কাগজ থেকে মুখটা তুলে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালো অবিনাশবাবু। দেখতে পেলো দশবারোজন ইয়ং ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লাঠি আর লাঠির মাথায় বাঁধা এক্টুকরো ছোটো ছোটো কাপড়; যেটাকে ওরা বলে ফ্ল্যাগ। দলের নিশান।
ওই ভিড়ের মাঝে একজনের দিকে চোখ আটকে গেল অবিনাশবাবুর। লম্বা। ব্যায়াম করা পেটানো চেহারা। মুখে চাপ দাড়ি আর মাথায় লম্বা চুল যা ঘাড় পর্যন্ত নেবে এসেছে। আর টিপটপ পোশাক। এক্কেবারে হ্যান্ডসাম চেহারা। অবিনাশবাবু দেখলো ছেলেটি তাঁর দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। তারপরেই শুনতে পেলেন ছেলেটি বলছে, অবিনাশদা আমায় চিনতে পারছেন না?
একটু অপ্রস্তুত হ'য়ে অবিনাশবাবু ব'লে উঠলেন, না, মানে----। কথা শেষ করার আগেই ছেলেটি টুক ক'রে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ক'রে বললো, আমি ঋতম। সেই যে জি টি রোডের সামনে সখেরবাজারের আগে চার রাস্তার মোড়ে............ কথা শেষ করতে দিলেন না অবিনাশবাবু আর। তার আগেই তাকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, থাক থাক বাবা, আর বলতে হবে না। আমার মনে পড়েছে। তুমি ঋতম না!? তোমায় কি ভোলা যায়!? তুমি কি ভোলার মতো মানুষ!? ব'লে একেবারে বুকে ঝাপটে জড়িয়ে ধ'রে রইলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ ক'রে বললেন, তা এখানে?
ঋতম ব'লে উঠলো, আজ আমাদের শ্রমিক সংগঠনের একটা মিটিং আছে। তাই এসেছি সকাল সকাল সব কাজ গুছিয়ে রাখতে।
ক'টায় মিটিং? জিজ্ঞেস করলেন অবিনাশবাবু।
দুপুর ২টো।
ও ব'লে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অবিনাশবাবু।
ঋতম ব'লে উঠলো, তা আপনি এখানে রোজ আসেন নাকি?
না, তেমন একটা আসা হয় না। মাঝে মাঝে আসি। বাচ্চাদের পার্ক; তাদের হৈ হুল্লোড় দেখতে বড় ভালো লাগে। তাই সময় পেলে আসি। তা তোমরা বাচ্চাদের পার্কে মিটিং করছো কেন? বাচ্চারা এখানে খেলতে আসে, মায়েরা সারাদিনের খাটাখাটনির পর একটু বাচ্চাদের নিয়ে একটু রিলাক্স ক'রে যায়। আর বয়স্করা আসে অক্সিজেন নিতে। এটাকেও তোমারা দূষিত ক'রে দিচ্ছ?
কথাগুলি বলেই অবিনাশবাবু বুঝতে পারলেন আলটপকা একটা অপ্রিয় সত্য কথা ব'লে ফেলেছেন। এতদিনপর ছেলেটার সঙ্গে দেখা হ'লো কোথায় তার সঙ্গে একটু হাসি মজাক করবে, কুশল টুশল জিজ্ঞেস করবে তা না একটা বিতর্কের আবহাওয়া তৈরী ক'রে দিলেন মুহূর্তে। এই স্বভাবটা আর পাল্টাতে পারলেন না অবিনাশবাবু। ছেলেটির দিকে চেয়ে দেখলেন ছেলেটি মাথা নীচু ক'রে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে হাত বাড়িয়ে লজ্জায় অবিনাশবাবু আমতা আমতা ক'রে বললেন, কিছু মনে ক'রো না ঋতম। কথাগুলি বেরিয়ে গেল। বাধ মানলো না। তুমি আমাকে------
কথা শেষ করার আগেই গুমোট পরিস্থিতিকে এক ঝটকায় স্বাভাবিক ক'রে দিয়ে ঋতম সাথীদের দিকে তাকিয়ে ব'লে উঠলো, এই শোন তোরা, ইনি অবিনাশদা। যদিও ইনি আমার রাজনৈতিক গুরু নন তবুও আমার জীবনের অনেকটা জায়গা জুড়ে তিনি। সবাই প্রণাম কর।
অবিনাশবাবু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলেন ছেলেটার কথাবার্তা ও শরীরী ভাষার মধ্যে একটা সহজ স্বাভাবিক কমান্ডিং ফ্যাক্টর আছে। সবাই নির্দ্বিধায় তার কথা মেনে নিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে এগিয়ে আসতেই অবিনাশবাবু হাসি মুখে সবাইকে দু'হাত দিয়ে বাঁধা দেওয়ার ভঙ্গিতে ব'লে উঠলেন, আরে না না প্রণাম করতে হবে না। আমি আশীর্বাদ করি তোমরা সবাই ভালো থাকো, আনন্দে থাকো।
ঋতম অবিনাশবাবুকে থামিয়ে দিয়ে ব'লে উঠলো, আরে অবিনাশদা, এমনিতেই তো আজকাল ছেলেছোকরাদের মনে ভক্তি শ্রদ্ধার লেশ মাত্র নেই। তার ওপর আপনারা যদি এই অভ্যাসটা বজায় থাকার জন্য প্রণাম করতে না দেন তাহ'লে তো আর কোনোদিন কেউ প্রণামই করবে না।
অবিনাশবাবু হেসে বললেন, না, ঋতম। ব্যাপারটা তা নয়। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে আয়ু ক্ষয় হয়।
মানে!? একটু চমকে গিয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু গলায় ব'লে উঠলো ঋতম। তারপর অবাক অথচ সামান্য ঝাঁঝালো স্বরে ব'লে উঠলো, আপনি কি সব প্রচলিত প্রথার বিরোধী!?
