নির্বাচন শেষ হ'লো, শেষ হ'লো গণনা, শেষ হ'লো অপেক্ষা ; রাজ্য শাসন কে করবে, কার হাতে থাকবে রাজ্যের শাসন ক্ষমতা সেই জানার অপেক্ষার হ'লো শেষ, হ'লো সেই প্রশ্নের অবসান।
কিন্তু যার শেষ হ'লো না, কোনদিনই হয় না তা হ'লো নির্বাচন পূর্ব, নির্বাচন চলাকালীন ও নির্বাচন পরবর্তী হিংসা, মারামারি-কাটাকাটি।
এই নির্বাচনে প্রতিবারের মত এইবারও প্রকট হ'য়ে উঠেছিল হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক, হিন্দু ধর্ম্ম ও মুসলমান ধর্ম্মের প্রসঙ্গ যার শুরু হ'য়েছিল সেই যে ব্রিটিশ চলে গিয়েছিল দেশ ছেড়ে আজ থেকে ৭৪বছর আগে তখন থেকে। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন ক'রে ও দেশকে দু'ভাগে ভাগ ক'রে দিয়ে চলে গিয়েছিল ব্রিটিশ আর সেই তখন থেকে ব্রিটিশের পরিবর্তে দেশের অভ্যন্তরে সুযোগসন্ধানীরা তার সুযোগ নিয়ে ছাই চাপা আগুনের মত ধিকি ধিকি ক'রে জ্বালিয়ে রেখে চলেছে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল তত্ত্ব নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বজায় রাখতে। আর সেই থেকে দুই টুকরো দেশ ভারত ও পাকিস্তান আর বর্তমানে আরও এক টুকরো ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ পান ক'রে চলেছে ব্রিটিশদের দ্বারা সেই ভাগ ক'রে সমস্যা সমাধানের বিষাক্ত বিষ।
সেই সময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র দেশের তৎকালীন প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের কাছে দেশভাগের ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে তাঁর সাবধান বাণী পৌঁছে দিয়ে বলেছিলেন, " Dividing compromise is the hatch of animosity." (ভাগ ক''রে সমাধান করার অর্থ তা দিয়ে শত্রুতার ডিম ফোটানো।) যার প্রমাণ আজ ৭৪ বছর ধ'রে প্রতিমুহুর্তে পেয়ে চলেছি। কিন্তু ঠাকুরের কথার কোনও পাত্তা দেয়নি সেই সময়ের দেশের নেতৃবৃন্দ। কারও পক্ষে এই ভয়ংকর শত্রুতার তা বন্ধ করা আর বোধহয় সম্ভব নয় যতদিন না উভয় সম্প্রদায়ের সুচিন্তিত সৎ প্রকৃত ধর্ম্মপ্রাণ মানুষ জেগে ওঠে।
এই লেখাটা লিখলাম এইজন্যে যে দুই বন্ধুর মধ্যে (একজন হিন্দু আর একজন মুসলমান) আলোচনা হচ্ছিল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে নিয়ে। মুসলিম বন্ধু তার হিন্দু বন্ধুকে জিজ্ঞেস করছিল নানা প্রশ্ন। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের দর্শন কি, তাঁর ও সৎসঙ্গীদের ধর্ম্ম কি, তিনি অবতার কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। পুরোটা পড়লাম ভালো লাগলো। ভালো লাগলো মুসলিম ভাইয়ের প্রশ্নগুলো, খুব সুচিন্তিত গভীর প্রশ্ন। ভালো লাগলো ধীর স্থিরভাবে দেওয়া হিন্দু তথা সৎসঙ্গী ভাইয়ের উত্তরগুলো। মনটা ভ'রে গেলো! প্রভূত আনন্দ পেলাম। সঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছিল যৌবনের দিনগুলির কথা। ঠাকুর নিয়ে, ঠাকুরের দর্শন নিয়ে, ঠাকুরের মিশন নিয়ে, ঠাকুরের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বলা মতামত নিয়ে কত প্রশ্ন যে কতজন করতো উত্তর দিতে দিতে হাঁপিয়ে যেতাম। ছোটোবেলা থেকে কোনদিনই কোনও প্রশ্ন করিনি কাউকে। মা বাবাকে দেখে দেখে ঠাকুরকে ভালবাসতে শিখেছিলাম। ঠাকুরকে ভালো লাগতো খুব। ঠাকুরের অপূর্ব মিষ্টি চেহারা আর ভুবন ভোলানো হাসি ছড়ানো মুখের ছবি