একটা খট শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল তারাপদবাবুর। ইদানীং রাতে আর ডিপ ঘুম আসে না তাঁর। এমনিতেই এপাশওপাশ করতে করতেই কেটে যায় সারা রাত। বালিশে মাথা ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই হাজারো চিন্তা ভিড় ক'রে আসে মনে। তিতিবিরক্ত তারাপদবাবু বিছানা থেকে উঠে ঠাকুরঘরে গিয়ে তাঁর দয়াল ঠাকুরের কাছে নালিশ জানিয়ে আসে চিন্তাদের বিরুদ্ধে। তারপর এসে ঘরের আলো নিভিয়ে নীল আলো জ্বালিয়ে চারপাশে স্বপ্নের পরিবেশে আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়।
আজও বিছানায় শোওয়ার পর হাজার চিন্তা তাদের পাখনা মেলে উড়ে এসে বসে তারাপদবাবুর মাথার চারপাশে আর তারপর অক্টোপাশের মতো পেঁচিয়ে ধরে মাথার স্নায়ুগুলিকে। যন্ত্রনায় কাতর তারাপদবাবু পাশের পাশবালিশটাকে দু'হাতে জাপটে ধ'রে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে। তারপর তাঁর গুরুর কাছ থেকে পাওয়া বীজনাম জপে ডুবে যায়। পাশবালিশটাকে তীব্রভাবে দু'হাতে জড়িয়ে ধ'রে বুকে ধরার মধ্যে তাঁর গভীর ভালোবাসাময় এক বিশ্বাস কাজ করে। তাঁর মনে হয় দয়ালের চরণ বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধ'রে সে শুয়ে আছে। তাঁর পাপবিদ্ধ বুকে দয়ালের চরণ স্পর্শ সে টের পায়! কে যেন তাঁর বুকে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছে, হাঁটছে! আর বুকের মধ্যে জমাট বাঁধা ভার হালকা হ'য়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ! স্পষ্ট টের পায় তারাপদবাবু।এটা অন্যদের কাছে পাগলাটে ভাব ব'লে বোধ হয় কিন্তু তারাপদবাবুর নির্ঘুম চোখে কিছুক্ষণের মধ্যে নেবে আসে নেশাচ্ছন্ন এক ঘুমের রেশ আর এক অনাবিল প্রশান্তি। তারপর গভীর ঘুমে ডুবে যায় ক্লান্ত বিধ্বস্ত তারপদবাবু।
কিন্তু ভোরের দিকে খট শব্দে ঘুমটা ভেঙ্গে যায় তারাপদবাবুর। ঘুমচোখে চেয়ে দেখে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্ত্রী। গায়ে আলতো হাত বুলিয়ে স্ত্রী তাঁকে ডাকছে। বিস্ময়ে বিছানায় উঠে বসে তারাপদবাবু। চেয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। কি যেন ইশারায় স্ত্রী তাঁকে বোঝাতে চাইছে। কিছুই বুঝতে পারলো না তারাপদবাবু। স্ত্রী জানালা খুলে পাশের বাড়ির দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখতে বলায় তারাপদবাবু সেদিকে চেয়ে দেখলো, পাশের বাড়িতে ঘরে লাইট জ্বলছে, বাইরে দু'একজন দাঁড়িয়ে আছে আর ভেসে আসছে বুকভাঙ্গা কান্নার আওয়াজ। তারাপদবাবু হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে এসব দেখে বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল ক'রে চেয়ে রইলো স্ত্রীর মুখের দিকে। স্ত্রী ফিসফিস ক'রে বললো, মনে হচ্ছে তাপসবাবুর কিছু হয়েছে। কথাটা শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে পুনরায় তারাপদবাবু জানালা দিয়ে চেয়ে রইলো আর কান পেতে শোনার চেষ্টা করলো কিছু একটা। এবার তারাপদবাবু স্পষ্ট শুনতে পেলেন কান্নার শব্দ। একটা বুকফাটা তীব্র করুণ কান্নার শব্দ তারাপদবাবুকে এলোমেলো ক'রে দিলো। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন কান্নার আওয়াজটা তাপসবাবুর স্ত্রীর। তবে কি তাপসবাবু আর নেই!?
