Powered By Blogger

Tuesday, May 7, 2024

প্রবন্ধঃ সন্তান থাকুক মোর দুধে ভাতে।

পৃথিবীর সব মায়েরাই তার ছোট্ট সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধ'রে গালে কপালে চুমু খেতে খেতে অশ্রুসিক্ত চোখে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা ক'রে বলে, আমার সন্তান থাকুক দুধে ভাতে। আমার সন্তান থাকুক দুধে ভাতে। পৃথিবীর গরীব-বড়লোক, মূর্খ-জ্ঞানী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সৎ-অসৎ, সতী-অসতী সব মায়েদের এই একই চাওয়া। সে আকাশের ভগবান, বোবা ভগবান, অমূর্ত ভগবান আর রক্তমাংসের জীবন্ত ভগবান বা ঈশ্বর যেই হ'ক না কেন। এই চাওয়ায় কোনও ভেজাল নেই, এই চাওয়ায় নেই কোনও ধর্মীয় বা জাতের পরিচয়। হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সব ধর্মের, সব জাতের মায়েদের একটাই পরিচয় সে 'মা'। এই একই কথা বাবাদের ক্ষেত্রেও।

মেয়েরা যেমন চেনা পরিবেশ, চেনা মানুষ, চেনা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে সম্পূর্ণ অচেনা এক মানুষের হাত ধ'রে অচেনা পরিবেশ, অচেনা মানুষজন, অচেনা বাড়িতে অচেনা এক নোতুন ঘরে; তারপরে ধীরে ধীরে স্বামী নামক অচেনা মানুষটির হাত ধ'রে অচেনা পরিবেশ, অচেনা বাড়িঘর, শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ নামক অচেনা মানুষজন সবাইকে চেনা ক'রে নেয়, আপন ক'রে নেয়, তারপরে সংসারের সমস্ত কাজের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে হাসি মুখে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংসারের সকল সদস্যের জন্য হাসি মুখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে । তারপর একদিন ঈশ্বরের আশীর্ব্বাদে মায়ের ঘর ছেড়ে আসা সেই মেয়েই সংসার সমুদ্র পাড়ি দিতে দিতে একদিন নিজেই 'মা'-এর আসন গ্রহণ করে এবং অবশেষে একদিন সেই নতুন সংসারের সে সর্ব্বময় কর্ত্রী হ'য়ে ওঠে।

যেদিন সেই মেয়েটি 'মা' হয় তখন সেই মা আমৃত্যু তার সেই ছোট্ট সন্তানের জন্ম থেকে ধীরে ধীরে বড় হওয়া, অনেক বড় হওয়া পর্যন্ত একটা কথায় ভাবে শয়নে-স্বপনে-জাগরণে 'সন্তান থাকে যেন মোর দুধে ভাতে।' ঠিক যেমন তার মা তাকে নিয়ে ভাবতো। এর জন্য কোনও কষ্টকেই কষ্ট ব'লে মনে হয়না মায়েদের। সন্তানের একটু হাসি মুখ দেখলেই সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, জ্বর, রোগ, সারাদিন না খেয়ে থাকা, অভাব, অনটন, কত বিনিদ্র রাত ইত্যাদি সব সব ভুলে যায়, শিশুর হাসি মাখা মুখ দেখলেই মায়েদের শান্তি, আর কিচ্ছু চায় না মায়েরা সন্তানের কাছে।

ঠিক এই একই চাওয়া বাবাদেরও। বাবারা সন্তানের জন্য, সন্তানের মঙ্গলের জন্য, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য পাহাড় ভেঙ্গে আনতেও পিছপা হয় না। কত কষ্ট, কত পরিশ্রম, কত ক্লান্তি, কত অপমান, কত অবহেলা, কত অন্যায়, কত আঘাত, কত না ঘুমানো রাত মুখ বুঝে সহ্য করে সন্তানের জন্য, সন্তানের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দেবার জন্য, সন্তানের ভালো থাকার জন্য, সন্তানের পড়াশুনার জন্য, সন্তানকে বড় ক'রে তোলার জন্য সব কষ্ট সহ্য করে।

