Powered By Blogger

Thursday, November 16, 2023

গল্পঃ গ্রিন সিগন্যাল ( সত্য ঘটনা অবলম্বনে )।

আজ একটা অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী হ'য়ে রইলাম।

জানি না এই ঘটনাকে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবো। সত্যি সত্যিই কি এই ঘটনার পিছনে কোনও অলৌকিকতা লুকিয়ে আছে নাকি সবটাই স্বাভাবিক এক ঘটনা? আমরা যারা ঈশ্বর পূজারী, ঈশ্বরে বিশ্বাসী তারা এই ঘটনার পিছনে ঈশ্বরের অপার করুণা ব'লে মনে করি, অলৌকিক ঘটনা ব'লে ভাবি আর যারা আমরা সাধারণ-অসাধারণ ঈশ্বর অবিশ্বাসী নাস্তিকের পূজারী তারা একে এক স্বাভাবিক ঘটনা বা প্রশাসনিক অব্যবস্থা বা যান্ত্রিক ত্রুটি কিম্বা কাকতালীয় ঘটনা ব'লে বর্ণনা করি।

যাই হ'ক, যে যে রকমভাবে ভাবুক, যে যে দৃষ্টিকোণ দিয়ে ঘটনাকে বিচার ক'রে করুক সেটা তার তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ওপর দাঁড়িয়ে তা করে। আমি শুধু ভাবি সেই শেক্সপিয়ারের 'হ্যামলেট' নাটকের বিখ্যাত উক্তি; যা শ্রীশ্রীঠাকুরের খুবই প্রিয় উক্তি ছিল। তিনি প্রায়ই কথাপ্রসঙ্গে ভাবময় অবস্থায় উদাত্ত কণ্ঠে তা বলতেন, "There are more things in heaven and earth, Horatio, than are dreamt of in your philosophy," যার অর্থ "স্বর্গ ও পৃথিবীর মাঝখানে আরও বহু জিনিস আছে, হোরেশিও, যা তোমার দর্শনের পাল্লার বাইরে ও অতীত।"
ঠিক তেমনি একটা ঘটনার কথা আজ আমি বলবো আমার প্রিয়জনদের কাছে।

কয়েকদিন ধরেই একটা জরুরী কাজে দেওঘরে যাবার একটা কথা চলছিল। মেয়ের সম্প্রতি নোতুন কোম্পানিতে ডিরেক্টর পদে নিয়োগ পত্র পেয়েছে। সেই ব্যাপারে সৎসঙ্গের আচার্যদেব শ্রীশ্রীবাবাইদাদার সম্মতি ও আশীর্বাদ প্রয়োজন। আজ চাকরী জীবনে ১৩বছর অতিক্রম করেছে মেয়ে আমার। প্রায় প্রথম থেকেই আচার্যদেবের নির্দেশমতো ও আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে চাকরী জীবন অতিবাহিত ক'রে চলেছে। আজ পর্যন্ত প্রতিবারই যখনই যতবার চাকরী জীবনে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে ততবারই মেয়ে আমার ছুটে ছূটে চ'লে গিয়েছে শ্রীশ্রীআচার্দেবের কাছে আচার্যদেব আচার্য পদে অভিষিক্ত হওয়ার অনেক আগে থেকেই এবং আজ পর্যন্ত। এই একই ব্যাপার আমার ছেলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই এবারও আজ ছুটে গিয়েছে মেয়ে। কারণ কোম্পানি থেকে জয়েন করার চাপ দিচ্ছে। এর আগে প্রায় ৮-৯ বছর আগে কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীআচার্যদেব মেয়েকে বলেছিলেন, 'তুই অনেক বড় জায়গায় যাবি।' আজ এই অল্প বয়সে কোম্পানির ডিরেক্টর পদে উত্তীর্ণ হওয়ার ঘটনা আচার্যদেবের ভবিষ্যৎ বাণীকে প্রমাণ করে। একবার পরমপুজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদা বলেছিলেন, "বাবাই বাকসিদ্ধ পুরুষ" (শ্রীশ্রীআচার্যদেব বাকসিদ্ধ পুরুষ)। আজ পূজ্যপাদ শ্রীশ্রীদাদার মুখনিঃসৃত কথা "বাবাই বাকসিদ্ধ পুরুষ" সত্য প্রমাণিত হ'লো।
কয়েকদিন আগে শ্রীশ্রীআচার্যদেব ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে ত্রিপুরা হ'য়ে কুচবিহার যাওয়ার পথে কলকাতায় অমরধামে এসেছিলেন এবং একদিন থেকেই পরদিন চলে গিয়েছিলেন। সেইবার দর্শন হয়নি কলকাতায়। এবার আবার ২০ তারিখের পর বেরিয়ে যাওয়ার কথা। সম্ভবত ত্রিপুরার বরাক ভ্যালিতে আচার্যদেবের দীক্ষাদান অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে।