অবিনাশবাবু নিজেকে সামলে নিলেন। এখন এ প্রশ্নের উত্তর দিলে ব্যাপারটা অন্যদিকে ঘুরে যাবে। তার উপর স্থান, কাল, পাত্র ব'লে একটা কথা আছে। যদিও স্থান আর পাত্র মোটামুটি ফেভারে থাকলেও সময়টা একেবারে আলোচনার অনুপযুক্ত। তাই আর কথা না বাড়িয়ে তিনি ঋতমকে উদ্দেশ্য ক'রে বললেন, তোমরা এখন যে কাজে এসেছো সে কাজে মনোনিবেশ করো নতুবা সময় পেরিয়ে যাবে। দুপুরে তোমাদের মিটিং; বরং পরে একদিন না হয় আলোচনা করা যাবে এই বিষয়ে। এখন আমি চলি। তোমরা তোমাদের কাজে মন দাও।
এইকথা ব'লে অবিনাশবাবু যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ঋতমের দিকে তাকিয়ে হাসলেন পরে সবাইকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
অবিনাশদার চলার পথের দিকে নির্নিমেষ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ঋতম। তারপর হঠাৎ ধরা গলায় ডেকে উঠলেন, অবিনাশদা।
ঋতমের ডাক শুনে অবিনাশদা দাঁড়ালেন এবং পিছন ফিরে দেখলেন।
ঋতম কিছু না ব'লে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আবার প্রণাম করতে গিয়েও থমকে গিয়ে পিছিয়ে এলো। তারপর বললো, আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার ওইভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। আপনি আমাকে ক্ষমা ক'রে দেবেন।
অবিনাশবাবু তাকে ছেলের মতো বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, না,না, আমি কিচ্ছু মনে করিনি। তবে প্রণাম করলে না যে?
ঋতম শান্ত গলায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল। সেদিনও প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিনও কথা অসম্পূর্ণ ছিল, আজও কথা শেষ না ক'রে আপনি চলে যাচ্ছেন। আজও কথা অসম্পূর্ণ র'য়ে গেল।
অবিনাশবাবু ঋতমের মধ্যে একটা জানার ক্ষিধে লক্ষ্য করলো। ভালো লাগলো তাঁর। আজকের প্রজন্মের মধ্যে কারও জানার ক্ষিধে নেই। ধর তক্তা মার পেরেক স্বভাব। তার উপর রাজনীতির ময়দান শয়তানের আখড়া। মাঝে মাঝে একটা দু'টো ভগবান হয়তো পথ ভুল ক'রে আখড়ায় ঢুকে পড়ে। ঋতমদের মতো ছেলেদের জন্য রাজনীতি নয়। এরা হয় শেষ দেখে ছাড়ে নতুবা স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যায় রাজনীতির দমবন্ধ করা আখড়া থেকে।
অবিনাশবাবু ঋতমের কথার উত্তরে বললেন, এমনিভাবেই আবার কোনও একদিন কোথাও দেখা হ'য়ে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে ঋতম ব'লে উঠলো, আবার একটা নোতুন বিষয় উত্থাপন হবে, আবার অসম্পূর্ণতা।
হেসে দিলেন ঋতমের এইকথায় অবিনাশবাবু। বললেন, তাহ'লে উপায়টা তুমিই বলো।
ঋতম বললো, আপনি কোথায় থাকেন?
এই-ই সামনে। সামনে এগিয়ে যে বড় খেলার মাঠটা আছে সেখানে রাস্তার পাশে একটা জলের ট্যাঙ্ক আছে। তার পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলেই একটা ছোট্ট বাচ্চাদের পার্ক আছে। সেই পার্কের শেষ মাথায় যে বাড়ীটা সেটা আমার বাড়ি।
যদি আপত্তি না থাকে আপনার ফোন নাম্বারটা দেবেন? তাহ'লে যখন আসবো ফোন ক'রে আসবো।
অবিনাশবাবু ফোন নাম্বারটা ঋতমকে বলল। ঋতম তা ফোনে তুলে নিয়ে একটা মিস কল দিলে অবিনাশবাবু ফোন বের ক'রে ঋতমের নাম্বারটা সেভ ক'রে নিলেন। তারপর বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলেন পার্কের গেটের দিকে। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ঋতম। মনে মনে ভাবলো, কেন লোকটার ওপর এমন একটা টান অনুভব করে? কিসের সম্পর্ক?
তারপরে ফিরে যায় নিজের দলের ছেলেদের কাছে কাজে হাত দেবে ব'লে।
(লেখা ৪ই নভেম্বর'২০২২)
No comments:
Post a Comment