এই সন্তানকে ঘিরেই নিজেদের কত চাওয়া, কত ইচ্ছা, কত স্বপ্নকে ভ্রুণের মধ্যেই হত্যা করে বাবা-মা। হত্যা করে শুধুমাত্র 'সন্তান থাকুক মোর দুধে ভাতে, থাকবে মোর দুধে ভাতে' এই চিন্তায়। একমাত্র নির্ভেজাল অকপট এই চিন্তায়। কত বিনিদ্র রাত যে কেটে যায় সন্তানের ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে; তার হিসাব কে রাখে? রাখে কি কেউ? সন্তান কি জানে তা? নাকি বোঝে তা? শুধু জানে একজন! সে জন আমার দয়াল প্রভু।

সত্যি সত্যিই কি বোঝে না সন্তান? নাকি বুঝেও কিছুই করার থাকে না? কেন বোঝে না সন্তান? যে সন্তান পড়াশুনা ক'রে প্রতিষ্ঠিত সে কেন বোঝে না? প্রতিষ্ঠিত পুত্র সন্তান কেন বোঝে না বাবা-মায়ের কষ্টের দিনগুলির কথা? কেন বোঝে না বয়সকালে বাবা-মায়ের মনের কথা, অন্তরের ব্যথা? প্রতিষ্ঠিত পুত্র, উচ্চশিক্ষিত পুত্র বিয়ের পর শ্বশুর শাশুড়ীর প্রতি জামাইয়ের দায়িত্ব পালনে অতিমাত্রায় সচেতন থাকে কিন্তু নিজের পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনে ততোধিক উদাসীন হয়। কেন? কিসের জন্য? বাবা-মা কি এইজন্যই নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিল যে তাদের প্রাণাধিক পুত্র বড় হ'লে লেখাপড়ায় দড় হ'য়ে বিয়ের পর তাদের ভুলে যাবে? কিংবা স্ত্রীর বাপের বাড়ির টাকার জোরে তাদের পুত্র শ্বশুরবাড়ির কেনা গোলাম হবে আর বাবা-মাকেই ভুলে যাবে? নিজের জন্মদাতা মা-বাবার চেয়ে বড় হ'য়ে দাঁড়াবে শ্বশুর শাশুড়ী?

ঠিক তেমনি মেয়েদের ক্ষেত্রে উল্টো ঘটে। প্রতিষ্ঠিত, উচ্চ লেখাপড়া জানা কিংবা সাধারণ ঘরের কন্যা সন্তান বিয়ের পরেও বাপের বাড়ির প্রতি, নিজের বাবা-মায়ের প্রতি যে রকম দরদী থাকে, কর্তব্যপরায়ণ হয় তেমনটি কেন হয় না নিজের শ্বশুরবাড়ি ও শ্বশুর-শাশুড়ীর প্রতি? কেন স্বামীস্ত্রী দু'জনেই নিজের নিজের পিতামাতা ও পরস্পরের পিতামাতা ও পরিবারের প্রতি একইরকম দায়িত্বশীল সুন্দর মানসিকতার অধিকারী হয় না?


এই বিকৃত মানসিকতার জন্য দায়ী কে?

আজ সারা বিশ্বে কোটি কোটি সৎসঙ্গীদের মধ্যে কয়েক লক্ষ ছোট্ট শিশুর দীক্ষিত পিতামাতা আছেন তাদের উদ্দেশ্যে এবং এছাড়া অদীক্ষিতরাও যাতে উপকৃত হয় সেই উদ্দেশ্যেই আমার এই লেখা। যারা আমার এই লেখা পড়ছেন তাদের কাছে আমার অনুরোধ আসুন একবার সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে দেখে নিই শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন নষ্ট হওয়ার জন্য প্রকৃত কে দায়ী।

কবি সুকান্ত অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে লিখেছিলেন,
"চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।"

আমিও ব'লে যাই,
যাবার হয়েছে সময়; চলে যাবো যে কোনও একদিন
আমার ফুলের মতো ছোট্ট ছোট্ট দেবদূতদের ছেড়ে।
যাবো চলে অন্ধকার আগুন পৃথিবী আর
বিষাক্ত নিশ্বাসে ভরা আকাশের তলে
আমার ছোট্ট শিশুদের ফেলে।
তাই যাবার আগে ব'লে যাই,
শিশুর ভবিষ্যৎ সুদিন রাখা আছে জেনো নিশ্চিত
শিশুদের মা-বাবাদের কোলে।