যাই হ'ক সেইমতো তড়িঘড়ি টিকিট কেটে যাওয়ার দিন স্থির হ'লো আজ (১৪ই জানুয়ারী'২০২৩ শনিবার)। প্রতিবার আমরা যখনই যাই পুরো পরিবার যাই। কিন্তু এবার যেহেতু চটজলদি যাওয়ার সিদ্ধান্ত হ'লো সেইহেতু আমার স্ত্রী আর মেয়ে রওয়ানা দিল। পেটের ইনফেকশানে কোমরে ব্যথার কারণে এইবার আমার প্রথম যাওয়া হ'লো না। ছেলে-বৌমা ও জামাই চটজলদি যাওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ায় ছুটির ব্যবস্থা করতে পারেনি; তাই এবার যাওয়া হ'লো না।
এবার আসি আসল কথায়। সকালবেলা স্ত্রী ও মেয়ে রেডি হ'য়ে যখন বের হ'লো তখন ১টা ১৫মিঃ। ২টো ৫মিঃ-এ হাওড়া থেকে ছাড়বে হাওড়া-পাটনা জন শতাব্দি এক্সপ্রেস (১২০২৩)। কিন্তু যখন গেট দিয়ে বেরোতে যাবে তখন একজন অপরিচিত মানুষ গেট খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ফ্ল্যাট বাড়ি। ২৪টা ফ্যামিলি থাকে। গেটে প্রত্যেক ফ্ল্যাটের কলিং বেল আছে। আমার স্ত্রী বের হওয়ার সময় সেই যুবককে জিজ্ঞেস করলো আপনি কোথায় যাবেন? উত্তরে সে জানালো সে থার্ড ফ্লোরে যাবে। তখন স্ত্রী সেই অপরিচিত যুবককে বললো আপনি ঐ ফ্লোরের কলিং বেল টিপুন্‌, যখন ফ্ল্যাটের লোক আসবে তখন আপনি ঢুকবেন। এরপরে গেটে তালা দিতে গেল আমার ছেলে। যুবকটি জবরদস্তি করতে লাগলো ভেতরে যাওয়ার জন্য। বললো সে কলিং বেল টিপেছে। সেইকথা শুনে ছেলে তাকে লোক আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললো। কিন্তু সে বললো, সে টিচার, ঐ ফ্ল্যাটের ছেলেকে পড়ায়, প্রতিদিন আসে। যুবকটির কথা বলার ধরণ দেখে ছেলে তাকে বুঝিয়ে বলতে গেল যেহেতু সে তাকে চেনে না সেইহেতু সে অ্যালাও করবে না তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিতে। এই নিয়ে শুরু হ'লো অকারণ তর্কাতর্কি, জেদাজেদি। ইতিমধ্যে এসে পড়েছে ঐ ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ভদ্রলোক এবং ভদ্রলোকের মেয়েরা। ভদ্রলোকের বয়স ৭০বছর উর্ধ্বে। উনি অবাঙালি। এই ফ্ল্যাটের ২৪টা ফ্যামিলির মধ্যে ২২টা ফ্যামিলিই অবাঙালি। ভদ্রলোক এসে ছেলেকে উনার বাড়ির টিচারকে কেন আটকেছে তাই নিয়ে অযৌক্তিকভাবে চার্জ করতে লাগলেন। মেয়েরাও সঙ্গে সঙ্গে ছেলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো মাষ্টারকে আটকানো আর তাদের বাবাকে অপমান করার জন্য। ব্যাপারটা হ'য়ে গেল চোর কোতোয়ালকে ডাঁটে মতন। ছেলে পরিস্থিতি বোঝাবার চেষ্টা করলো। প্রেস্টিজ, ইগোর থেকে যে ফ্ল্যাটে প্রবেশের নিয়ম ও সিকিউরিটি সিস্টেম অটূট রাখা জরুরী ও বড়ো প্রশ্ন সেই ব্যাপারটা বোঝাতে ব্যর্থ হ'লো। বোঝাতে ব্যর্থ হ'লো ফ্ল্যাটের ইউনিটি আউটসাইডারের জন্য-- সে যেই-ই হ'ক---যেন নষ্ট না হয়, যেন নিজেদের মধ্যে ডিভিশন না হয়। ততক্ষণে সময় গড়িয়ে গেছে। আমি চেঁচামেচি শুনে নীচে নেবে এলাম এবং ব্যাপারটা হাতজোড় ক'রে থামাবার চেষ্টা করলাম আর স্ত্রী-মেয়েকে বললাম, অনেক দেরি হ'য়ে গেছে, টোটো দাঁড়িয়ে আছে, চ'লে যেতে। তখন সময় ১টা ৩০মিঃ মতো আর ট্রেন ছাড়তে ৩৫মিঃ বাকী। এরপরে অনেক ঘটনা আছে। সেগুলি আর বললাম না।

