাইক্রো সফটে কাজ করে। গুগুল আরও বেশী টাকার অফার দিয়ে তাকে তাদের কোম্পানিতে জয়েন করতে বলে। তখন ও মাইক্রো সফট কোম্পানির ম্যানেজমেন্টকে সে কথা জানায়। মাইক্রো সফট তাকে আরও বেশী টাকা দেবে ব’লে জানায়। তখন সেই কথা সে গুগুলকে বলে এবং স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে যা পাচ্ছে তার বেশী দাবী করে। গুগুল তখন তাকে পরবর্তী সময়ের জন্য ভেবে দেখবে ব’লে জানায়। এক্ষেত্রে সে উভয়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রাখে। তুই এখন যা পাচ্ছিস তাই নিয়ে আনন্দের সঙ্গে এখানেই কাজ কর। সময়মত সব হবে। ঠিক আছে?‘
এইকথা শুনে ছেলে আমার খুশী হ’য়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। আমি বিস্ময়ে হতবাক হ’য়ে শুধু চেয়েছিলাম অবিনদার মুখের দিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাঁকে প্রণাম জানিয়ে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হ'লাম। আমাদের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবিনদাদার বয়সী একজনকে আসতে দেখলাম। তারপরে অবিনদা তাকে বাইকে বসিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে 'আসি' ব'লে কৃত্রিম পাহাড়ি ঝর্ণার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে চলে গেল। আমরা তিনজনে হাঁটতে লাগলাম বাবাইদাদা যেখানে বসেন, দর্শন দেন সেদিকের উদ্দেশ্যে কারণ ঐখানে আমার স্ত্রী গেছে খোঁজ নিতে। একটু এগোতেই সামনে দিয়ে আমার স্ত্রীকে আসতে দেখলাম। সামনে আসতেই সে বললো, ‘না, বাবাইদাদা আজ বসেননি, আগামী কয়েকদিন বসবেন না।‘ আবার একটা জোর চমকের ধাক্কা খেলাম! মনে মনে ভাবলাম, ‘ঠাকুর তুমি এত, এত দয়াময়!!!!!!” ছেলেমেয়ে তাদের মাকে অবিনদাদার সঙ্গে দেখা ও কথা হওয়ার ঘটনাটা বলবার জন্য হামলে পড়লো। আর আমার মনের মধ্যে পথ চলতে চলতে জেগে উঠলো অনেক প্রশ্ন! ‘এমনও হয়? কে তুমি!? কে তুমি!?
ছেলেমেয়ের সে কি আনন্দ! যাক আসা বৃথা হয়নি। দয়াল ঠাকুর প্রার্থনা শুনেছেন। একটা দুশ্চিন্তা ও অস্বস্তির চাপ মাথা থেকে নেবে গেল দু'জনের। মনে পড়ে গেল, দয়াল ঠাকুর প্রায়ই বলতেন, "আজও লীলা ক'রে গৌর চাঁদ রায়, কোনও কোনও ভাগ্যবানে দেখিবারে পায়।" আজ আরো একবার প্রমাণ হ'লো এই বাণীর সত্যতা! প্রমাণ হ'লো সৎসঙ্গে আচার্যদেবের লীলা! ভেসে উঠলো আচার্য পরম্পরার প্রথার মধ্যে দিয়ে পিতাপুত্রের লীলার জ্বলন্ত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সংকেত!