দেখতে দেখতে সম্মোহিত হ'য়ে যেতাম। বই পড়ার অভ্যাস ছিল। বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখা উপন্যাস পড়তাম। ইয়াং ফ্লেমিং-এর লেখা জেমস বন্ড বড্ড টানতো, ভালো লাগতো আগাথা ক্রিসটি, কোনান ডয়েল এবং অন্যান্য দেশী ও বিদেশী গোয়ান্দা কাহিনী ভালো লাগতো পড়তে। অনেক বই পড়তাম। অনেক ছোটোবেলায় বই-এর ফাঁকে লুকিয়ে গোগ্রাসে গিলতাম ডিটেকডিভ দীপক কুমারের ছোট্ট চটি বই। এখন আর অত মনে নেই। তবে একজনের নাম আজও মনে আছে, মনের মধ্যে গেঁথে আছে। তাঁর নাম সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রথম দিকের তাঁর প্রায় সব উপন্যাস পড়া আছে কিন্তু শেষের দিকে আর পড়িনি, পড়তে ইচ্ছে হয়নি। ততদিনে জ্ঞানের রত্নভান্ডারের সন্ধান পেয়ে গেছি। মা প্রায়ই বলতেন, "সত্যানুসরণ ছোট্ট বইটা পড়ে দেখ না, কত বই পড়িস, এই ছোট্ট বইটা তো পড়ে দেখতে পারিস, এতে হাতি আছে না ঘোড়া আছে পড়ে তো দেখতে পারিস। ভালো না লাগলে পড়বি না।" মায়ের কথা মনে পড়ে গেল, আজ মাঝে মাঝে বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের সেই কথা শুনতাম আর হেসে বলতাম হ্যাঁ হ্যাঁ পড়বো, নিশ্চয়ই পড়বো। কিন্তু পড়া আর হ'য়ে উঠতো না। তারপর বাড়িতে আলোচনা পত্রিকা আসতো। মা বলতেন, "আলোচনা পত্রিকাটা একটু উল্টে পাল্টে দেখ, ভালো লাগবে। অনেক কিছু জানতে পারবি।" দিন চলে যেত কিন্তু পড়বো পড়বো ক'রে আর পড়া হ'য়ে উঠতো না।
কিন্তু হঠাৎ একদিন হাতে তুলে নিলাম 'সত্যানুসরণ' বইটা, উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলাম 'আলোচনা' পত্রিকাটা। তারপরেই যা হবার হ'য়ে গেল। প্রশ্ন করা হ'য়ে গেল চিরদিনের মত বন্ধ। প্রশ্ন শুনতেও আর ইচ্ছা করতো না। তর্ক করতে এলে বা করতে গেলে মাথা যেত গরম হ'য়ে। তাও বন্ধ হ'য়ে গেল। তর্ক করতে ইচ্ছে করতো না কারও সঙ্গে। বন্ধ হ'য়ে গেল সবার সব লেখা গল্প উপন্যাস পড়া। প্রিয় ঔপন্যাসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বই পড়াও বন্ধ হ'য়ে গেল চিরতরে। সত্যানুসরণ আর আলোচনা পত্রিকায় প্রকাশিত অনুলেখক কেষ্টদা, প্রফুল্লদা, রেবতীদা, মণিলালদা, দেবীদা, আতপেন্দ্রদাদের সংগৃহীত ঠাকুরের সঙ্গে বিভিন্ন দেশবিদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতিদিনের কথোপকথন পড়তে পড়তে কি যে হ'লো এর ব্যাখ্যা লিখে বোঝাতে পারবো না। এটা সম্পূর্ণ উপলব্ধির ব্যাপার। আর এই যে অনুলেখক যাঁদের নাম লিখলাম তাঁরা কি অসীম দক্ষতায় যে The greatest phenomenon of the world SriSriThakur Anukul Chandra-এর জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে কথোপকথন কি নিখুঁত দক্ষতায় তৎক্ষণাৎ তৎপরতার সঙ্গে ডায়েরিতে ধ'রে রাখতেন তা এক অসীম বিস্ময়!!!! স্থান, কাল, পাত্র, পরিবেশ, আবহাওয়া, প্রকৃতির বর্ণনা এবং ঠাকুরের ওঠা, বসা, চলা, কথা বলা, তাঁর উপস্থাপনা, তাঁর ব্যাখা ও বিশ্লেষণ, তাঁর হাসি, তাঁর আনন্দ, তাঁর মজা, তাঁর দুঃখ, তাঁর কষ্ট, তাঁর আফসোস, তাঁর দেশ ও দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ, তাঁর ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে দুশ্চিন্তা, তাঁর মায়া মমতা, তাঁর রাগ, তাঁর ভর্তসনা ইত্যাদি ইত্যাদি প্রতিটি মুহুর্তের নিখুঁত ভঙ্গি উঠে এসেছে তাঁদের মহাশক্তিশালী কলমে! প্রফুল্লদার ২২খন্ড 'আলোচনা প্রসঙ্গ' গ্রন্থে দুনিয়ার এমন কিছু নাই যা ঠাকুরের সঙ্গে বিভিন্ন জনের কথোপকথনের সময় প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে উঠে আসা বিষয় লিপিবদ্ধ হয়নি। মানুষের সমস্ত সমস্যা সমাধানের দিক নির্দেশ দিয়ে গেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর যা ছাপার আকারে লিপিবদ্ধ করা আছে প্রফুল্লদার 'আলোচনা প্রসঙ্গ' ২২ খন্ড ও অন্যান্য অনুলেখক দ্বারা সংকলিত গ্রন্থ রাজিতে। বহু মানুষের উপস্থিতিতে কথোপকথন অতি দ্রুততার সঙ্গে কি ক'রে লিখতেন তা ভাবলে আজও রহস্য লাগে। ঠাকুরের অসীম দয়া না হ'লে এরকম প্রতিটি মুহূর্তের উপস্থিতি নিখুঁত ধ'রে রাখা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আর কি অসীম শক্তিশালী কলমের ধার তাঁদের তা যারা না পড়বে তা বিশ্বাস করা অসম্ভব তাদের পক্ষে। ইচ্ছে করলে এই মহামানবেরা তাঁদের কলমের শক্তি দিয়ে অকল্পনীয় অসাধারণ অভূতপূর্ব মেধাকে কাজে লাগিয়ে বহু সাহিত্য সৃষ্টি ক'রে যেতে পারতেন কিন্তু তাঁরা তা করেননি। করেননি কারণ তাঁরা এবার এসেছিলেন শুধু নয় তাঁদের নাবিয়ে আনা হয়েছিল, ঠাকুর স্বয়ং তাঁদের নাবিয়ে এনেছিলেন এবারে তাঁর ব'লে হাজার হাজার ছড়া, বাণী, গান, কবিতা, কথোপকথন ইত্যাদি ধ'রে রাখার জন্য!!!! তাঁরা তাঁদের জীবনকে জীবন্ত ঈশ্বরের কাজে উৎসর্গ ক'রে গেছেন।
যাক এত কথা লিখলাম তার একটাই কারণ; সৎসঙ্গী গুরুভাই আর মুসলিম ভাইয়ের কমেন্ট পড়তে পড়তে মনে হ'লো নিজের জীবনের কথা আর তাই লিখলাম এই লেখা। কারও কথোপকথন যখন নিজের জীবনের কথা মনে পড়িয়ে দেয় তখন সেই কথোপকথন সার্থক হয়। তাদের উভয়ের কথোপকথন, মুসলিম ভাইয়ের নানা প্রশ্ন পড়তে পড়তে আমার নিজের জীবনের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের বাণী মনে পড়ে গেল,
"প্রশ্ন তোমার অস্ত যাউক
রহুক যুক্তি সরে
তোমার আজ্ঞা করবো পালন
মরণ স্তব্ধ ক'রে।"
তাই এই নির্বাচনকে কেন্দ্র ক'রে নির্বাচনোত্তর ও নির্বাচনপূর্ব মুসলমান সম্প্রদায়কে নিয়ে ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে ঐ মুসলিম ভাইকে তার জানার তীব্র আগ্রহ, ইচ্ছা, ক্ষুধা ও অনুসন্ধিৎসা দেখে তাই আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি, জানা, আরও জানা, আরও আরও জানার প্রকৃত আগ্রহ বই পড়া আর সৎ সঙ্গের মধ্যে দিয়েই জন্মায়। তাই একটাই বইয়ের নাম আমার মুসলিম ভাইকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের 'ইসলাম প্রসঙ্গে' বইটা শুধু পড়তে বলবো। সেখানে ঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন বিজ্ঞানী শ্রীকৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য ও মৌলবী মহম্মদ খলিলর রহমন দাদা। সেই বহু জটিল ও কঠিন প্রশ্ন ও তার যথাযথ ফাঁকহীন উত্তর জানার মধ্যে দিয়ে ইসলামের সার্ব্বজনীন স্বরূপ ও রসুলের প্রতি অস্খলিত অটুট অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রেমের উদ্বোধন হ'তে পারে আমার মুসলিম ভাইটির; যা বর্তমান জটিল সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের যুব সমাজের অস্তিত্ব রক্ষা ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য একান্তই প্রয়োজন।
তাই কথাগুলি বললাম। গ্রহণ ও বর্জন ব্যক্তিগত। ( লেখা ৪ই মে, ২০২১ )
No comments:
Post a Comment