Powered By Blogger

Friday, January 3, 2025

প্রবন্ধঃ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন ও সময়। (পর্ব ২)

বাংলাদেশে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করার আওয়াজ উঠেছে। শুরু হয়েছে আন্দোলন। প্রথম আন্দোলনে আওয়াজ উঠেছিল সরকারি চাকরীতে কোটা সংস্কার করতে হবে। তারপর সেটা ঘুরে গিয়ে আন্দোলন হ'য়ে গেল সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে। সরকার পরিবর্তনের পর মূর্তি ভাঙ্গা, ভাঙচুর, লুটপাটের আন্দোলন। সেই মূর্তি ভাঙ্গা আন্দোলনে আঘাত আসলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর। ঐ ভাংচুরের আন্দোলনে হাসিনার মূর্তি, ছবি, শেখ মুজিবরের মূর্তি, হাসিনার গণভবন, শেখ মুজিবরের বাসভবন, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ভাংচুরের সঙ্গে সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মূর্তি ভাঙ্গার আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এখন শুরু হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের পরিকল্পনা আর তাই নিয়ে চলছে বাদবিতন্ডা। চলছে পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি অযুক্তির বন্যা।

এখন প্রশ্ন হঠাৎ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের আওয়াজ উঠলো কেন? এই নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলছে। একটা ভয়ংকর অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। যে যার বুঝ মত মন্তব্য করছে। গানটির প্রেক্ষাপট, গানটির মর্মার্থ, গানটির রচয়িতা ইত্যাদিকে নিয়ে চলছে কাটাছেঁড়া, চলছে অস্ত্রোপচার।
যাই হ'ক, প্রশ্ন জাগে মনে, কাকে নিয়ে গানটা লেখা হয়েছিল? অখন্ড বাংলার পক্ষে বঙ্গভঙ্গ রোধের জন্য যদি এই গান লেখা হয়ে থাকে তাহ'লে লেখা হয়েছিল ব'লে এই গান অখন্ড বাংলার পরিবর্তে খন্ডিত বাংলার এক অংশ বর্তমানে একটি দেশ, সেই দেশ বাংলাদেশের জন্য গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া যেতে পারে না? বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এই গান রচনা হয়েছিল বলেই এই গান অচ্ছুৎ হ'য়ে গেল? আর যদি সেদিন বাংলা ভাগ না হ'তো? যদি সেদিন বাংলায় হিন্দু মুসলমানের সংখ্যা সমান সমান থাকতো তাহ'লে আজকের বাংলাদেশে যে ভারত বিরোধীতা, বাঙালী হওয়া সত্ত্বেও শুধু হিন্দু হওয়ার জন্য যে হিন্দু বিরোধীতা তা' পারতো? এই অন্যায় বিরোধীতা কি পশ্চিমবঙ্গে প্রকট? দুই বাংলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৪৭ সালের পর ও ৭১ সালের পর জনসংখ্যার হার কি প্রমাণ করে? তর্ক, ঝগড়া চাই না। দুই বাংলার % দেখা যাক।

২০২১ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের তিন কোটি ১১ লাখ ৪৪ হাজার মুসলমানের মধ্যে ২.৪ কোটিই বাঙালি মুসলমান।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর 1974 সালে মোট জনসংখ্যার 13.50% হিন্দু ছিল। মোট জনসংখ্যা ৯,৬,৭৩,০৪৮ তার মধ্যে 7,14,78,543 মুসলমান।
২০২২ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমান হিন্দুর জনসংখ্যা ১,৩১,৩১,১০৬ ( ৭.৯৫%)।

বাংলাদেশ মুসলমান অধ্যুষিত সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল ব'লে অখন্ড ভারতের পূর্ব বাংলা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশ সেই অখন্ড ভারতের অখন্ড বাংলার খণ্ডিত এক অংশের জন্য 'আমার সোনার বাংলা' গানটি জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে অন্তত এটা জেগে থাকে নাকি আমরা একদিন অখন্ড বাংলা হিসেবে কিংবা ভারতের অংশ হিসেবে এক দেশ ও হিন্দু মুসলমান এক ছিলাম? আমরা যে একদিন বাঙালী পরিচয়ে এক ছিলাম, হিন্দু মুসলমানের পরিচয়ের থেকে অনেক অনেক বড় ও প্রধান ছিল উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বাঙালী সত্ত্বার পরিচয় এইটা যাতে মনে না পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের মনে তার জন্যই একেবারে চিরতরে ভুলিয়ে দেওয়ার, মুছে দেওয়ার নোংরা প্রয়াস? সেইজন্যই বাংলাদেশের বাঙালী ভাষাকেও ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য, মুছে দেওয়ার জন্য বিদেশী ভাষার সংমিশ্রণ হয়েছে? একদিকে হিন্দু বাঙ্গালীর অস্তিত্বে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে ১৯৪৭-এ দেশভাগের সময় থেকে ১৯৭১ সালে ও বর্তমানে ২০২৪-এ আর দ্বিতীয়ত সুপরিকল্পিতভাবে মুসলমানদেরও বাংলা ভাষা ভুলিয়ে দেওয়ার গোপন প্রয়াস কার্যকর রয়েছে বাংলাভাষাকে বিদেশী ভাষার আবরণে ঢেকে দিয়ে। যার জন্য বাংলাদেশের মুসলমান বাঙালীদের বাংলা ভাষা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোঝা যায় না।

