আজ একটা আমার দুঃখ ও ব্যর্থতার কাহিনী বলবো তোমাদের। বলার ইচ্ছে ছিল না, আর আজকাল তেমন লেখার বা বলার ইচ্ছে হয় না। কারণ কেউ শোনে না, কেউ পড়ে না। তাদের কাছে এসব বকোয়াস। এরকম এক বকোয়াস কথা না শোনার কাহানী বলবো তোমাদের। একটু কষ্ট ক'রে পড়ার অনুরোধ রইলো। হয়তো কাজে লাগলেও লাগতে পারে।
সেদিনটা ছিল রবিবার। যাচ্ছিলাম এক গুরুভাইয়ের বাড়িতে সান্ধ্য সৎসঙ্গে। স্ত্রী ও বউমা আগে চলে গেছে। মেয়ে জামাই এসেছিল। মেয়েও চলে গেছিল মায়ের সঙ্গে। কারণ আগে মাতৃসম্মেলন হবে; পরে হবে সৎসঙ্গ। তাই তারা আগে চলে গেছিল। আমার একটা কাজ থাকায় ছেলে আর জামাইকে বলেছিলাম সৎসঙ্গে আগে চলে যেতে। সেইমতো তারা চলে গেছিল। আমি পরে কাজ সেরে যখন যাচ্ছিলাম তখন পথে দেখা হ'লো এক পুরোনো বন্ধুর সাথে। পাড়ার চায়ের দোকানে বসে গল্প করছে কয়েকজনের সাথে। আমাকে দেখেই 'কি রে বাপি, কোথায় যাচ্ছিস? ব'লে ডেকে উঠলো। অনেকদিন পর দেখা। অগত্যা দাঁড়াতেই হ'লো। কোথায় যাচ্ছি, কেমন আছি, কি করছি, ছেলেমেয়ে কে কি করছে এরকম পরস্পর নানা কথা বিনিময় হ'লো। এরকম নানা কথার মাঝে হঠাৎ দেখলাম ধরা গলায় সে বলছে, তুই খুব ভালো আছিস! তোকে দেখে খুব ভালো লাগছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে দেখি তোকে যেতে। তুই খুব ভালো জিনিস নিয়ে আছিস। এখন কোথায় যাচ্ছিস? সৎসঙ্গে? কথাগুলি বলার সঙ্গে দেখলাম তার চোখ ছলছল করছে। আমার দেরি হ'য়ে যাচ্ছিল সৎসঙ্গে যেতে। তবুও এরকম এক সংবেদনশীল মুহূর্তে পুরনো বন্ধুকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিলো না। আমি তাকে কোথায় যাচ্ছি না বলা সত্ত্বেও সে বুঝে গেল আমি সৎসঙ্গে যাচ্ছি। আমি সৎসঙ্গে যাচ্ছি সেটা এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। তাই বললাম, না এই একটু এদিকে কাজে যাচ্ছি। ও বললো, না বললে কি হবে, তোকে দেখেই বুঝেছি তুই সৎসঙ্গে যাচ্ছিস। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পোশাক দেখলেই সবাই ভাবে ও বোঝে যে, সৎসঙ্গে যাচ্ছি। এটা হামেশাই হয়। পোশাক দেখেই প্রশ্ন ছুটে আসে, কোথায়? সৎসঙ্গে? যেন সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি মানেই সৎসঙ্গ। আসলে সৎসঙ্গে যাই কিংবা অন্য কোথাও যাই সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি এলাকায় এটা দীর্ঘদিনের পোশাক পরিচিতি। আর সৎসঙ্গে যাওয়ার কথা এড়িয়ে যাওয়ার পিছনে পুরোনো স্মৃতি ছিল।