প্রশ্নটা ছিল কে দায়ী?
শিশুর প্রথম স্কুল তার মা। তারপর বাবা ও পারিবারিক অন্যান্য সদস্যরা এবং পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। শিশুর বাবা-মা যদি তাদের নিজেদের জীবন যাপন, চালচলন, কথাবার্তা, আচার আচরণ, চিন্তাভাবনা ইত্যাদির মধ্যে খারাপ দিকগুলিকে পরিবর্তন না করে তাহ'লে শত শাসন, শত নীতিকথা, শত শিক্ষা, শত মতবাদ তাদের শিশুদের জীবনকে পরিবর্তন করতে পারবে না। কারণ বাবা-মায়ের প্রতিদিনের প্রতিমুহুর্তের শরীরের ও চোখমুখের ভালো বা মন্দ ভাষা শিশুর কাঁচা মাথায় ছাপ রেখে যায়। ছোট্ট শিশুরা নকল প্রিয়। তারা তার চারপাশের সব কিছুকে খুব দ্রুত নকল করতে পারে। তাই খুব সাবধান থাকতে হয় বাবামায়েদের শিশু জন্মের পর থেকেই। বাবা-মা যদি তাদের সন্তানকে সত্যি সত্যিই ভালোবাসে, যদি শিশুকে শরীরে-মনে ও আত্মায় ছোট্ট থেকে মহান আত্মায় উত্তীর্ণ করতে চায় তাহ'লে প্রথমে নিজেদের জীবনের যত বদ অভ্যাস, কু অভ্যাস, কুসংস্কার, অসৎ চিন্তা, ভাবনা, কর্ম ত্যাগ করতে হবে, ষড়রিপুকে নিজের কন্ট্রোলে রেখে সচেষ্ট হ'তে হবে মহাত্মায় উত্তীর্ণ হওয়ার। ষড়রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য যেন মা-বাবাকে কন্ট্রোল ক'রে রাস্তার কুত্তার মত টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে না পারে গলায় তাদের বকলেস পড়িয়ে। আর, শৈশব থেকে শিশু যদি তা দেখতে দেখতে বড় হয় সেই বকলস পড়ে নেবে নিজের গলায় নিজের অজান্তে কিচ্ছু না বুঝেই।

