আপনি বলেছেন, আপনি যখন দেওঘরের মূল কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তখন সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা হ'তো। আপনি সেই সংক্ষিপ্ত প্রার্থনাতে প্রার্থনার পর ফুর্তি পেতেন না। তারপর আপনি বাড়িতে পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনা শুরু করেন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে যে আপনি আপনার এই সংক্ষিপ্ত প্রার্থনাতে ফূর্তি না পাওয়ার কথা আচার্যদেব শ্রীশ্রীবড়দাকে জানিয়েছিলেন? তাঁর সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করেছিলেন? যদি না ক'রে থাকেন কেন করলেন না? করলে হয়তো জানতে পারতেন শ্রীশ্রীবড়দার এই ব্যাপারে মতামতটা যা আজ আমরাও জানতে পারতাম। আর যদি ক'রে থাকেন তাহ'লে তিনি এই বিষয়ে কি বলেছিলেন সেটাও আপনার বক্তৃতাতে জানাতে পারতেন।
শীর্ষেন্দুবাবু আপনি কি মনে করেন সভাসমিতিতে বা প্রকাশ্যে সমবেতভাবে একটা দীর্ঘ সময় ধ'রে শুধু প্রার্থনায় হ'ক? এটা কি সম্ভব? সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা আপনি সমর্থন করেন না। সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা নিয়েই কি আপনার সৎসঙ্গের সঙ্গে বিরোধ? নাকি অন্য আর কোনও কারণ আছে? আপনি দেওঘরের মূল কেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করলেন কেন?
প্রার্থনার সময় নিয়ে বলেছেন আপনি। দেওঘরে প্রার্থনার সময় বেঁধে দেওয়া নিয়ে আপনার আপত্তি আছে? আর প্রার্থনার সময় পার হ'য়ে গেলে প্রার্থনা করা যাবে না এমন নির্দেশ আছে ব'লে আমার মনে হয় না। এই নিয়মকে আপনি স্বাগত নিয়ম নয় ব'লে জানিয়েছেন। তাঁর মানে আপনি বলতে চেয়েছেন দেওঘর মূল কেন্দ্র গোঁড়ামিকে মুখ্য করে চলেছে। কিন্তু বর্তমান আচার্যদেব বলছেন, অন্তত শুক্রবার দিন তাঁর জন্মবারের দিন সকালে সবাই মিলে প্রার্থনা করা যায় কিনা ভেবে দেখতে অনুরোধ করেছেন।। সকালে কেন বললেন? কারণ বিকেলে বা সন্ধ্যেবেলায় সবাই নানাকাজে বাইরে ব্যস্ত থাকে কিন্তু সকালে সবাই কাজে বেরোবার আগে ঘরে থাকে। তাই তখন সমবেত ভাবে সময় হ'লেও হ'তে পারে। এখানে কি তাঁর কথার মধ্যে গোঁড়ামির প্রকাশ পায় নাকি নমনীয়তা প্রকাশ পায়?
শীর্ষেন্দুবাবু তাহ'লে ঠাকুরের প্রার্থনা সম্পর্কিত বাণীটা কি আপনার সময় বেঁধে দেওয়ার বিরুদ্ধে বলা কথার পরিপূরক হ'লো? কার কথাটা নেবো? আপনার কথাটা নাকি ঠাকুরের বাণীটা? ঠাকুর বললেন,
"যেথায় থাকিস্ হ'স্ না বেহুঁস করতে সন্ধ্যা-প্রার্থনা,
হ'বিই তা'তে কর্ম্মনিপুণ শক্তি পাবে বর্দ্ধনা।"
এই 'সন্ধ্যা প্রার্থনা' বলতে ঠাকুর কি বুঝিয়েছেন? কি অর্থ করেছেন? এর অন্তর্নিহিত ব্যাকরণগত অর্থ কি? 'সন্ধ্যা-প্রার্থনার' অন্তর্নিহিত ধাতুগত অর্থের সঙ্গে দেওঘর মূল কেন্দ্রের সকাল-বিকাল প্রার্থনার নির্দিষ্ট সময়ের একটা বিজ্ঞান সম্মত কি যোগযূত্র নেই? প্রার্থনার সময় বেঁধে দেওয়া নিয়ে যে কথাটা বললেন আপনি, দেওঘরের নিয়ম নিয়ে যে কথা বললেন আপনি সে কথাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ব'লে মনে হয় আপনার? ঠাকুরের এই বাণীটার মধ্যে কি একটা অন্তর্নিহিত বিশেষ সময়ে প্রার্থনা করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না?
