Powered By Blogger

Thursday, November 2, 2023

ছোটো গল্পঃ সম্পর্ক।

আজ আর কিছুতেই ঘুম আসছে না অবিনাশবাবুর। একটা ছটফটানি চোখের কোলে নেবে আসা ঘুমকে বারবার তাড়িয়ে দিচ্ছে। কি একটা মনের মধ্যে ভেসে উঠে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে মনের গভীরে। মনে করতে চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। বিছানা থেকে উঠে ইতস্তত পায়চারী করলো। জল খেলো দু'একবার। মনে পড়েও মনে না পড়া, ছানা কাটা অবস্থা যার হয়েছে সেই বুঝবে। সাপের বিষের জ্বালা কি যে না ছোবল খেয়েছে সে বুঝবে কি? মাঝরাতে বিছানা থেকে উঠে পড়লো অবিনাশবাবু। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো রাত তিনটে বাজে। ধীরে ধীরে এসে প্রবেশ করলেন ঠাকুরঘরে। গুরুর প্রতিকৃতির সামনে বসলেন চোখ বন্ধ ক'রে। আজ্ঞাচক্রে মনোনিবেশ ক'রে বসে রইলেন শান্ত হ'য়ে; চলতে লাগলো ভিতরে গুরুর কাছ থেকে পাওয়া বীজনাম। আর প্রার্থনা জানালো ছানা কাটা অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে।

কখন যে ঠাকুরঘরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তা জানেন না অবিনাশবাবু। ভোররাতে চোখে ঘুম জড়িয়ে ধরেছিল আষ্টেপৃষ্ঠে। গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিলেন অবিনাশবাবু। আর তখনি ছানা কাটা অবস্থা থেকে গুরুর কৃপায় মুক্তি পেয়ে ধীরে ধীরে পরপর দৃশ্যগুলি জোড়া লেগে ভেসে উঠেছিলো ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হ'য়ে।

অবিনাশবাবু বহুদিন পর মাকে দেখতে পেলেন, দেখতে পেলেন বাবাকেও। মা খেতে দিচ্ছে বাবাকে। আর মাথার ওপর ফ্যান চলা সত্বেও হাতের পাখা দিয়ে বাতাস দিচ্ছে বাবাকে। এমনিতে অবিনাশবাবু বাবা-মাকে দেখেনি কোনওদিন ঝগড়া করতে। এই খাওয়ার সময়ে যে কি হয় বুঝে উঠতে পারতো না অবিনাশবাবু। তখন আর কতই বা বয়স। স্বামীস্ত্রীর সম্পর্কের গভীরতা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার মতো বোধবুদ্ধিও হয়নি। চোখের সামনে পরিস্কার দেখতে পেল বাবার রাগান্বিত মুখ। হঠাৎ বাবাকে মায়ের ওপর রেগে উঠতে দেখে মাথাটা সেদিন গরম হ'য়ে গেছিল অবিনাশবাবুর। আর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের হ'য়ে ওকালতি করার খেসারত দিতে হ'য়েছিল সেদিন অবিনাশবাবুকে আর তা দিতে হ'য়েছিল মায়ের কাছেই।
ঝগড়ার দৃশ্যটা দিনের আলোর মতো পরিস্কার দেখতে পেল অবিনাশবাবু। মা বাবাকে খেতে দিচ্ছে। খাবার দেওয়ার সময় বারবার বেশী বেশী ক'রে দেওয়ার জন্য বাবা মাকে বলছিল, আর ন খায়ম। আর ন খায়ম। আর ন দিও। বাবা-মা নিজেদের মধ্যে যখন কথা বলতো তখন নিজেদের চট্টগ্রাম ভাষায় কথা বলতো। অবিনাশের জন্ম এই বাংলায়। তাই সে বলতে পারে না, বললেও ভাঙা ভাঙা একটু আধটু। তবে বুঝতে পারে। সেই কবে দেশ ত্যাগ ক'রে স্বাধীনতার সময়ে চলে এসেছিল এই বাংলায় বাবা-মা; তারপর তিরিশ বছরের ওপর হ'য়ে গেছে সেই মাতৃভাষা ভোলেনি তাঁরা। সেই খাওয়ার দেওয়ার সময় বাবার বারবার বারণ সত্বেও বেশী ক'রে খাবার দেওয়ার জন্য বাবা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো, ন খায়ম, ন খায়ম কইজ্জে না? কথা ন হুনো? আর তখনি অবিনাশবাবু বাবার ওপর চেঁচিয়ে উঠেছিল। বুঝতে পারেনি সেদিন মা-বাবার এই ঝগড়ার রসায়ন। ফলে সেদিন দেখেছিল মায়ের রুদ্রমূর্তি! আর আজ আবার সেই দৃশ্য দেখতে পেয়ে ধড়ফড় ক'রে উঠে বসেছিল ঘুম থেকে অবিনাশবাবু।

আর তখনি দেখলো সে শুয়ে আছে ঠাকুরঘরে। তারপর ধীরেধীরে মনে পড়ে গেল গতরাতের খেতে বসার ঘটনাটা। খেতে বসেছিল একসঙ্গে ছেলে আর বউয়ের সাথে। খেতে খেতে একটা কথা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছিল ছেলের সঙ্গে ছেলে কথার অন্তর্নিহিত অর্থ ধরতে না পারার জন্য। আর ছেলের পক্ষ নিয়েছিল বউ ফলে-----------। আর মনে করতে চাইলো না অবিনাশবাবু। চোখের কোণটা মুছে নিয়ে ঠাকুরের দিকে চেয়ে কি যেন ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে বিছানায় ফিরে গেল ধীরপায়ে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে।
( লেখা ৩রা নভেম্বর'২০২২)

No comments:

Post a Comment