এমনি ভাবতে ভাবতেই ভোরের আবছা আলো কেটে ঝলমলে সকাল হ'য়ে গেল কিন্তু পাশের তাপসবাবুর বাড়ি সেই ঝলমলে আলো থেকে হ'য়ে রইলো বঞ্চিত। আস্তে আস্তে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবদের ভিড় বাড়তে লাগলো। তারই মধ্যে একফাঁকে তারাপদবাবু গিয়ে ঘুরে এলেন ঐ বাড়ি থেকে, দেখে এলেন, শেষ দেখা দেখে এলেন প্রতিবেশী তাপসবাবুকে। প্রায় একই বয়সী দু'জনে। দু'জনেই ষাটোর্দ্ধ। তবে এত তাড়াতাড়ি চ'লে যাওয়াটা তারাপদবাবু মেনে নিতে পারেন না মন থেকে। এখন মানুষের আয়ু অনেক বেড়ে গেছে। এখন আশি নব্বই বছর বাঁচাটা কোনও ব্যাপার না। একটু খাওয়া দাওয়ায় কন্ট্রোল, পরিমিতি বোধ, শারীরিক মানসিক যত্ন সদাচার, একটু পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক আনন্দময় পরিবেশ হ'লেই মানুষ দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারে। তার সঙ্গে তো আছেই উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা। মনে পড়ে গেল এমন কথা অনেকবার বলেছেন তারাপদবাবু তাপসবাবুর বাড়িতে আড্ডায় বসেও।
এইমুহুর্তে তাপসবাবুর স্ত্রীর করুণ কান্না শুনে মনে পড়ে গেল অনেক কথা তারাপদবাবুর। এইতো সেদিনও তুমুল ঝগড়ার আওয়াজ ভেসে এসেছিল তাপসবাবুর বাড়ি থেকে। প্রায় সময়ই কারণে অকারণে তাপসবাবুর স্ত্রীর কর্কষ গলার আওয়াজ ভেসে আসতো ঘর থেকে। সেই সময় তাপসবাবুকে বড় বিমর্ষ ও লজ্জিত লাগতো দেখলে। আবার মাঝে মাঝে দু'জনকেই দেখতো হাসতে হাসতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘুরতে যেতে।
তাপসবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘরে এসে বসলেন তারাপদবাবু। দেখে মনেই হচ্ছে মনে একটা জোর ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। তারপর ফ্রেস হ'য়ে ঠাকুর প্রণাম ক'রে ঘরে এসে বিছানার উপরে বসলেন। এখনও অনেক দেরী আছে তাপসবাবুকে শ্মশানে নিয়ে যাবার। অনেক কাজ বাকী। বসে বসে ভাবছিলেন পুরোনো দিনের অনেক কথা তিনি। তাপসবাবুর সঙ্গে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথা, সামনের পার্কে একটু একসঙ্গে হাঁটা, বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় উপভোগ করা, গলির মধ্যে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নির্লজ্জ প্রেম দেখা ও তা নিয়ে দু'এক কথা বলা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা পুরোনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। আর ঠিক এরই মাঝে সকালের জলখাবার নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো স্ত্রী। খাবার সামনের টেবিলের উপর রেখে একটা হোমিওপ্যাথির শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা ওষুধ গ্লাসে নিয়ে তাতে জল মিশিয়ে এগিয়ে দিয়ে একটু গম্ভীর গলায় বললো, এটা আগে খেয়ে নাও। তারপর টিফিন করবে। তারাপদবাবুও কোনও কথা না ব'লে চুপচাপ ওষুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ওষুধ খেয়ে নিল। তারপর স্ত্রী চলে গেল প্রতিদিনের রান্নাঘরের কাজে। তারাপদবাবু জানেন, এটা অর্জুন, হার্টের বল বৃদ্ধির ওষুধ। একটা ম্লান হাসি মিলিয়ে গেল তারাপদবাবুর ঠোঁটে।
