মূর্তি পূজা ও শ্রীশ্রীঠাকুর।
মা চলে গেছে বাপের বাড়ি ছেড়ে আজ দু'দিন হ'লো শিবলোকে। বাড়িটা তাই বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কোনও কিছুই ভালো লাগছে না। এর থেকে আসছে আসছে ভালো ছিল। তার থেকেও ভালো একেবারে না আসা। যদি চলেই যাবে তাহ'লে আর আসা কেন? মন বলে, এসো মা তুমি, ব'সো মা তুমি, থাকো মা তুমি আমারও ঘরে। তোমারো গুণে গুণান্বিত হ'য়ে জীবন উঠুক ভরে।
তাই মা যখন চলে যায় তখন আবার শূন্যতায় ভরে ওঠে মন, অন্ধকার ঘিরে ধরে জীবন। কয়েকদিনের জন্য আলোয় ঝলমল ও আনন্দে ভরপুর হ'য়ে ওঠা জীবন মা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার ডুবে যায় হতাশার অন্ধকারে। তারপর আবার সেই দিন গত পাপ ক্ষয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই আনন্দ সাময়িক হয়? কেন এই সাময়িক কৃত্রিম আনন্দ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হতাশার ঘোর অন্ধকারে ডুবে যায় জীবন? কেন 'কেমন আছেন' প্রশ্ন করলে ভেসে আসে ক্লান্ত বিধ্বস্ত কন্ঠস্বর, 'অ্যায় চলে যাচ্ছে আর কি; দিন গত পাপ ক্ষয়'? এর উত্তর কি এখন?
আসলে আমরা যে মূর্তি পুজা করি তা'তে কোনও প্রাণ থাকে না। যদিও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয় শাস্ত্র মতে। কিন্তু তা'তে প্রাণ থাকে না। কেন থাকে না? প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে কে? প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার মতো সেই অসীম শক্তিধর সদ ব্রাহ্মণ কোথায়? যে কেউ প্রাণ প্রতিষ্ঠা করবে? মৃণ্ময়ী কে চিন্ময়ী ক'রে তুলবে এমন সেই ত্রিকালজ্ঞ বা ত্রিকালদর্শীর আধার কোথায়? মৃন্ময় অর্থাৎ মাটির তৈরী মূর্তির মধ্যে চিন্ময় অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ, জ্ঞানময় সত্ত্বার প্রকাশ ঘটাবেন অর্থাৎ চেতনা জাগ্রত করাবেন এমন শক্তিমান পুরুষ কে? আর্থিক শক্তিতে শক্তিমান কোনও মানুষ? রাজনৈতিক ক্ষমতার অধীশ্বর কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব? কোনও সরকারী প্রধান? কোনও সেলিব্রেটি? কোনও ধর্মাত্মা? কে? কে? কে?
তাই কোনও প্যান্ডেলে, কোনও মন্দিরেই চিন্ময়ী মা দূর্গা থাকেন না, থাকেন প্রাণহীন মৃণ্ময়ী মা দূর্গা। থাকে শিল্পীর হাতে তৈরী নানা ঢঙের আধুনিক মাতৃমূর্তি, থাকে রঙ্গিন আলোর ঝলকানি, থাকে নানা কারুকার্যে ভরা প্যান্ডেলের বাহার, থাকে মিথ্যে 'আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে' গানের মিথ্যে মন-প্রাণ-হৃদয়ের বহির্প্রকাশ। কেন এমন হয়? কারণ অতি প্রগতিই দূর্গতি।
তাই মা চলে যাবার সঙ্গে সব সাময়িক নকল আনন্দ উধাও হ'য়ে মন-প্রাণ ডুবে যায় হতাশা আর অবসাদে। সংসারে, জীবনে নেমে আসে দূর্গতির ঘোর আঁধার। কেন এমন হয়?
