বাংলাদেশের গণ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর যমুনা টিভির সম্প্রচারিত খবরে জানা গেল, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কমিটির পক্ষ থেকে ছাত্র নেতারা ঘোষণা করলেন,
প্রথমে ছাত্র নাগরিকদের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন করার জন্য এই জয় ছাত্র আন্দোলনের শহীদ ও হতাহত এবং মুক্তিকামী ছাত্র জনতাকে উৎসর্গ করছি। ছাত্র নাগরিক আন্দোলনকারীদের এক দফা দাবি ছিল হাসিনার পতন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ। একজন ব্যক্তিকে সরালেই সমস্যার সমাধান হবে না। বরং যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে দিয়ে এই ফ্যাসিজমের জন্ম হয় সেই কাঠামোর বিলোপ ক'রে এক নোতুন বাংলাদেশ, এক নোতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত আমাদের করতে হবে। সেই জায়গা থেকে শেখ হাসিনার পতন আমাদের আন্দোলনের প্রথম ধাপ যেটা আন্দোলনকারীরা অর্জন করেছে। এখন দ্বিতীয় ধাপের দিকে যেতে হবে। আন্দোলনকারী ছাত্র নাগরিকদের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন একটা জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করা হবে।
সমন্বয়কদের ঘোষণা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রস্তাব করা হবে ব'লে জানা গেছে। সেই জাতীয় সরকারে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নাগরিকদের অংশ থাকবে। সমাজের নানা নাগরিক সমাজের নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত সকল পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ক'রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে কারা থাকবে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তার নাম ঘোষণা করা হবে। যারা শহীদ হয়েছে তাদেরকে জাতীয় বীর হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিগত কয়েক বছরে যারা এই ফ্যাসিষ্ট সরকারের দ্বারা নিহত হয়েছেন তাদেরকেও আজকের দিনে স্মরণ করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ শুধু নয় গণ হত্যার সঙ্গে জড়িত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভোটাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি সহ হাসিনার বিচার করা হবে এবং ফ্যাসিজমের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হবে। অভ্যুত্থানকারী ছাত্র নাগরিকের সমর্থিত বা প্রস্তাবিত সরকার ছাড়া আর কোনও সরকারকে সমর্থন করা হবে না। সেনা সমর্থিত সরকার বা রাষ্ট্রপতি সমর্থিত কোনও সরকারকে বিপ্লবী ছাত্র জনতা গ্রহণ করবে না। বিভিন্ন সমন্বয় আন্দোলনকারী ও নিরপরাধ কারাবন্দীদের, রাজবন্দীদের ২৪ঘন্টার মধ্যে মুক্তি দিতে হবে। সকলকে সতর্ক থাকার কথা ঘোষণা করা হয়, যে কোনও রকম অঘটন, নাশকতা, সহিংসতা থেকে যাতে এই আন্দোলনের ন্যায্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে। ছাত্র সমন্বয়কারী নেতারা ঘোষণা করে, এ দেশ আমার, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আমাদের, মুক্তিকামী ছাত্র জনতাকে তা রক্ষা করতে হবে। কোনও প্রাণ্নাশ, সহিংসতা আমরা চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে অবস্থান করবো। এবং যাদের বিচার করা হবে তাদের একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ন্যায় বিচারই আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠা করবো। আমরা বৈষম্য দূর করার জন্য, সমাজের ন্যায় বিচার ও জীবনের নিরাপত্তার জন্যই আমরা আন্দোলন ঘোষণা করেছিলাম, সেই ঘোষণার প্রতি সবাই যেন শ্রদ্ধাশীল থাকে এবং বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে এবং আমরা আহ্বান করছি বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সকলের জীবন, জান মালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশী সতর্ক থাকবে। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধ থেকে সকল পরিকল্পনাকে নস্যাত ক'রে দিতে হবে। ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে দল, মত, সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমরা জড় হয়েছি। কোনও ধরণের সাম্প্রদায়িক উস্কানি, নাশকতা বা বিভাজনের চেষ্টা করা হ'লে মুক্তিকামী ছাত্র জনতাকে তা রুখে দিতে হবে। গণ অভ্যুত্থানের জন্য সকল দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আগামী ২৪ঘন্টার মধ্যেই লিয়াজোঁ কমিটি ঘোষণা করা হবে যারা সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে।
এ প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন মনে জাগলো।
১) সব আন্দোলনেই তা' সঠিক বা বেঠিক যাই-ই হ'ক না কেন যে সম্পদ ও জীবন ক্ষয়ক্ষতি হয় আর তা আন্ডারস্টুড। কিন্তু যে মানব সম্পদ ও বিশাল অঙ্কের জাতীয় সম্পদ ক্ষতি হ'লো তা'তে কার লাভ আর কার ক্ষতি হ'লো? এই বিশাল ক্ষয়ক্ষতির গুনাগার কারা দেবে? এই বিশাল ক্ষতির কোনোদিন পূরণ হবে? এই বিশাল ক্ষতির ক্ষত ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে আরও বড় ক্ষতিকে ডেকে আনবে না তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকের ওপর?