তাই, শিশু সন্তানকে যদি ভবিষ্যতে আদর্শ মানুষ হিসেবে দেখতে চায় মা-বাবা তাহ'লে মা-বাবার জীবনে আদর্শ গ্রহণ করা দরকার। সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ অর্থাৎ জীবন্ত ঈশ্বরকে যাকে পুরুষোত্তম, পরমপিতা, পরমকারণ, সদগুরু, সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, সর্বব্যাপী বলা হয় তাঁকে জীবনে গ্রহণ করা দরকার এবং গ্রহণ করার পর লোকদেখানো ফুল, ধুপ-ধুনো দিয়ে জীবন্ত আদর্শের চরণপূজা করা নয় তাঁর চলনপুজা করার দরকার। তাবিজ, মাদুলি, আংটি, পাথর, লালসুতো, কালোসুতো, লোহা, শেকড় বাকড় ইত্যাদি নির্ভর ক'রে সন্তানকে জন্মের পর থেকেই মানসিকভাবে দূর্বল মানুষে পরিণত ক'রে বড় করা নয়। কারণ আমরা দেখেছি দুই হাতের পাঁচ পাঁচ দশ আঙ্গুলে আংটি, হাতে তাবিজ আর কব্জিতে লাল সুতো, কোমরে কালো সুতোয় লোহা বাঁধা দূর্বল শিশু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বৃত্তি-প্রবৃত্তির গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে শরীরে-মনে দূর্বল হ'য়ে বড় হ'য়ে উঠছে আর সেই বোঝার ভারে নিজের জীবন হারিয়ে শেষ হ'য়ে যাচ্ছে হতাশা, অবসাদে জর্জরিত হ'য়ে। শিশু বড় হওয়ার পর বৃহত্তর পরিবেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে, চাকুরি ক্ষেত্রে, সামাজিক, পারিবারিক ক্ষেত্রে ভয়ংকর চাপ নিতে না পেরে হয় মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে পাগলাগারদে আশ্রয় নিচ্ছে, পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে নতুবা বিষাদগ্রস্থতায় আক্রান্ত হ'য়ে অকাল মৃত্যুকে আলিঙ্গন ক'রে নিচ্ছে। আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ নিজে জ্যোতিষী, আংটি, মাদুলী, তাবিজ, লালসুতো, কালোসুতো, বোবা ভগবান, অমূর্ত ভগবানের ওপর নির্ভরশীল কুসংস্কারাচ্ছন্ন দূর্বল মানুষ হ'য়ে অন্য মানুষকে ইষ্টকে ধ'রে বেঁচে থাকার কথা, বেড়ে ওঠার হাস্যকর পথ দেখাচ্ছে। দেখাচ্ছে আমাদের সৎসঙ্গীরাই। মায়েদের মনে রাখতে হবে, নিজের সন্তানকে সেইরকম আত্মবিশ্বাস হারানো, অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী ও নির্ভরশীল মানুষ ক'রে গড়ে তোলা নয়। আমি একদিকে জীবন্ত ইশ্বরকে গ্রহণ করেছি, তাঁর চলনপূজার কথা বলছি, আবার অন্যদিকে বোবা ভগবানের আরাধনা করি, পাথর বসানো আংটি, তাবিজ, মাদুলি, লালসুতো, কালোসুতো, কোমরে লোহা ধারণ করি, এমন মানুষ থেকে মায়েরা যেন সাবধান থেকে দূরে রাখে তোদের সন্তানকে শৈশব থেকেই। কোনও অবস্থায় সন্তান যেন মানসিক দুর্বলতার শিকার না হয় সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে মায়েদের। সন্তানকে জন্মের পর থেকে পাথর বসানো আংটি, তাবিজ, মাদুলি, লালসুতো, কালোসুতো, কোমরে লোহা ধারণ ও বোবা ভগবান, অমূর্ত ভগবানে নির্ভরশীল গড়ে যেন মায়েরা না তোলেন।