ফাস্ট ফ্লোরে নিজের ফ্ল্যাটে এসে যখন বসলাম তখন একটু পড়েই মেয়ের ফোন এলো স্টেশন থেকে। লোকাল ট্রেনের সময় জানতে চাইলো। আমি ছেলেকে বললাম সার্চ করতে। ট্রেন যখন এলো তখন ঘড়িতে পৌনে দু'টো ( ১টা ৪৫মিঃ)। আর হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়বে ২টো ৫ মিঃ-এ ( তখন হাতে আর ২০মিঃ বাকী) এইকথা জেনে আমি আর ছেলে শঙ্কিত হ'য়ে পড়লাম। কি আর করবো। ঠাকুরের মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ের মতো নাম করতে লাগলাম। মনে মনে ঠাকুরকে ডাকছি আবার ঠাকুরের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আর ভাবছি, বাড়ি থেকে বেরোবার সময় কেন ওরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলো? ঐ খানেই সময় নষ্ট হ'য়ে গেল। সঠিক সময়ে লোকাল ট্রেনটা ধরতে পারলে হাওড়ায় সময়ে পৌঁছে যেত আর ট্রেনও মিস হ'তো না।

যাই হ'ক ফোন করলাম মেয়েকে। মেয়ে ফোন ধরলো না। ঘড়িতে যখন ২টো ৫মিঃ হ'য়ে গেছে তখন আবার ফোন করলাম কিন্তু তখনও মেয়ে- বউ কেউ ফোন ধরলো। ঘড়ি এগিয়ে চললো। ১মিঃ ১মিঃ ক'রে সময় এগোতে এগোতে ২টো ২০মিঃ হ'য়ে গেল তবুও ওপ্রান্ত থেকে কোনও ফোন এলো না। ছেলেকে বললাম নেটে দেখতো ট্রেন ছাড়ার সময় ক'টা এবং কি অবস্থায় আছে। ছেলে নেট সার্চ ক'রে বললো ট্রেন ২টো ৬মিঃ-এ ছেড়ে দিয়েছে এখন ট্রেন গোবরা ছাড়িয়ে দুর্গাপুরের এগিয়ে চলেছে। হতাশ হ'য়ে হাত পা ছেড়ে দিয়ে ব'সে পড়লাম সোফায়। ওদিকে ফোনও ধরছে না কেউ। ছেলে বারবার ফোন ক'রে যাচ্ছে কিন্তু ফোন কেউ ধরছে না।