আর, আশ্রমে সমবেত ভাবে প্রার্থনা করার একটা নির্দিষ্ট নিয়ম থাকা উচিত নয় কি? আশ্রমিক একটা শৃঙ্খলা থাকার দরকার নেই কি? ঠাকুর থাকাকালীন ঠাকুরের সময় সুবিধা মতো প্রার্থনা করা আর ঠাকুরের অবর্তমানে আশ্রমের পরিচালকের সময় সুযোগ মতো যখন ইচ্ছা তখন প্রার্থনা করা কি একই অর্থ বহন করে ও তা সমর্থন যোগ্য? শ্রীশ্রীঠাকুর আর শ্রীশ্রীবড়দার ক্ষেত্রে একই আচরণ প্রযোজ্য? শ্রীশ্রীঠাকুরের সুবিধামতো প্রার্থনা হবে ব'লে শ্রীশ্রীবড়দার সুবিধা মতোও প্রার্থনা হবে? আর, শ্রীশ্রীবড়দাও কি ঠাকুরের মতো নিজেও তাঁর সময় সুবিধা মতো, ইচ্ছেমতো, আরাম মতো প্রার্থনা করতেন বা সেই ঠাকুরের মতো আচরণ করতেন? করতেন না। সেটা কি প্রশংসনীয় নয়?
আর, বাড়িতে বা অন্য কোথাও অন্য কোনও কাজে যুক্ত থাকার কারণে সময়ে প্রার্থনা করতে না পারার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পরে বাড়িতে আপনার সময় সুযোগ মতো শান্ত মনে প্রার্থনা করাতে কি দেওঘর মূল কেন্দ্র কোনও নিষেধের হুলিয়া জারী করেছে? বাড়ি আর আশ্রম বা ঠাকুর মন্দির কি নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে একই গোত্রের মধ্যে পড়ে ও একই কড়া নিয়ম কানুনের মধ্যে পড়ে? বাড়ি আর আশ্রম বা মন্দিরের ক্ষেত্রে কোনও নিয়মের ব্যতিক্রম থাকবে না? তাই ব'লে কি আশ্রমে বা মন্দিরে কোনও একটা নির্দিষ্ট নিয়ম থাকবে না? মুসলমানদের নামাজের নির্দিষ্ট সময় পালনের নিয়মের মধ্যে কি কোনও বিরোধ আছে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন খলিলুর রহমানদাকে ঠাকুর নামাজ পালনের জন্য কি বলেছিলেন?
খলিলুর রহমানদাকে ঠাকুর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তরে খলিলুর রহমানদা বলেছিলেন, সরকারী কাজের এত চাপ যে হিমশিম খেয়ে যেতে হয়। সময়মতো দু'বেলা খাওয়ার সময় পর্যন্ত পান না। চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন। কখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বেন? আর, কাজের জায়গায় কোনও জায়গাও নেই যে নিভৃতে শান্তিতে নামাজের সময়ে নামাজ পড়বেন। এই কথা অতীব সত্য কথা। এই কথার সঙ্গে আপনার কথার মিল আছে। আমিও সমর্থন করি আপনার ও খলিলুর রহমানদার কথার। কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং সময়, বিধি আর তাই তাঁর বিধানও নিখুঁত ও নড়চড়হীন। আপদধর্ম্মের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় হ'লেও বিধান বিধান। তাই তিনি খলিলুরদাকে বললেন, শোনেন খলিলুরদা, আপনি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়েন তাহ'লে আপনি খাঁটি মুসলমান-ই না। তো একবার আপনার অফিসে উর্দ্ধতম কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন ক'রে দেখতে পারেন আপনার নামাজের বিষয়টা। কি বলে তাঁরা দেখুন না। খলিলুর রহমানদা এই কথার উত্তরে বলেছিলেন, ব্যাপারটা সেভাবে কোনওদিন ভেবে দেখিনি। আপনি যখন বলছেন তাহ'লে একবার আবেদন করবো। ঠাকুর বললেন, হ্যাঁ, ক'রে দেখেন। তারপর খলিলুরদা অফিসে তাঁর