জীবন্ত ইশ্বরকে ধ'রে সেই জীবন্ত ঈশ্বরের চলনপুজা অনুযায়ী নিজে শিক্ষিত হ'য়ে নিজে ক'রে ও সন্তানকে করিয়ে একেবারে আধো কথার সময় থেকেই জীবন্ত আদর্শে অর্থাৎ জীবন্ত ইশ্বরে অনুপ্রাণিত ক'রে তোলা দরকার এবং যথাসময়ে পাঁচ বছর বয়সেই জীবন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ সদগুরু পরমপিতার সৎনাম দিয়ে দেওয়া দরকার। তারপর পাঁচ থেকে দশবছরের মধ্যেই যা কিছু সন্তানের ভিত তৈরী ক'রে দিতে হবে। নতুবা সেই প্রবাদ 'কাঁচায় না নুইলে বাঁশ পাকায় করে ট্যাঁসট্যাঁস'-এর মতো হবে। পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে ভিত তৈরীর সময়। সেই সময়ের মধ্যে ভিত যদি তৈরী না হয়, তৈরী না হয় কাঁচা জমিতে সময়ে তখন পাকা জমিতে শত শাসন, লক্ষ সাধু কথা, কীর্তন, গুরুর হাজার আশীর্বাদ, ভালোবাসা, কড়া শাসন, কোনও জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতিকথা, তত্ত্বকথা, কোনও মহাত্মার আশীর্বাদ ইত্যাদি কোনও কাজে আসবে না। সময়ে যদি তাদের ভিত তৈরী ক'রে না দেওয়া যায় তাহ'লে পরিবেশ পরিস্থিতির চাপে ও উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল রিপুর দাপাদাপিতে বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া সন্তান তখন আর পাড়ে উঠে আসতে পারবে না। যদিও বা আসে কখনও কোনোদিন তবে ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে সব কিছু হারিয়ে ও সময় হারিয়ে উঠে আসবে পঙ্গু হ'য়ে।
তাই মাকে-বাবাকে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তৈরী হ'তে হবে আগে। ত্যাগ করতে হবে জীবনের সব অলীক মায়ার মোহন বাঁশীর ডাক । সন্তানের সুন্দর জীবন যদি চায় বাবা-মায়েরা তবে ত্যাগ করতে হবে সমস্ত রকম ভারসাম্যহীন ভোগ বিলাসিতা। ত্যাগ করতে হবে মদ, সিগারেট ইত্যাদি সমস্ত রকম জীবন ধ্বংসকারী নেশা সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে। হে সন্তানের পিতামাতা, যদি তুমি সন্তানের মঙ্গল চাও তাহ'লের নিজের জীবনের ভুল, ত্রুটি, দোষ, ব্যবহার, অন্যায় ও ব্যর্থতা দিয়ে ভরা দিনগুলিকে ভাবো তোমার ছোট্ট সন্তানের নিষ্পাপ, সরল মুখের দিকে চেয়ে ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সেইভাবে তুমি ওকে গড়ে তোলও যাতে তোমার জীবনের সব ভুল, ত্রুটি, দোষ, ব্যবহার, অন্যায় ও ব্যর্থতা ইত্যাদি অবগুণ যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে। উদাসীন থেকো না। সন্তান কিন্তু তোমারি আয়না। তুমি যা ক'রে রেখেছো ও করছো তার সমস্ত কিছুর প্রতিফলন তোমার সন্তানের মধ্যে দেখতে পাবে। সন্তান বড় হ'লে দেখতে পাবে শিশু বয়সে সন্তানের প্রতি তোমার অবহেলা, উদাসীনতা, তাচ্ছিল্যের ছাপ। সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত বাৎসল্যও কিন্তু তাচ্ছিল্য একথা বলেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর। প্রতিটি সংসারে প্রচন্ড অবহেলায় বড় হচ্ছে ছোট্ট নির্মল শিশু। বাবা-মায়েদের নিজেদের লাগামছাড়া বৃত্তি-প্রবৃত্তি পূরণের ঘৃণ্য মানসিকতার কারণে উপেক্ষিত হচ্ছে ছোট্ট শিশু। জন্মের পর থেকেই ছোট্ট শিশুর ওপর চাপিয়ে মায়েরা-বাবারা নিজেদের বিশৃঙ্খল ইচ্ছা ও চাহিদা এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষা। ছোট্ট শিশুর সারল্য আর অসহায়ত্বকে হাতিয়ার ক'রে দাবিয়ে রেখে নিজেদের বুকের আর মনের নোংরা গরল ঢেলে দিচ্ছো তাদের মনে-প্রাণে ছোট্ট জীবনে, আর বনসাই ক'রে রেখে দিচ্ছো ঘরের কোণে জান্তে বা অজান্তে শুধুমাত্র নিজেদের ইগোকে স্যাটিশফাই করতে।