তারপর ঘড়িতে যখন ২টো বেজে ৪০মিঃ তখন হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ও প্রান্ত থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল মেয়ে খুব হাঁপাচ্ছে। বললো, পড়ে ফোন করছি। এইমাত্র ট্রেন ছেড়েছে। আমরা এখনও সিটে বসিনি। সিটে ব'সে, পড়ে ফোন করবো।

এ কথা শুনে ঠাকুরের ফটোর দিকে তাকিয়ে হু হু ক'রে উঠলো বুকের ভেতরটা। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এলো জল। মন বললো, এও কি সম্ভব!?
কিছুক্ষণ পর মেয়ে পুনরায় ফোন করলো। এখন মেয়ের স্বাভাবিক গলা। সিটে ব'সে আছে। ট্রেন ছুটে চলেছে দ্রূতগতিতে। তখন তার কাছ থেকে যা জানতে পারলাম তা হ'লো, লোকাল ট্রেন যখন হাওরায় ঢুকেছে তখন সময় ২টো ১৫মিঃ। যেতে হবে ২নম্বর প্ল্যাটফরম থেকে ৯ নম্বর প্ল্যাটফরম। স্ত্রী বললো, ট্রেন তো ছেড়ে দিয়েছে এখন আর গিয়ে কি হবে চল ফিরে যাই। মেয়ে বললো, ফিরে তো যেতে হবেই, চলো একবার প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘুরে আসি। ঐ ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি ক'রে মেয়ে আর স্ত্রী যখন ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছল তখন দেখলো একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞেস ক'রে জানতে পারলো ট্রেনটি জন শতাব্দী এক্সপ্রেস। গ্রিন সিগন্যাল নেই তাই ট্রেন ছাড়েনি। চমকে উঠে দৌড় লাগালো মেয়ে আর বউ। তাদের B14 কম্পার্ট্মেন্ট প্ল্যাটফর্মের একেবারে সামনের দিকে। গোটা প্ল্যাটফর্মটা তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেল। ভয়, এই বুঝি ট্রেন ছেড়ে দেয়। এই বুঝি তীরে এসে তরী ডুবে গেল। এই বুঝি চোখের সামনে ট্রেন হাতছাড়া হ'য়ে যাবে। প্রাণপণে ঠাকুরের নাম করতে করতে দৌড়ে এগিয়ে গেল দু'জনে। গোটা প্ল্যাটফর্মে দু'জনে ছুটে চলেছে! তারপর B14 কম্পার্টমেন্টের সামনে এসে পড়িমরি ট্রেনে উঠে গেল আর ঠিক সেইমুহুর্তেই ট্রেন উঠলো দুলে, গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে ট্রেন এগিয়ে চললো ধীরে ধীরে সামনের দিকে। চুপ ক'রে দাঁড়িয়ে রইলো স্ত্রী আর মেয়ে দরজার সামনে। তারপরে ধাতস্থ হ'য়ে নিজেদের সিট খুঁজে নিয়ে সিটে গিয়ে বসলো। জানালার সামনে ব'সে আনমনে চেয়ে রইলো বাইরের দিকে। একে একে সরে যাচ্ছে ঘর বাড়ি, পথঘাট, গাছপালা আর বাতাস কেটে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন ৩০মিনিট পিছনে চলা সময়কে অতিক্রম করার জন্য, ছুটে চলেছে দেওঘরের জসিডি স্টেশনের দিকে। অনেকক্ষণ চুপ ক'রে রইলো দু'জনে। তারপরে ফোন করলো মেয়ে আমাকে। কৃতজ্ঞ চিত্তে দয়ালের দয়ার কথা স্মরণ ক'রে ভেজা গলায় সবিস্তারে বললো উপরের ঘটনাটা।
শ্রীশ্রীঠাকুরের ছবির দিকে অশ্রুসজল চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে গেল ঠাকুরের কথা।

দয়াল ঠাকুর দুঃখ ক'রে বলেছিলেন, "তোদের আমি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যে ছোটো ছোটো কত রকমভাবে রক্ষা ক'রে চলেছি তার ইয়ত্তা নেই।"
চোখ দিয়ে দু'ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো হাতের তালুতে।
(লেখা ১৪ই জানুয়ারী ২০২৩)

No comments:

Post a Comment