২) যার বা যাদের বুক খালি হ'ল সেই বুক আর কোনোদিন পূরণ হবে? তাকে বা তাদেরকে তো খালি বুক নিয়ে যতদিন বাঁচবে ততদিন 'শূন্য এ বুকে পাখি মোর ফিরে আয়, ফিরে আয়' এই হাহাকার নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচতে হবে?' তাহ'লে কি একটু সতর্কতার অভাব ছিল? আবেগে ভেসে যাওয়া কি কাল হ'লো?
৩) ছাত্র আন্দোলন তো ছিল কোটা সংস্কারের আন্দোলন। তা' এই ছাত্র আন্দোলন রাতারাতি 'হাসিনার পতন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ' আন্দোলনে ঘুরে গেল কি ক'রে? ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় কি এর একমাত্র কারণ?
৪) কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ফ্যাসিজম থেকে রাষ্ট্রকে মুক্তি দিতে পারে? এ সম্পর্কে একটু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলে ভালো হ'তো। যাই হ'ক, সময় এর উত্তর দেবে।
৫) আর আবু সাঈদের মত শহীদ বীর ছাত্রছাত্রী বা সাধারণ মানুষ যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের পরিবার কি মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের মত কোনও বিশেষ সুযোগ বা সুবিধা পাবে আগামী নোতুন সরকারের কাছ থেকে?
৬) দেশের সম্পদ রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে খুব ভালো লাগলো। ইতিমধ্যে দেশের সম্পদের ক্ষয় ও ক্ষতির পরিমাণ কত? আর তা' জানালে সবার একটা ধারণা হ'তো, ধারণা হ'তো আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি কি হওয়া উচিত।
৭) "গণ হত্যার সঙ্গে জড়িত, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভোটাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি সহ ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিচার হবে এবং ফ্যাসিজমের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা হবে।"
আর যারা আন্দোলন চলাকালীন জাতীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করলো এবং আগামী সরকারকে ও দেশের সাধারণ জনগণকে এই ক্ষয়ক্ষতির জন্য যে ভয়ংকর সমস্যার সম্মুখীন হ'তে হবে সে সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী কি থাকবে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয় কমিটির ও সরকারের?
৮) "এ দেশ আমার, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আমাদের, মুক্তিকামী ছাত্র জনতাকে তা রক্ষা করতে হবে।"
বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কমিটির পক্ষ থেকে ছাত্র নেতাদের এই ঘোষণা মনে আশা সঞ্চার করে। কিন্তু এই ঘোষণা কি সময়োচিত হ'লো? আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে এবং চলাকালীন এই ব্যাপারে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ছাত্র নেতাদের পক্ষ থেকে ক্রমাগত সতর্ক করা কি সময়োচিত হ'তো না? এটা কি সেই প্রবাদের মত "চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে"? দেশের যা ক্ষতি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির যা ক্ষতি হয়েছে তা কি আর কোনোদিন পূরণ হবে? এই ক্ষতি থেকে কি কোনও শিক্ষা নেওয়ার আছে?