এমন হয় তার কারণ আমরা মৃন্ময়ী মা দূর্গার পুজা করি চিন্ময়ী মা দূর্গার পুজা করি না। আমরা মূর্তি পুজা করি। যে যে গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র নিয়ে মূর্তি গড়া হয়েছে মূর্তির সেই সেই গুণাবলী, বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রের পুজা করি না। মূর্তির সেই চরিত্রকে নিজের চরিত্রে, নিজের জীবনে রুপায়িত করি না, করতে সচেষ্ট হ'ই না। ফলে পুজা বন্ধ্যা হয়। বন্ধ্যা জমিতে যেমন ফসল হয় না ঠিক তেমনি প্রাণহীন বন্ধ্যা মূর্তিতে পুজাও হয় বন্ধ্যা। কোনও প্রার্থনাতে সাড়া মেলে না। সেই মূর্তি পুজাতে থাকে শুধু হৈহুল্লোড়, কোমর দোলানো নারীপুরুষের নাচগান, থাকে সুরাপানের হিক্কার, থাকে ধান্দাবাজি, থাকে বৃত্তি-প্রবৃত্তির বৃত্তে উন্মাদের মতো ঘুরপাক। তাই নকল আনন্দের মাঝে কেটে যাওয়া চারদিনের জীবন আসল আনন্দ থেকে বঞ্চিত হ'য়ে হতাশা অবসাদে ডুবে যায়। সেই বন্ধ্যা পুজোর নকল আনন্দের হ্যাং অভার কাটাতে আবার আবার বারবার চাই মূর্তি পুজো, অমূর্ত ভগবান বা Unseen God-এর পুজো। আর এমনিভাবেই জীবন এগিয়ে চলে দ্রুত অকাল সমাপ্তির দিকে। অর্থাৎ দিন গত হয় অর্থাৎ দিন যায় আর পাপ ক্ষয় হ'তে হ'তে সময়ের অনেক আগেই মৃত্যুর দিকে ঢ'লে পড়ে জীবন।
তাহ'লে মূর্তি পূজার কি কোনও সার্থকতা নেই? মূর্তি পুজা কি অসাড়? মূর্তি পুজায় কি কোনও লাভ হয় না?
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র মুর্তি পুজা সম্পর্কে পরিষ্কার বললেন, "পৌত্তলিকা (অর্থ মূর্তি বা পুতুল পূজা) কি? স্মৃতি বা ভাবপ্রতীকতা বা স্মারকতার (হিন্দুরা) উপাসক বলুন। আর কোন- না-কোন রকমের ভিতর দিয়ে কেই বা তা' নয় সেটাও বলুন? ঋষিদের কেতাবেও মূর্তিপুজার কথা নাই। কোরাণ শরিফ, বাইবেল বা বৌদ্ধ-গ্রন্থাদিতে মূর্তি পূজার কথা নাই। যেখানে ওসব ব্যবস্থা আছে তা' দেবতা বা hero-দের পূজার কথা।
আর দেবতা কথার মানেই হ'চ্ছে----যিনি, যে বা যা'রা মানুষের প্রয়োজনকে পূরণ ক'রে, তাদের পরিপোষণের স্বার্থ হ'য়ে দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞ অর্ঘ্যের অধিকারী হয়েছেন। ওই রকম পূজা, পার্ব্বণ যা'-কিছু হিন্দুদের ----তা ভগবৎ-অনুগ্রহ-সম্পন্নদেরই। ভগবান পূজার একমাত্র চিজই হ'চ্ছে জ্যান্ত পুতুল ওই পয়গম্বর, পীর, ঋষি, আদর্শ বা ইষ্ট। দেবতা মানে যিনি দীপ্তি পান।"
তাই মা দুর্গা পূজার অর্থ দেবতা বা hero-দের পূজা।
এছাড়া শ্রীশ্রীঠাকুর বিসর্জন সম্পর্কে বললেন, "বিসর্জন মানে বিশেষভাবে সৃজন। সেই অর্থে মায়ের বিসর্জন হয় না। হয় মাকে নোতুনরূপে নিজের ঘরে নিজের মায়ের মধ্যে বিশেষভাবে সৃষ্টি, বিশেষভাবে রচনা বা নির্মাণ।
দয়াল পরমপিতা আমার আমাদের বলেছেন, ওঠো, জাগো, চোখের জল মোছো। হতাশা, অবসাদ ঝেড়ে উঠে দাঁড়াও। মাকে বিসর্জন দেবে মানে তাঁকে নিরঞ্জন নয়, তাঁকে জলে নিক্ষেপ নয়। বিসর্জন মানে মাকে বিশেষভাবে সৃজন। অর্থাৎ আবার নোতুনভাবে নিজের জীবনে, নিজের চরিত্রে মাকে, মায়ের গুণাবলী, তাঁর বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করা, রচনা বা নির্মাণ করা। আর তখনই মূর্তি পূজার সার্থকতা। নতুবা সবটাই বৃত্তি- প্রবৃত্তির পূজো। উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খল বকোয়াস।
No comments:
Post a Comment