জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়টা একটু আলোচনা ক'রে দেখা যাক। বর্তমান বাংলাদেশ পূর্বে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে ভারতের পশ্চিমে অবস্থিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রের একটা অংশ ভারতের পূর্বে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
তখন পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ছিল ‘তারানা এ পাকিস্তান'।
১) বিশিষ্ট উর্দু কবি জগন্নাথ আজাদ পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় সঙ্গীত ‘তারানা এ পাকিস্তান' লিখেছিলেন। আসুন গানটি একটু দেখে নিই।
"অ্যায় সারজামিনে পাক
জারে তেরে হেন আজ সিতারোঁ সে তাবনাক
রোশন হ্যায় কেহকাশান সে কাহিন আজ তেরি খাক
অ্যায় সরজামিনে পাক।"
( হে পাকিস্তানের ভূমি, নক্ষত্ররা নিজেরাই আলোকিত করে তোমার প্রতিটি কণা, রংধনু তোমার ধূলিকে উজ্জ্বল করে )।
২) ১৪ অগস্ট ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙে পাকিস্তান তৈরি হল৷ লর্ড মাউন্ট ব্যাটন ও লেডি ব্যাটন ও পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নার উপস্থিতিতে নবগঠিত রাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় সঙ্গীত ‘তরানা এ পাকিস্তান’ গাওয়া হয়৷
৩) জগন্নাথ আজাদ ছিলেন হিন্দু ও ভারতীয় এক উর্দু কবি, লেখক এবং শিক্ষাবিদ। জগন্নাথ আজাদ 1918 সালে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালিতে (বর্তমান পাকিস্তান) জন্মগ্রহণ করেন।
৪) পরে ১৯৫০ সালে খোদ জাতির পিতা মহম্মদ আলি জিন্নার ইচ্ছেকে শিকেয় তুলে পরিবর্তন করা হয় জাতীয় সঙ্গীতের৷
৫) 1952 সালে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হ'লো।
পাকিস্তানি কবি হাফিজ জুলুন্ধ্রি দ্বারা লিখিত
"পাক সরজ়মীন শাদ বাদ
কিশ্ৱরে হসীন শাদ বাদ।" গাওয়া হ'তো।
৬) ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বর্তমান বাংলাদেশ পূর্বে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের অংশ থাকা অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে "পাক সরজ়মীন শাদ বাদ কিশ্ৱরে হসীন শাদ বাদ" এই গানটি গাওয়া হত।
৭) পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে জাতীয় সংগীত "পাক সার জামিন সাদ বাদ"-এর পাশাপাশি "পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ" এই গানটিও গাওয়া হত। এই গানটির লেখক ছিলেন বাঙালি কবি গোলাম মোস্তফা। গানটি হ'ল,
"পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ
পূর্ব বাংলার শ্যামলিমায়, পঞ্চনদীর তীরে অরুণিমায়
ধূসর সিন্ধুর মরু সাহারায়, ঝাণ্ডা জাগে যে আজাদ।"
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হ'লে নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীতের প্রয়োজন হ'য়ে পড়ে। তখন বাঙালী ভারতীয় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
১৯৭১ সাল থেকে আজও নিম্নলিখিত এই গানটি গাওয়া হয়।
"আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে—
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি॥"
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংদেশের সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে এই গান প্রথম জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হয়। ১৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ তারিখে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে এ গানটির প্রথম দশ চরণ সদ্যগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।[
এখন আবার বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পরে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের দাবী উঠছে। এখন এই পরিবর্তন কেন? কি দরকার পড়লো হঠাৎ এই পরিবর্তনের? এই পরিবর্তনের ব্যাপারটা আজকে নোতুন নয়। এই পরিবর্তন আগেও হয়েছে।
বিঃ দ্রঃ
বিশিষ্ট উর্দু কবি জগন্নাথ আজাদ হিন্দু ও ভারতীয় ছিলেন তাই তাঁর লেখা গান পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত থেকে বাদ পড়ে। কিন্তু তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন পাকিস্তানে।
বাঙালি কবি গোলাম মোস্তফার লেখা "পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ" গানটি বাংলাদেশে বাদ পড়ে কারণ গানটি প্রথমত পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীতের বিকল্প হিসেবে গানটি বাংলাদেশে গাওয়া হ'তো এবং গানটিতে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' ছিল তাই।
আর, "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি" গানটির রচয়িতা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথমত বাঙালী হ'লেও হিন্দু বাঙালী, দ্বিতীয়ত ভারতীয়। তাই বাংলাদেশের পট পরিবর্তনে বর্তমান শাসক দলের মনে হ'তে পারে আমার দেশের কবি, আমার দেশের নাগরিক, আমার ধর্মের লোক দিয়ে আমরা আমাদের দেশ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচনা করাবো। ইতিমধ্যে এই ধরণের দাবীও উঠেছে।
এই সংকীর্ণ মনোভাব যদি দেশের শীর্ষস্তরের নেতৃবৃন্দের ইডিওলজি হয় আর তা' বাস্তবায়িত হয় বাংলাদেশে তাহ'লে "স্বদেশে পুজাতে রাজা বিদ্ধান সর্বত্র পূজ্যতে" চাণক্যের এই শ্লোক আজ মিথ্যা ব'লে প্রমাণ হ'য়ে আরও একবার ইতিহাস সৃষ্টি হবে। হবে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের থুড়ি মুসলমানদের হাত ধ'রে। কারণ বাংলাদেশ এখন বাঙালীদের না।
চাণক্যের "স্বদেশে পুজাতে রাজা বিদ্ধান সর্বত্র পূজ্যতে" এই শ্লোকটির অর্থ হলোঃ 'রাজা কেবলমাত্র নিজ রাজ্যেই সম্মান পান, বিদ্ধান সর্বত্র সম্মান পান। কিন্তু বর্তমান সভ্যতা এই শ্লোকের অন্তর্নিহিত অর্থকে এখন আর মূল্য দেয় না। এখন রাজাও বিদেশ তো দূরের কথা নিজের দেশেই সম্মান পান না এবং বিদ্ধানের স্থান এখন সর্বত্র এই কথা ভুল। মাথা উঁচু ক'রে চলা বিদ্ধানের স্থান এখন দেশে বিদেশে ক্ষমতাশালীদের পায়ে আর পায়েদের স্থান এখন মাথায়।
যাই হ'ক, পরিবর্তন হ'তেই পারে। তবে পরিবর্তন যেন বর্তমানকে ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে 'আমার সোনার বাংলা' গানের মধ্যে যে বাংলার মাটি, জল, বায়ু, ফল, ঘর, হাট, বন, মাঠ এবং বাঙ্গালীর পণ, আশা, কাজ, ভাষা, প্রাণ, মন, ভাইবোন ইত্যাদির গন্ধ পাওয়া যায় সেই গন্ধকে যেন ছাড়িয়ে যায় নোতুন গানের কস্তূরী সুবাস। আমরা অপেক্ষায় রইলাম সেই সুবাসের জন্য।
তাই, যা হওয়ার তা' সময় নির্দ্ধারণ ক'রে দেয়। সময় সবসে বড়া বলবান।
প্রকাশ বিশ্বাস
ভদ্রকালী, উত্তরপাড়া।
ক্রমশঃ। পরবর্তী পর্ব ২-এ।
No comments:
Post a Comment