মায়েদের কাছে অনুরোধ, ছোট্ট শিশুকে রেখো না বনসাই ক'রে।

বনসাই ক'রে রেখেছো যারে
চার দেওয়ালের বদ্ধ ঘরে
সেই শিশু বটের বোবা বেদনা কে বুঝিতে পারে?
ড্রয়িংরুমের বাড়াও শোভা
অতি আধুনিকা আর বিরাট শিক্ষিতা তুমি
খেয়ালখুশির জাহাজে চড়ে!
বনসাই ক'রে রেখেছো যারে তুমি
তোমার ড্রয়িং রুমের ছোট্ট টেবিলে
ঘরের শোভা বাড়াবে ব'লে
সে যে যেতে চায় ছুটে খোলা আকাশের তলে
মাটির 'পরে চায় মাটিরে করিতে চুমি!
তা কি বুঝিতে পারো তুমি?
সে যে জড়াতে আকাশেরে চায়
শাখে শাখে পাতায় পাতায়
ক্লান্ত শ্রান্ত পথিকেরে চায় দিতে শান্তি
কলকাকলিতে ভরা ডালে ডালে যারা
গুঞ্জনে গুঞ্জনে তোলে তান জাগায় প্রাণ
সুরে সুরে আনে ক্রান্তি সেই তাদেরি দিতে চায়
অসহায় বনসাই তার বুকের 'পরে বসার আসনখানি!
কিন্তু পারে না বনসাই ক'রে রাখার কারণে।
ঠিক তেমনি তোমার ছোট্ট শিশুটিরে
ভুলভুলাইয়ার ঘুলঘুলির ছোট্ট নীড়ে
জানালার ধারে রেখেছো দাঁড় করায়ে
বাহিরের জগত হ'তে দূরে অনেক দূরে
একাকি অনেক খেলনার ভিড়ে!
জানালা দিয়ে দৃষ্টি যায় ছুটে দূরে অনেক দূরে
সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ফ্ল্যাট বাড়ি আর
নারিকেল সুপারি গাছের মাথার পরে
নীচে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আপন মানুষটিরে
হাত দিয়ে ডেকে বলে, ডাদু, ঐ নাকেল গাছ!
দাদু মাথা নেড়ে হাত বাড়িয়ে কাল্পনিক
কোলে তুলে বলে, যাবে নাকি ডাদুভাই
ঐ নাকেল সুপুরি গাছের তলে?
'আচ্চি দাঁড়াও' ব'লে জানালা থেকে যায় নেবে নীচে শিশু
অতঃপর কিছু সময় কেটে যায় ভেসে আসে কান্নার স্বর
'ডাদু ডাদু' বোল সাথে অবশেষে চাপা পড়ে যায়
থেমে যায় স্বর বনসাই হ'য়ে অন্ধকার ঘরের কোণে!