নামাজ পড়ার বিষয়টা আবেদন ক'রে জানালে অফিসের উর্দ্ধতম কর্তৃপক্ষ সানন্দে সঙ্গে সঙ্গে তা অনুমোদন ক'রে দিয়ে খলিলুর রহমনদার নামাজ পাঠের জন্য একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা ক'রে দিয়েছিলেন। আর এ ঘটনায় খলিলুর রহমানদা অবাক হ'য়ে গিয়েছিলেন তাঁর গুরুদেব শ্রীশ্রীঠাকুরের অভূতপূর্ব লীলায়! তারপর থেকে তিনি নিয়মমতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন সময়মতো শত কাজের মধ্যেও তাঁর গুরুদেবের আদেশ মতো।
ঠাকুরের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পাঠের নিয়ম পালনের ক্ষেত্রে খলিলুর রহমানদাকে বলা নির্দেশের ক্ষেত্রে এবং ঠাকুরের কথানুযায়ী খলিলুরদার এই নিয়ম নিষ্ঠা পালন করার ক্ষেত্রে কি বলবেন আপনি জানতে ইচ্ছে করে।
এছাড়া আপনার বক্তৃতায় সম্পূর্ণ প্রার্থনা না করলে ঠাকুরকে বোঝা যাবে না আপনি বললেন। আমার আপনার কাছে জানতে ইচ্ছে করে তাহ'লে কি শ্রীশ্রীবড়দা ঠাকুরকে বোঝেননি? শ্রীশ্রীদাদা ঠাকুরকে বোঝেননি? বর্তমান আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদা ঠাকুরকে বোঝেননি? কারণ তিনারা সংক্ষিপ্ত প্রার্থনা করতেন ও করেন। শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রীবিবেকদা ও শ্রদ্ধেয় শ্রীশ্রীকাজলদা ও তাঁদের পরিবারবর্গ সহ আপনাদের যারা পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনার পক্ষে তাঁরা ব্যতিত ঠাকুরবাড়ির শ্রীশ্রীবড়দার পরিবারে এবং বর্তমানে প্রায় ১০ কোটি লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া দেশবিদেশের কোটি কোটি ভক্তের কোনও কেউ বোঝেননি ঠাকুরকে!?
আপনি আরও বললেন, সংক্ষিপ্ত প্রার্থনায় সপ্তার্চি ও পঞ্চবর্হি উপেক্ষিত হয়। আপনি আরও বললেন, এই সপ্তার্চি ও পঞ্চবর্হির মধ্যে বীজাকারে আর্য হিন্দু ধর্ম্ম দর্শনের সবটুকু ধরা আছে এবং তা যারা এই পুর্ণাঙ্গ প্রার্থনা করেন তারা তা জানতে পারেন ও অনুভব করতে পারেন। আমার জিজ্ঞাস্য আপনার কাছে এই বীজাকারে ধ'রে রাখা বিষয়টা কি তারা জানতে, বুঝতে পেরেছেন? পেরেছেন অনুভব ও উপলব্ধি করতে? এই যে অবিকৃত প্রচারের নামে যারা দেওঘরের বিকৃত প্রচারের বিরুদ্ধে কোমর কষে নেবে পড়েছেন দল বেঁধে ছোটো ছোটো নানা সংঘ তৈরী ক'রে তাদের বক্তব্যের মধ্যে এই অনুভূতি ও উপলব্ধি কি আপনি দেখতে পান তাদের প্রচারের ধরণ ও ভাষার মধ্যে? নাকি আপনি কোনও খবরই রাখেন না দেওঘর মূল কেন্দ্র 'সৎসঙ্গ' এবং শ্রীশ্রীবড়দা ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারের? আপনার বলিষ্ঠ কলম কি একবার এই আচরণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল? আপনি এই কলমের শক্তি তো শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছেই ফিরে পেয়েছিলেন। ঠাকুর না থাকলে আপনি এই শক্তি যা আজ আপনাকে সাহিত্য জগতে অন্যতম রত্ন হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এনে দিয়েছে তা কি পেতেন নাকি কোন ধ্বংসের মোহনায় হারিয়ে যেতেন তা কি আপনি উপলব্ধি করেন?