ছেলেমেয়ের আনন্দে আমারও আনন্দ হ'তে লাগলো। সারাক্ষণ কে যেন মনের মধ্যে এসে ব'লে যেতে লাগলো, আচার্যদেব শ্রীশ্রীদাদা আছেন দেওঘরে কিন্তু বর্তমানে যাকে নিবেদন করা হয় সেই শ্রীশ্রীবাবাইদাদা তিনি নেই এখন দেওঘরে, তিনি কলকাতায় অথচ সমাধান দিলেন ১৬বছরের একটি অত্যাশ্চর্য ছেলে, যাকে সৎসঙ্গীরা অবিনদাদা ব'লে ডাকেন। কেন এমন হয়!? শ্রীশ্রীদাদা তখন তিনি আজকের মত দর্শন দিতেন না। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ হামলে পড়তো না। কেন তিনি কুয়াশা ঢাকা অত ভোরে বাইক চালিয়ে ঠিক আমাদের সামনে এলেন!? আর আশেপাশে কেন কেউ ছিল না সেখানে অত ভোরে!? আর কেনই বা কথা শেষ ক'রেই একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলেন আবার যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথ ধ'রে!? কে উত্তর দেবে এর? আর কেই-ই বা উত্তর দেবে যে স্বপ্ন ভাইবোন আগের দিন একইসঙ্গে দেখেছেন সেই স্বপ্নে দেখা শ্রীশ্রীবাবাইদাদার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি যা যা বলেছিলেন ঠিক একই কথা কি ক'রে সকাল হ'তে না হ'তেই মিলে গেল শ্রীশ্রীঅবিনদাদার কথার সঙ্গে!? অবাক লাগে। কথা হারিয়ে যায়। বোবায় ধরার মত অবস্থা হয়।
যাই হ'ক পরবর্তীতে যা হয়েছিল সেটা ব'লে এই ভিডিও শেষ করবো। মেয়ের নোতুন কাজের জায়গায় সবকিছু মেয়ের ফেভারে ছিল। ছেলেও তার পুরোনো জায়গায় র'য়ে গেল এবং সেখানেই ধীরে ধীরে নিজের জমি শক্ত হতে লাগলো। আজও ২০২৪ সালে এই ভিডিও করা পর্যন্ত সে ঐ কোম্পানিতে আছে অবিনদাদার কথামতো 'এইখানেই তোর সব হবে' বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্যে দিয়ে। এই কোম্পানিতেই ছেলে আমার আজ প্রতিষ্ঠিত, সুপ্রতিষ্ঠিত!!!!!!!
কিন্তু সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের, যে কোম্পানিতে যাওয়ার ব্যাপারে অবিনদাদা নিষেধ করেছিলেন ছেলেকে সেই কোম্পানিতে যে প্রোজেক্টের জন্য ছেলেকে চাকরী অফার করেছিল সেই প্রোজেক্ট ঠিক ছয় মাস পর কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোরে চ'লে যায়। ফলে যারা ব্যাঙ্গালোরে যাবার জন্য রাজী তারা যেতে পারে আর যারা যাবে না বা যেতে পারবে না তাদের জন্য কলকাতায় কোনও জায়গা নেই। অতএব পশ্চাদদেশে পদাঘাত। ছেলের ক্ষেত্রে যা হ'য়ে দাঁড়াত সাপের ছুঁচো গেলার মতো অবস্থা। মনে পড়ে গেল সেদিনের ভোরবেলার কথা। যেটা অবিনদাদা আগেই জানতো। ভাগ্যিস সেদিন ছেলেমেয়ে দৌড়ে চলে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি নোতুন চাকরীতে জয়েন করবে কিনা তার অনুমতি ও আশীর্বাদ নিতে! ভাগ্যিস সেদিন ঐ প্রচন্ড কুয়াশা ঢাকা শীতের ভোরে বর্তমান আচার্যদেব আশ্রমে নেই জেনেও অজানা এক টানে আমরা স্বামীস্ত্রী, পুত্রকন্যা সহ চারজনে হেঁটে চলেছিলাম নাম করতে করতে আর মনে মনে বলছিলাম, হে দয়াল! তুমি দয়া করো! বাবাইদাদা নেই, দয়া ক'রে তুমি অবিনদাদার সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও।
কোথায় জানি ঠাকুরের কোন গ্রন্থে পড়েছিলাম, বিশ্বাস আর আকুল প্রার্থনা সব অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। সেদিন দয়াল দয়া ক'রে অবিনদাদার মধ্যে দিয়ে ঐ অতি প্রত্যুষে এসে দেখা দিয়ে সমস্যা সমাধান ক'রে দিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস অবিনদাদার আদেশ মতো ছেলে পুরোনো কোম্পানীর চাকরী ছেড়ে নোতুন কোম্পানীর লোভনীয় অফার গ্রহণ করেনি। অবিনদাদার নির্দেশ আদেশ উপেক্ষা ক'রে যদি সেদিন ঐ অফার গ্রহণ করতো তাহ'লে হয় ছেলেকে চাকরী বাঁচাতে বাংলা ছেড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হ'তো অন্য রাজ্যে; নতুবা, চাকরী ছেড়ে বসে থাকতে হ'তো ঘরে। দয়াল সেদিন পূজনীয় শ্রীশ্রীঅবিনদাদার আচরণের মধ্যে দিয়ে দয়া ক'রে বাঁচিয়ে দিলেন, রক্ষা করলেন পুত্রের বর্তমান চাকরী ও পিতামাতার সঙ্গে পুত্রের বিচ্ছেদ।
কে এই শ্রীশ্রীঅবিনদাদা? শ্রীশ্রীঅবিনদাদা কি অন্তর্যামী!?
