Powered By Blogger

Saturday, November 4, 2023

বড় গল্পঃ ধর্মঘট ২

দুপুরবেলা খেয়ে এসে নিজের ঘরে একটু শুয়েছিল অবিনাশবাবু। স্ত্রী এখনও রান্নাঘরে ব্যস্ত। সম্ভবত রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবিনাশবাবু জানেন যে একটু পরিশ্রম হ'লেও কাজটা এগিয়ে রাখছে স্ত্রী যাতে রাতে একটু হালকা থাকে। কেই বা দু'বেলা আর রান্না ঘরে যেতে চায়। পাশের ঘরে ছেলে আর বৌমা অফিসের কাজে ব্যস্ত। ওয়ার্ক ফ্রম হোম। করোনার সময় থেকে এখনও পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বহাল আছে। যদিও অফিসের থেকে ঘরে কাজের সময় অনেক বেশী এবং ব্যস্তও থাকতে হয় সারাক্ষণ দু'জনকেই। ঘরে থাকে তবুও গল্প করার সময় পায় না। তবুও চোখের সামনে দু'জনেই থাকার জন্য অবিনাশবাবু মনে মনে খুব তৃপ্তি অনুভব করেন। তবুও তো ঘরে থাকে। ঘরটা সবসময় ভর্তি ভর্তি মনে হয়। এতেই শান্তি, এতেই আনন্দ।
বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে সকালের কথা ভাবতে ভাবতে ভাতঘুমে ডুবে গেছিলেন অবিনাশবাবু। আর তখনি চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল ঋতমের সঙ্গে প্রথম দেখা দৃশ্যটা।

একটা গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন অবিনাশবাবু রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় সামান্য ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার ফলে ধাক্কা গিয়ে লাগে এক যুবকের সঙ্গে। এরকম হঠাৎ ধাক্কায় হতচকিত হ'য়ে যায় যুবকটি। বিরক্ত বোধ করে। অবিনাশবাবু হঠাৎ ঘটে যাওয়া এমন একটা শারীরিক পরিস্থিতির কারণে লজ্জা পেয়ে যান। যুবকটির কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে নেন অবিনাশবাবু। কিন্তু যুবকটি এরকম একটা আচমকা ধাক্কা খাবার জন্য একেবারে প্রস্তুত না থাকায় খুব একটা রাগ প্রকাশ না করলেও বিরক্তি চেপে রাখতে না পেরে একটু গম্ভীর গলায় বললো, শরীর খারাপ নিয়ে রাস্তায় বেরোন কেন? এই যদি কোনও একটা গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগতো, তখন? বাড়ির লোকও যে কেন শরীর খারাপ অবস্থায় রাস্তায় একলা ছাড়ে!? বলেই বাড়ির লোকের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় ক'রে কি যেন বললো। তারপর অবিনাশবাবুকে মোটা গলায় বললো, কি শরীর ঠিক আছে? শরীর ভালো লাগছে? একা যেতে পারবেন তো বাড়ি? নাকি------
অবিনাশবাবু একটু ধাতস্থ হ'য়ে নিয়ে বললো, না, কিচ্ছু করতে হবে না। আমি বাড়ি যেতে পারবো। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনি নিশ্চিন্তে আপনার কাজে যেতে পারেন। আমি এখন ঠিক আছি।
যুবকটি অবিনাশবাবুকে বিদায় জানিয়ে যেই ঘুরে রাস্তা পার হ'তে যাবে ঠিক তখনি ঘটলো ঘটনাটা। একটা উল্কাগতিতে ছুটে আসা বাইক পিছন থেকে এসে রাস্তা পার হ'তে যাওয়া যুবকটিকে প্রায় ধাক্কা মারার মুহুর্তে অবিনাশবাবুর বলিষ্ঠ হাতের পাঞ্জা যুবকটির কব্জিতে চেপে ব'সে তাকে এক হ্যাঁচকায় টেনে এনে নিজের বুকের ওপর এনে ফেললো। একসঙ্গে অনেক মানুষ হৈ হৈ ক'রে উঠলো। কেউ কেউ বাইক আরোহীর উদ্দেশ্যে কাঁচা গালাগালি দিয়ে উঠলো। লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই দমকা হাওয়ার বেগে বাইক ততোক্ষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে অবিনাশবাবু এবং যুবকটি দু'জনেই তখন নীরব। পরপর দু'টো ঘটনা দু'জন মানুষকেই হতবাক ক'রে দিয়েছে। কথা বলার অবস্থার মধ্যে নেই কেউ। অবিনাশবাবু বয়সে অনেক বড়, যুবকটির পিতার সমান। তিনি বুঝতে পারলেন এই মুহূর্তে স্থান ত্যাগ না করলে ক্রমশ ভিড় বাড়বে আর অনেককে অনেকের কৌতুহলের জবাব দিতে হবে। তাই তিনি সামনে একটা রিক্সা ডেকে নিয়ে তাতে উঠে পড়লেন আর যুবকটিকে ইশারা করলেন উঠে পড়তে। যুবকটি ঘটনার আকস্মিকতায় এবং অবিনাশবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞতায় প্রভাবিত হ'য়ে বাকরূদ্ধ হ'য়েছিল। তাই কোনও কথা না ব'লে সে রিক্সায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে পড়লো। তারপর রিক্সা চলতে লাগলে যুবকটি তার হাতের কব্জিতে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবতে লাগলো অজানা অচেনা লোকটির বজ্রমুষ্ঠির কথা। হাতে এতো জোর!? এই প্রশ্নটা ঘুরে ফিরে তার মাথার মধ্যে খেলতে লাগলো আর কব্জিতে হাত বুলাতে লাগলো। তাই দেখে অবিনাশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, হাতে লাগেনি তো? যুবকটি বললো, না। এমনিতে যুবকটিও ব্যায়াম করা পেটানো চেহারার অধিকারী। তাই লাগেনি। কিন্তু কোনও বয়স্ক মানুষের কব্জিতে এতো জোর থাকতে পারে সেটা সম্ভবত তার অজানা ছিল। তাই সে বারবার তার কব্জির ওপর পড়া জোরটার ওজন সে অনুভব করছিল।
একটু দূরে রাস্তাটা বাঁক নেওয়ার মুখেই রিক্সা থামাতে ব'লে নেবে এলেন অবিনাশবাবু, সঙ্গে যুবকটিকে নাবতে ব'লে রিক্সাওয়ালার হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে দিলেন। যুবকটি বুঝে উঠতে পারলো না এটুকু রাস্তা রিক্সা ক'রে আসার কি অর্থ থাকতে পারে! এবং তা সে সরাসরি জিজ্ঞেস ক'রেও ফেললো অবিনাশবাবুকে। অবিনাশবাবু মৃদু হেসে বললেন, কৌতূহলী মানুষের অহেতুক কৌতুহল ও কথার স্রোতের হাত থেকে বাঁচতে তাড়াতাড়ি সরে পড়া।