আপনি এও বললেন, আবার এ ছাড়া পুরুষোত্তম বন্দনা থেকে শুরু ক'রে আরও বাকী যা যা আছে সেই সবগুলির মধ্যে ঠাকুরের গন্ধ 'ম, ম' করছে। তা যারা পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনা করেন কই তাঁদের সঙ্গে আজ এই ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত সেই ১৯৬৯ সালে ঠাকুরের দেহ রাখার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৫৪ বছর দেওঘর মূল কেন্দ্র বিরোধী যাদের যাদের সঙ্গে মেলামেশা করেছি, কথা বলেছি তাদের কারও গায়ে তো ঠাকুরের 'ম, ম' করা গন্ধের 'গ' টুকুও পেলাম না!? কারও আচরণে ও কথাবার্তায় তো ঠাকুরের গন্ধ পাই না!? শুধু ৫৪বছর ধ'রে তাদের কাছে পেলাম শ্রীশ্রীবড়দা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে------ এমনকি মায়েদেরও ছাড়েননি তারা ------- শুধু তীব্র কদর্য ভাষায় নিন্দা আর সমালোচনা-সমালোচনা-সমালোচনার দূর্গন্ধ যা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের সর্বত্র এবং শ্রীশ্রীবড়দা নাকি বিকৃতভাবে ঠাকুরকে প্রচার করছে তার তকমাও তারা ঝুলিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে নানাভাবে সমাজের সব জায়গায়।
তাই বলি শীর্ষেন্দুবাবু আপনার দয়াল ঠাকুর কি এমন সৎসঙ্গী চেয়েছিলেন এবং পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনা ক'রে তাঁদের অন্তরাত্মা কি উদ্ঘাটিত হয়েছে?
আর ইষ্টভৃতি প্রসঙ্গে বললেন, ইষ্টভৃতি কে কোথায় পাঠালো, কে কোন সংঘ করলো তা বড় কথা নয়। বড় কথা হ'লো যে পুরুষোত্তমের দেওয়া সম্পূর্ণ জিনিসটা অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনা উপেক্ষা না করা। তা ইষ্টভৃতি যেখানে সেখানে পাঠাবে? যে যেখানে পারবে সংগঠন তৈরী করবে আর ইষ্টভৃতি সংগ্রহ করবে? এই উচ্ছৃঙ্খলা বিশৃঙ্খলা বড় কথা নয়!? সেদিকে নজর দেওয়ার দরকার নেই? শুধু পূর্ণাঙ্গ প্রার্থনা করলেই হবে? ব্যক্তিগত শান্তি লাভ হবে? সমষ্টিগত শৃঙ্খলার কোনও দরকার নেই? একটা আদেশ বা নির্দেশ মেনে চলার দরকার নেই? তাহ'লে ঠাকুরের বাণীটা কি ফালতু? মিথ্যে? "এক আদেশে চলে যারা তাদের নিয়ে সমাজ গড়া।"---এই বাণীর কোনও মূল্য নেই? এইরকম ইচ্ছেমতো হাজার আদেশে সমাজ গড়ে উঠবে? ঠাকুর কি এই শিক্ষা আমাদের দিয়ে গেছিলেন? কে দিল এই নির্দেশ? কে দিল এই অধিকার? ঠাকুর কি কোথাও এ ধরনের কোনও কথা বলে গেছেন? যে যার নিজের ইচ্ছেমতো চলার কথা ব'লে গেছেন ও চলার অধিকার দিয়ে গেছেন শ্রীশ্রীঠাকুর? কোনও নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই?
এটাকে কি বলবেন সদাচারী ভক্তি নাকি ব্যাভিচারী ভক্তি। কোনটা?
একজন প্রবীণ সৎসঙ্গী হিসেবে মনে প্রশ্নগুলি এলো তাই বললাম। বিচারের ভার শ্রীশ্রীঠাকুরের। আপনি প্রণাম নেবেন। জয়গুরু।
ইতি,
প্রকাশ বিশ্বাস ( প্রবি )
উত্তরপাড়া, হুগলী।
#প্রবিরচিঠি।
(লেখা ৪ই জুলাসি'২০২৩)
No comments:
Post a Comment