জানি না আমি। তবে একটা কথা বলে যাই, যদিও অলৌকিকতা ব'লে কিছু নেই। যতদিন না তুমি ঘটনার কার্যকারণ জানতে পারছো ততদিন তোমার কাছে অলৌকিক। আর যে মুহূর্তে তুমি ঘটনার কার্যকারণ জানতে পারছো তখনি তা হ'য়ে যাচ্ছে লৌকিক। যখনই জানাটা হাতের মুঠোয় এসে যাচ্ছে তখনি সেটা হ'য়ে যাচ্ছে বাস্তব। আর যতক্ষণ জানতে পারছো না ততক্ষণ তা অলৌকিক, অবাস্তব বা কাকতালীয়।
কিন্তু এ ছাড়া এমন এমন ঘটনা আজও ঘটে যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। আমার দয়াল ঠাকুরের কয়েকটা পছন্দের কোটেশান আছে যা তিনি প্রায়ই বলতেন। তার মধ্যে একটা শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের অংশ। ঠাকুর প্রায়ই রহস্য ক'রে বলতেন, " There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosopy." যার অর্থ, স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত।"
আজও আমার ভোরের কথাটা মনে পড়লে (আর মনেও পড়ে সবসময়) কেমন জানি রহস্যময় এক জগতে চলে যায় শরীর মন। এ জোর ক'রে কাউকে বিশ্বাস করানো যায় না। কুয়াশা ঢাকা সেই শীতের ভোর! চারিদিক আবছা আলো আঁধারে ঢাকা প্রকৃতি! মাথার ওপরে বেশ ঝ'রে পড়ছে ঝিরঝিরিয়ে কুয়াশা! চোখেমুখে এসে লাগছে কুয়াশার সেই হালকা জলের ছিটা। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না! চারপাশটা ফাঁকা! নিস্তব্ধ! আর কেনই বা কেউই নেই তাও জানি না। আমরা পরিবারের চারজন ফাঁকা রাস্তা দিয়ে উদভ্রান্তের মতো হেঁটে চলেছি। কেন চলেছি, কি জন্য চলেছি, কার জন্যে চলেছি এই অতি প্রত্যুষে শ্রোতা বিশ্বাস করুন আমরা কেউ জানি না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি! মনে হচ্ছিল কে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ঐ ঠাকুরের সুইমিং পুলের দিকে। আর তারপরেই ঐ অতি প্রত্যুষে আলোআঁধার পরিবেশে ঘটেছিল ঘটনাটা! হঠাৎ কুয়াশার ঘন আচ্ছরণ ভেদ ক'রে সামনে এসে হাজির হয়েছিল সেই বিশাল এনফিল্ড বাইক আর বাইকের ওপর সওয়ারি। একে কি বলবো শ্রোতা বন্ধুরা জানি না। বিশ্বাস করা আর না করা আপনাদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে আমরা সেদিন দয়াল ঠাকুরের দয়ায় সাক্ষাৎ প্রমাণ পেয়েছিলাম ঠাকুরের প্রায় সময় রহস্য ক'রে বলা শেক্সপিয়ারের সেই 'হ্যামলেট' নাটকের অংশ বিশেষ, " There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy." যার অর্থ, স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরাশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও স্বপ্নের অতীত।" যা আজও আমাদের রোমাঞ্চিত করে! যখনই মনে সন্দেহ, অবিশ্বাস মুহূর্তের জন্য বিন্দুমাত্র হানা দেয় তখনি যেন মনে হয় দয়াল মিষ্টি হেসে রহস্য ক'রে বলছেন তাঁর প্রিয় কোটেশানটা।
আজ এই পর্যন্ত। আবার দেখা হবে পরবর্তী ভিডিওতে। জয়গুরু।
No comments:
Post a Comment