এ কথা শুনে যুবকটি অবাক হ'য়ে গেল অচেনা মানুষটির অদ্ভুত বাস্তব মানসিক তৎপরতা দেখে! এবার যুবকটি অবিনাশবাবুকে তার খারাপ ব্যবহারের জন্য ও আজ নিশ্চিত দূর্ঘটনার হাত থেকে তাকে বাঁচাবার জন্য যুগপৎ ক্ষমা প্রার্থনা করলো ও ধন্যবাদ জানালো। তারপর অবিনাশবাবুর হাতে হাত মিলিয়ে শক্ত হাতে হাত ধ'রে এই বয়সেও হাতের জোরের প্রশংসা করলো। তারপর তারা হাঁটতে হাঁটতে চায়ের দোকানে গেল এবং সেখানে বসে একসঙ্গে চা পান করলো। গল্প করলো দু'জনে অনেকক্ষণ। দু'জনেই ভুলে গেল দু'জনের কাজের কথা। পথচলতি দু'জনের মধ্যে গড়ে উঠলো অন্তরঙ্গতা। দু'জনে জানতে পারলো দু'জনের নাম। একসময় কথা অসমাপ্ত রেখে উঠে পড়লো অবিনাশবাবু। সেদিনও অবিনাশবাবু টের পেয়েছিলেন ছেলেটির সঙ্গে কথা ব'লে আনন্দ আছে। অল্প সময়ের মধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন ছেলেটির জানার ইচ্ছা প্রবল। তারপর দু'জনে দু'জনকে বিদায় জানিয়ে নিজের নিজের গন্তব্যে চলে গিয়েছিল। কিন্তু খেয়াল ছিল না পরবর্তী যোগাযোগের সেতু রচনার। আজ অনেকদিনপর সেই কাজ সম্পন্ন হ'লো।

কথাটা মনে হ'তেই ঘুমটা ভেঙে গেল অবিনাশবাবুর। দেওয়ালের ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেল সময় হয়েছে সান্ধ্য প্রার্থনার। ক'দিন ধ'রে বুকে ঠান্ডা লেগে কফ জমেছে অবিনাশবাবুর। উঠে চোখেমুখে একটু জল দিয়ে নিল। ঠাকুরঘর থেকে স্ত্রীর শঙ্খের আওয়াজ ভেসে এলো। ধীরে ধীরে ঠাকুরঘরে গিয়ে ঢুকলেন তিনি তারপর বসে রইলেন চোখ বন্ধ ক'রে স্থির হ'য়ে। প্রার্থনা চলতে লাগলো। "বার বার করু বিনতি রাধাস্বামী আগে, দয়া করো দাতা মেরে চিত চরণন লাগে-----------"।
(;লেখা ৪ই নভেম্বর'২০২২)

No comments:

Post a Comment