আর, 'আমার সোনার বাংলা' এইগানের শব্দ নিপাট সহজবোধ্য বাংলা শব্দ দিয়ে গঠিত। এইগানের মর্মকথা কি? এই গানের মর্মকথা কি ভারতের সঙ্গে কিংবা অখন্ড বাংলার সঙ্গে একাত্ম ছিলাম এই বোধকে শুধু প্রকট ক'রে তোলে? নাকি সঙ্গে অখন্ড গ্রাম বাংলার সার্বিক যে সুন্দর মনোরম অপূর্ব রূপ, সেই রূপকে এই গানের কথাগুলি রিফ্লেকট ক'রে? কোনটা? আর শিল্পীর রংতুলি হাতে বাংলার প্রাকৃতিক ছবি আঁকার মত কবির হাতে শব্দ দিয়ে তৈরী কবিতার মধ্যে দিয়ে কি অখন্ড বাংলার ছবি আঁকা যেতে পারে না? বাংলাদেশের বাংলার রূপ নিখুঁতভাবে এই গানের মধ্যে কি তুলে ধরা হয়নি? হাজারো কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, ছবি, নাটক, সিনেমা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের বাংলার রূপ কি তুলে ধরা হয়নি বুদ্ধিজীবীদের হাত দিয়ে? তার জন্য 'আমার সোনার বাংলা---' গানের প্রেক্ষাপটের বিষয়টাকে তুলে ধ'রে, কবির জাত, কবির ভারতীয় পরিচিতি, কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতার বিষয়কে তুলে ধ'রে বিতর্ককে উস্কে দেওয়ার ঘৃণ্য মনোভাব কি একটা দেশের জনগণের আধুনিক সুস্থ, রুচিশীল, শিক্ষিত মনোভাবের পরিচয়? এই পরিবর্তনের মানসিকতা ছিল বাংলাদেশের আধুনিক ছাত্র সমাজের আন্দোলনের নেতা, কর্মী ও সমর্থক ছাত্রদের? কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতার মানসিকতা কি শুধু বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য ছিল, হিন্দুদের জন্য ছিল না? এইভাবে বিভাজন করার কি কোনও লজিক আছে? এইগুলি ভাঙনের ভয়ংকর নোংরা মানসিকতাকে মজবুত করার পক্ষে কি অজুহাত নয়? এইগুলি কি ব্রিটিশদের নোংরা মানসিকতার ডিভাইড এন্ড রুলের ট্র্যাডিশান নয়? এই গান পরিবর্তন করার আসল উদ্দেশ্য কি? আড়ালে কি আছে?
যা বলার সরাসরি বলুক বাংলাদেশী যারা চান এই গানের পরিবর্তন। ঐ কোটা আন্দোলনের ছদ্মবেশে সরকার পতনের মত নোংরা খেলার ছক না কষে সোজাসুকি সরাসরি বলে দিক ভাই কোনও হিন্দু কবির লেখা গান বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হবে না। বাংলাদেশ মুসলমানদের বাংলা, বাঙ্গালীর বাংলা নয়। এই জন্যেই তো রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ভাঙ্গা হয়েছিল। এই জন্যেই তো কবি নজরুল ইসলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্ম হওয়া একজন ঘটি বাঙালী হওয়া সত্ত্বেও, একজন ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও, একজন হিন্দু নারীকে বিয়ে করা সত্ত্বেও, সন্তানের নাম কৃষ্ণ মহম্মদ দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ তাঁকে জাতীয় কবি করেছে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার জন্য। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের শুধুমাত্র শোভা বর্দ্ধনের জন্য কবি নজরুল ইসলামকে জন্ম থেকে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বাস করা নিজের জন্মভূমি, নিজের বাসভূমি থেকে ছিনিয়ে এনে শেষ বয়সে বাংলাদেশের নাগরীকত্ব দিয়ে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিল। কবি নজরুল ইসলাম কি বাংলাদেশে যেতে চেয়েছিলেন? তখন কি তিনি সেইসময় শারীরিক মানসিক সুস্থ অবস্থায় ছিলেন? তিনি কি স্বইচ্ছায় নিজের দেশভূমি, নিজের জন্মভূমি, নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন? তিনি কি নিজেকে সস্তা মুসলিম গন্ডীর মধ্যে কোনোদিন বেঁধে রেখেছিলেন? এইসব প্রশ্ন এখন উঠবে না? কবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি এত অপমান, এত লাঞ্ছনা বাংলাদেশীদের কিসের জন্য? হিন্দু ব'লে? ভারতীয় ব'লে? বাংলাদেশী নয় ব'লে? আর, বাংলাদেশে না জন্মেও, বাংলাদেশী না হয়েও, ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও, হিন্দু নারী বিয়ে করা ও ছেলের নাম কৃষ্ণ মহম্মদ নাম রাখা সত্ত্বেও এত প্রেম, এত ভালোবাসা কবি নজরুল ইসলামের প্রতি কিসের জন্য? শুধুমাত্র একজন প্রথিতযশা মুসলমান কবি হওয়ার জন্য? তাঁর আকাশজোড়া খ্যাতির জন্য? আজ যদি তিনি অখ্যাত হতেন?

যাই হ'ক, আমরা দিন দিন ক্রমশঃ দেখতে পাচ্ছি নির্ম্মম অপ্রিয় সত্য ও দুঃখের, অত্যন্ত বেদনার কথা যে বাংলাদেশ বাঙালীদের জন্য নয়, বাংলাদেশ বাঙালী মুসলমানদের দেশ নয় শুধুমাত্র পুরোপুরি মুসলমানদের বাংলাদেশ হ'য়ে উঠছে। এরপরও স্বপ্ন দেখে মূর্খের মত অখন্ড বাংলাদেশের!!!!!!!!!!!!!!!!
ক্রমশঃ পরবর্তী ৩য় পর্বে।
( লেখা ৭ই সেপ্টেম্বর'২৪)
May be an image of text

No comments:

Post a Comment