যাই হ'ক, কথায় কথায় বন্ধু বললো, তোরা গোটা পরিবার এসব নিয়ে বেশ ভালো আছিস। আমি এই কথায় একটু হাসি দিয়ে চুপ ক'রে রইলাম। সে হেসে পুনরায় আবার একই কথা বললো। বুঝতে পারলাম তার এই কথায় হাসির সঙ্গে একটা দুঃখ ঝ'রে পড়লো। ওর এ কথায় আমি বললাম, দ্যাখ, আজ ভালো আছি, জানি না কাল ভালো থাকবো কিনা। বন্ধু বললো, না না তুই ভালো থাকবি। আমি বললাম, তুই কেমন আছিস। সে বললো, এই একরকম আছি। চলে যাচ্ছে। কেটে যাচ্ছে কোনওরকমে। একটা বিষন্নতা ঝ'রে পড়লো কথায়। আমি বললাম, তুই এখানে কতক্ষণ আছিস? আমি সাড়ে ন'টার মধ্যে ফিরে আসবো। বন্ধু বললো, আমি সাড়ে আটটার মধ্যে বাড়ি চলে যাবো। আটটা খুব বেশি হ'লে সাড়ে আটটার বেশি থাকি না। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই। সকালে, দুপুরে ও রাতে একদম একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই টিফিন ও খাওয়া সেরে নিই। বরাবর একটা নিয়ম মেইন্টেন করতে হয়; কারণ ওষূধ খেতে হয়। তা নইলে শরীরটা খারাপ করে। আমি বললাম, কেন কি হয়েছে? কি ওষুধ খাস? ও বললো, আর বলিস না। ওই প্রেসার, সুগার, হার্ট আর কি। একটা নিয়ম ক'রে ওষূধ খেতে হয়।
আমি চুপ ক'রে দাঁড়িয়ে কথাগুলি শুনলাম। মনে মনে ভাবলাম অনেক কিছু। পরবর্তীতে সেগুলি বলবো। আমি বললাম, আসলে আমরা কেউ ভালো নেই। আমাদের তো বয়স হ'য়ে গেল কিন্তু ঘরে ঘরে বাচ্চা বুড়ো কেউ ভালো নেই। আর ছোটোদের তো কোনও দোষ নেই। তারা ভালো নেই আমাদের দোষে। তাদের কি দোষ ভালো না থাকার। আমরা তো তাদের ভালো থাকার পথ দেখিয়ে দিইনি, শেখায়নি ভালো থাকার তুক। নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম যৌবনে। দাপিয়ে বেড়িয়েছি এখানে সেখানে। এখন তারা যৌবনে, আমরা ঘরের কোণে। তাই ছোটোদের কোনও দোষ নেই। আমরা আমাদের নিজের ও আমাদের ছেলেমেয়েদের ভালো না থাকার জন্য আমরাই দায়ী। আমরা নারীপুরুষ আমাদের যৌবনের দিনগুলি দেখি আমাদের ছেমেয়েদের মধ্যে। ওরা আমাদের আয়না।
এইকথা শুনে বন্ধু আমার দিকে ম্লান হাসি হেসে ফ্যাল ফ্যাল ক'রে চেয়ে রইলো। সঙ্গের অন্যরা আমার কথার কোনও প্রতিবাদ করলো না। নীরবে মাথা নেড়ে শুধু সমর্থন করলো। তারপর বন্ধু বললো, তোর একটু সময় হবে? আমি বললাম, কেন? বন্ধু বললো, একটু তোর সঙ্গে প্রাইভেট ছিল। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম ৭টা বাজে। সৎসঙ্গ আরম্ভ হওয়ার সময় হয়েছে। মনে মনে ভাবলাম অনেকদিন পর দেখা হয়েছে, কি জানি কি কথা বলবে। এমনিতেই প্রথম থেকেই একটা বিমর্ষতা চোখেমুখে ফুটে উঠছিল। পরে কথা বলতে গিয়ে চোখ ছলছল করছিল ও গলা ধ'রে গেছিল। ভাবলাম, নিশ্চয়ই কিছু একটা বলতে চাইছে। ব'লে হালকা হ'তে চাইছে বুকের বোঝাটা নাবিয়ে নিয়ে। আমি বললাম, ঠিক আছে, বল। ও চায়ের দোকানের বেঞ্চি থেকে উঠে পড়লো। বললো, চল। আমরা দু'জনে একটু দূরে এগিয়ে গিয়ে নির্জনে দাঁড়ালাম।---প্রবি।
ক্রমশঃ
( লেখা ২রা আগষ্ট'২০২৩)
No comments:
Post a Comment