তারাপদবাবু ঘরে একা; সামনে সকালের নাস্তা। আজ আর খেতে মন চাইছে না তারাপদবাবুর। মনটা বিষন্ন ভুতের মতো ঝিমিয়ে গেছে। বসে বসে ভাবতে লাগলো, তাপসবাবু কি আরো কিছুদিন বাঁচতো না? বাঁচানো যেত না? মনে পড়লো তারাপদবাবুর, একদিন রবিবার সকালে তাপসবাবুর বাড়িতে কি একটা কাজে গিয়েছিল। তাপসবাবুর স্ত্রী যত্ন ক'রে বসিয়ে তারাপদবাবু এবং তাপসবাবু দু'জনকেই চা-জলখাবার দিয়েছিলেন। তারাপদবাবু সেদিন গল্প করতে করতে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, বৌদি দাদাকে একটূ চায়ের সঙ্গে চিনি কম দেবেন আর বেশী ক'রে বড় চামচের কয়েক চামচ মিশিয়ে দেবেন ভালোবাসা। দেখবেন এর থেকে হার্টের বলবান টনিক আর কিছুই নেই। এই ওষুধের কাছে পৃথিবীর সব ওষুধ, সব চিকিৎসা ফেল। ব'লেই হো হো ক'রে হেসে উঠেছিলেন তারাপদবাবু। তাপসবাবুর বৌ তা শুনে বলেছিলেন, যত্তসব, বুড়ো বয়সের ভীমরতি। তারাপদবাবুও ছাড়ার পাত্র নন। তিনিও মাথা নেড়ে ব'লে উঠলেন, না না না না। একদম ইয়ার্কি ফাজলামি করছি না। তারপর বেশ দৃড়তার সঙ্গে বললেন, আমার দয়াল ঠাকুর কি বলেন জানেন? দয়াল বলেন, ভালোবাসা হ'লো স্বর্ণসিন্দুরের মতন। স্বর্ণসিন্দুর যেমন একটু খাঁটি মুধুর সঙ্গে ঘষে নিয়ে খেলে গায়ে বল আসে ঠিক তেমনি ভালোবাসাও হ'লো তাই। একটু আন্তরিক নিখাদ ভালোবাসার পরশ পেলে মানুষ বাঁচার রসদ পায়, মনে জোর পায়, বল পায়। উৎসাহ জাগে নতুনভাবে কিছু করার। স্ত্রীর ভালোবাসা স্বামীর শরীরে তেমনি শক্তি ফিরিয়ে আনে পাহাড় ভেঙ্গে নিয়ে আসার। স্ত্রীই পারে স্বামীকে দীর্ঘায়ু করতে। মায়ের নিখাদ আন্তরিক ভালোবাসা যেমন সন্তানকে সবকিছু থেকে আগলে রেখে বাঁচতে বাড়তে সাহায্য করে ঠিক তেমনি স্ত্রীর ভালোবাসাও তাই। এই শক্তি ঈশ্বর একমাত্র নারীর মধ্যেই দিয়েছে। একটু মিষ্টি ক'রে কথা, একটু মিষ্টি হাসি, একটু মিষ্টি চাউনি পুরুষের শরীরের মনের সমস্ত ব্যথা মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন ক'রে তুফান এনে দিতে পারে বুকে। তাই আমার দয়াল বললেন, চাউনি তোমার মিষ্টি করো, মিষ্টি করো কথা, চলন তোমার মিষ্টি ক'রে ঘুচাও সবার ব্যথা। এই ব্যথা ইচ্ছে করলেই এক লহমায় মুচ্ছে দিতে পারে, এমনি শক্তিমতি নারী।
একনাগাড়ে এইকথাগুলি ব'লে থেমেছিল তারাপদবাবু সেদিন। আর আজ তা মনে পড়ে গেল। মনে মনে ভাবলো, ইচ্ছে করলেই স্বামীস্ত্রী দীর্ঘায়ু হ'তে পারে, সুখী হ'তে পারে সংসার। কিন্তু কথাগুলি কথায় থেকে গেল।
কথাগুলি ভাবতে ভাবতে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তারাপদবাবুর চোখ দিয়ে খাবারের ওপর।-----প্রবি। (লেখা ৪ই নভেম্বর'২০২২)
No comments:
Post a Comment