৯) "কোনও প্রাণনাশ, সহিংসতা আমরা চাই না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে অবস্থান করবো।" এই ধরনের ঘোষণা জনসাধারণের মনে সুখ ফিরিয়ে না দিতে পারলেও স্বস্তি এনে দিতে পারে। প্রাণে নিরানন্দ ও নিরাশার মাঝেও আনন্দ ও আশা এনে দিতে পারে। কিন্তু কোটা আন্দোলন ও পরবর্তী গণ অভ্যুত্থান এবং শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী পদ ত্যাগ ক'রে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরবর্তী ঘটনাবলী কি প্রাণহীন, অহিংস আন্দোলন ছিল? শান্তিপূর্ণভাবে রাজপথে অবস্থান ছিল? শান্তি দিয়ে কি অহিংসাকে থামানো যায় নাকি অহিংসা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়? নাকি দু'টোরই প্রয়োজন? মানদন্ড টাই বা কি? এসব ক্ষেত্রে কী করণীয়? দেশের ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে আগামী দিনে সরকার, রাজনৈতিক দল, ছাত্র আন্দোলনকারী ও জনগণের এই প্রশ্নে নোতুন ক'রে ভাবার দিক খুলে দিল কি?
১০) "আমরা বৈষম্য দূর করার জন্য, সমাজের ন্যায় বিচার ও জীবনের নিরাপত্তার জন্যই আমরা আন্দোলন ঘোষণা করেছিলাম, সেই ঘোষণার প্রতি সবাই যেন শ্রদ্ধাশীল থাকে।"
ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের মুখ দিয়ে ঘোষণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার আবেদন করা হয়েছে দেখে স্বপ্ন দেখি ও বেশী বেশী ক'রে স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে যে হয়তো আগামী দিনে মানবিক গুণসম্পন্ন ছাত্রদের হাত ধ'রে দেশ আবার গড়ে উঠবে। কিন্তু যখন, রাস্তার ওপর দেওয়ালে নোংরা ভাষায় বিরাট বড় বড় ক'রে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়াল লিখন যা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হ'য়ে যায়, মুখ লুকোবার জায়গা পাই না, বিশ্বের দরবারে গোটা বাঙালি জাতের ওপর কলঙ্ক লেপন হ'য়ে যায় এবং এর সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের মূর্তির মাথার ওপর পা রাখা, পা রেখে হাতুড়ির আঘাতে, বুল ডোজারের ধাক্কায় মাথা ভেঙে ফেলে দেওয়া এবং দেশের ও দশের জন্য প্রাণ উৎসর্গিত ও দেশের মানুষের হাতেই পরিবার সহ নির্মম নিষ্ঠুরভাবে নিহত স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মাথার ওপর পেচ্ছাপ করা দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হ'য়ে যায়, ঝুরঝুর ক'রে ভেঙে পড়ে মাথার ওপর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে হাজার হাজার স্বপ্নগুলি। মনে প্রশ্ন জাগে, এগুলি কি শ্রদ্ধার বহির্প্রকাশ? এগুলিই বাংলা ও বাঙ্গালীর কৃষ্টি-সংস্কৃতি? এই কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে কিভাবে নেবে বাংলাদেশের বর্তমানের ছাত্র নাগরিকের গণ অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা আগামী দিনের নোতুন সরকার?
১১) মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিল তাঁরা বঙ্গবন্ধু মুজিবার রহমানের একসময়ের মুক্তিযুদ্ধের সাথী ছিল তাঁরা শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তিকে ভেঙ্গে ফেলা, মাথায় পা রাখা ও মাথার ওপর পেচ্ছাপ করার ঘটনা ও দৃশ্যকে কিভাবে নেবেন?
১২) বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় যারা ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিল তাদেরই বা এইসব ব্যাপারে বিশেষ ক'রে ১১ নম্বর প্রশ্নের প্রতিক্রিয়া কি?
যাই হ'ক, বাংলাদেশ ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক কমিটির ঘোষণাকে সামনে রেখে যে প্রশ্নগুলি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেইগুলি ভাবা ও আলোচনা করার জন্য তুলে ধরলাম। আগামী দিনে বাংলাদেশের ও জনগণের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতিকে দ্রুততার সঙ্গে সামলে নিয়ে নোতুন ক'রে আবার দেশের ও জনগণের সর্ব্বাঙ্গীন সাফল্যের কথা, মঙ্গল ও দ্রুত উন্নতির কথা মাথায় রেখেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিতেই এই বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
No comments:
Post a Comment