তাই বলি,
মা তুমি ভেবেছো কি?
জীবনে পেয়েছো কি?
জীবনে হারালেই বা কি?
জীবন মোহনায় দাঁড়িয়ে
তা’ কখনো একবার ভেবেছো কি?
জীবন জুড়ে বাড়িগাড়ী
ষড় রিপুর মারামারি
অর্থ মান আর যশের
কেবল কাড়াকাড়ি!
তুমি এই পেয়েছ
তোমার এই জীবনে
হারালে কি তা
ভাবো মনে মনে!!
এসো তুমি, এসো এইক্ষণে
পিছন ফিরে আর থেকো না,
তাকাও আলোর পানে!!
জীবনে বাঁচাবাড়া, সত্তার বয়ে চলা
ভালবাসা নিয়ে শুধু আনন্দে বেঁচে থাকা।
তুমি এই হারিয়েছ তোমার এই জীবনে
আর কি পাবে তা এই জীবন গেলে?
এসো মা তুমি এসো পরমপিতার চরণতলে,
জীবন খুঁজে হেথায় পাবে সযতনে!!!

তাই মায়েদের আরও বলি,
মা! তুমি সাবধান!!
মা! ভবিষ্যৎ ভয়ংকর!
ভয়ংকর চারপাশ!
আগুন হ'য়ে উঠছে ক্রমশ পৃথিবী!
জঞ্জালে জঞ্জালে ভরে গেছে বিশ্ব,
ভরে গেছে জঞ্জালের দুর্গন্ধে আকাশ বাতাস!
যেটাকে তুমি সভ্যতা মনে করছো, মনে করছো
ঝাঁ চকচকে সমাজ তা আসলে সুগন্ধী ছড়ানো
নকশী কাঁথায় ঢাকা এক দলিত গলিত শব জঞ্জাল।
যার তীব্র দুর্গন্ধকে চাপা দিয়ে রেখেছে মৃগনাভি
আর সুগন্ধী জুঁই ফুলের নির্যাস।
কবি সুকান্ত বলেছিলেন,
চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ।
তা' জঞ্জাল সরেছে কি? সরেনি।
আরো আরো জঞ্জালে ভরে গেছে চারপাশ।
গাদ্দা! বহুত গাদ্দা!!
আরো বেড়েছে! আরো জমেছে জঞ্জাল!
বাড়তে বাড়তে জমতে জমতে পাহাড় প্রমাণ
জঞ্জালে আজ নাভিশ্বাস উঠছে পৃথিবীর!
সেই পাহাড় প্রমাণ জঞ্জালে বিশ্বের সব চাপা পড়া শিশু
আজ চেয়ে আছে জুলজুল নিষ্পাপ চোখে পরম বিশ্বাসে
তাদের একমাত্র বিশ্বস্ত পরম আশ্রয় মায়ের মুখের দিকে!
মা! বিশ্ব শিশুর বাসযোগ্য হয়েছে কি? হয়নি।
কেন হয়নি? কে দেবে উত্তর?
কত আন্দোলন, কত পট পরিবর্তন তো দেখলে মা।
কত দেশপ্রেমী, কত নেতা-অভিনেতার দেখলে রংগ তামাশা,
দেখলে বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, বিপ্লব,
দেখলে কত স্বপ্ন যন্ত্রণা বুকে নিয়ে হেঁটে গেছে রাজপথ।
বিশ্বকে বাসযোগ্য করার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে কি?
রাখতে পেরেছে কি নবজাতকের কাছে কবি তাঁর দৃঢ অংগীকার?
পেরেছে কি তাঁর দেহের রক্তে করতে শিশুকে আশীর্বাদ?
কেন পারেনি? দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়েছে কেড়ে তাঁর জীবন।
মা হয়েছে কি তাঁর স্বপ্ন পূরণ?
হয়েছে কি মায়েদের আশা পূরণ?
দুরারোগ্য ব্যাধি সুকান্তর শরীর শুধু নয়
মনুষ্যত্বের বুনিয়াদকে খোকলা ক'রে দিয়েছে।
সময়ের অপেক্ষা শুধু হুড়মুড় ক'রে
ভেঙে পড়ার, লুপ্ত হওয়ার।
মা! তুমি খুঁজে নাও সত্ত্বর,
খুঁজে নাও তোমার শিশুর ভবিষ্যৎ বাসযোগ্য ঘর,
খুঁজে নাও সেই পৃথিবী।
যেখানে শিশু বাঁচবে, বেড়ে উঠবে,
বেড়ে উঠবে সসম্মানে, আত্মবিশ্বাসে,
বুকের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা মহাশক্তিকে জাগিয়ে নিয়ে
"মহাশক্তি ঘুমায় তোর হৃদয়ে তুই কেনরে মরার মত?
এই প্রশ্ন বুকে নিয়ে।
কঠিন, নির্ম্মম, ভয়ংকর, ভয়াল নোংরা পৃথিবীতে
'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে
গান উদাত্ত বলিষ্ঠ কন্ঠে গাইতে গাইতে হেঁটে চলে যাবে'
সুকান্তর অসমাপ্ত কাজ করতে পূরণ
হেঁটে যাবে ক্ষুধায় অন্ন না পেলেও,
তৃষ্ণায় জল না পেলেও
রোগে পথ্য না পেলেও
আগুন পৃথিবীর বুকের ওপর দিয়ে
হতাশা অবসাদকে পায়ে দ'লে
অবহেলায় অবলীলায় ভয় দুর্বলতা
আর কুসংস্কারকে পায়ে দ'লে
'হও ধরমেতে বীর, হও করমেতে বীর,
হও উন্নত শির নাহি ভয়'
আহ্বান ধ্বনি মাথায় নিয়ে।
এমনভাবে তৈরি করো তাকে
যাতে সে তা যত হাজারো সমস্যার দুঃসহ চাপ হ'ক না কেন
হাসি মুখে মাথায় নিয়ে
হাসতে হাসতে চলে যেতে পারে বীরের মত।
কথায় আছে 'বীরভোগ্যা বসুন্ধরা'।
বসুন্ধরা সেই-ই ভোগ করতে পারে
যে বীর আর বীর সেই যার মধ্যে আছে
নির্ভরতা, সাহস আর আত্মত্যাগ।
নিয়ে যাও তোমার সন্তানকে সেই অমরধাম!

যেখানে মৃত্যু নেই, নেই রোগ, শোক, গ্রহদোষ
আর বুদ্ধি বিপর্যয় আর দারিদ্রতার নির্ম্মম কষাঘাত
নেই অকাল মৃত্যু,আছে সেথা জীবন আর জীবন
যেথা জীবন খুঁজে পাবে, পাবে জীবনে
বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার জন্য
নির্ভরতা, সাহস আর আত্মত্যাগ -এর পরম আশ্রয়।
সেই আশ্রয় এক ও একমাত্র আমার দয়ালের রাতুল চরণতল,
দাও বসিয়ে সেথায়, লক্ষণরেখায়,
অর্থ, মান, যশ আর প্রতিষ্ঠা সব সব পাবে,
পাবে সুখ, শান্তি জীবনে ঐ লক্ষণরেখা গন্ডির মাঝে।
স্বপ্ন হবে পূরণ তোমার, 'সন্তান মোর থাকুক দুধে-ভাতে।'
আজ এই পর্যন্ত। সবাই আনন্দে থাকুন, খুব আনন্দে এই প্রার্থনা জানিয়ে আজকের মত নিচ্ছি বিদায়। জয়গুরু।

No comments:

Post a Comment