'কেউ অপরিহার্য নয়' এই বিকৃত, অবাস্তব, অবৈজ্ঞানিক দর্শন গ্রহণ করার ফল কি হয়েছিল তা পরবর্তী কাহানীতে তুলে ধরা হ'ল।
আবার ভারত তথা এশিয়ার একসময়ের বৃহৎ অটোমোবাইল শিল্প হিন্দুস্তান মোটর্স-এর দিকে যদি ফিরে তাকানো যায় তাহ’লে দেখতে পাবো যখন সি কে বিড়লা কারখানার মালিকানার অধিকার লাভ ক’রে কারখানায় পা রাখলো ১৯৮০ সালে তখন পা রেখেই তিনি কারখানার দীর্ঘদিনের মালি অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টার যিনি তিল তিল করে প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষনের মধ্যে দিয়ে প্রচন্ড শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমে কারখানার শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন তাঁকেই ইউনিয়নগুলির নেতৃবৃন্দের সহায়তায় কারখানার কর্তৃত্ব থেকে সরাবার জন্য আদা জল খেয়ে লাগলেন। যে মালীর আঙ্গুল ধরে একদিন ছোট্ট ছেলেটি হিন্দমোটর নামক বিশাল টাইটানিক জাহাজরুপী কারখানা ঘুরে বেড়িয়েছিল সেই ছোট্ট ছেলেটি যৌবনে পা দিয়েই কারখানার মালিক হওয়ার অধিকারে সেই দীর্ঘদিনের মালীকে চূড়ান্ত অপমান করে কারখানা থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছিল। চোখের জল চেপে রেখে, বুকের ব্যথা বুকে লুকিয়ে রেখে কারখানার শ্রীবৃদ্ধির জন্য জীবন যৌবন সম্পুর্ণভাবে সঁপে দেওয়া পেসমেকার বুকে নিয়ে সেই যে মানুষটি কারখানার বাইরে পা রেখেছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে সেই মানুষটি আর কোনোদিন পিছন ফিরে তাকাননি সেই নিজের হাতে তৈরী অ্যাম্বাসাডার, ট্রেকার, কন্টেসা ও বেড ফোর্ড গাড়ীর যন্ত্রাংশ তৈরি ও সেই যন্ত্রাংশ পরস্পর যুক্ত করার বিশাল স্বয়ংসম্পুর্ণ কারখানার দিকে। সেদিন হিন্দমোটর কারখানার আকাশে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়েছিল মা অন্নপূর্ণা যেন সেদিন নীরবে চুপি চুপি বেরিয়ে গেছিল কারখানা থেকে ঐ মালীরুপী কারখানার প্রেসিডেন্ট এস এল ভাট্টারের পিছু পিছু। যা আজ দিনের আলোর মত ভয়ংকর স্পষ্ট হিন্দমোটর নামক অটোমোবাইল শিল্পে। আর সেই মালীর জায়গায় ব্যবসা পরিচালনা ও অটোমোবাইল শিল্পসম্পর্কে সম্পুর্ণ নূতন, অনভিজ্ঞ ‘কাল কা যোগী’ সি কে বিড়লা এনে বসিয়েছিলেন শঙ্কর নারায়নন ও শান্তারাম নামী দুই আধুনিক ম্যানেজমেন্টের দিকপালকে। যাদের আধুনিক চিন্তাধারার মর্মস্পর্শী উদাহরণ আজকের বীভৎস কঙ্কালসার হিন্দমোটর অটোমোবাইল শিল্প। তখন কারখানা জুড়ে ঝড়ের বেগে সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছিল বর্তমান আধুনিক ম্যানেজমেন্টের যুগে মান্ধাতার আমলের ম্যানেজমেন্টের পরিচালক, উত্তরপাড়া থেকে কোন্নগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল কারখানার রুপকার ভাট্টারজী না-কি বেমানান! হিন্দুস্তান মোটর্সের উত্তরপাড়া প্ল্যান্টের বাগিচায় ‘শান্তারাম’ নামী নূতন ময়ূর পুচ্ছধারী দাঁড়কাকের আগমন ঘটেছে যাকে শ্রমিক কর্মচারীর পক্ষ থেকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘অরণ্যদেব’! সবার চোখেমুখে এক নূতন আশা, স্বপ্ন এই ‘মসীহা’ অরণ্যদেবের হাত ধরে হিন্দমোটরের বুকে নেবে আসবে আধুনিক গাড়ীর স্বর্ণযুগ! ‘অরণ্যদেব’ শান্তানামের হাত ধরে শ্রমিক কর্মচারীর জন্য ‘আচ্ছে দিন আ রহি হ্যায়’ এই অলৌকিক স্বপ্নালু কথাটা শুনেছিলাম সেই নব্বই-এর দশকে আর শুনেছিলাম আরও একটা অদ্ভুত অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক কথা যা হিন্দমোটরের আনাচে কানাচে ম্যানেজমেন্টের শীর্ষস্তর থেকে শ্রমিক-কর্মচারীর তৃণমূলস্তর পর্যন্ত সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে, অস্তিতে-মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল নিখুঁত প্রচারের মধ্যে দিয়ে সমস্ত বাম-ডান পন্থী ট্রেড ইঊনিয়নের নেতৃবৃন্দের সহযোগীতায় নূতন ম্যানেজমেন্টের নেতৃত্বে তা হ’ল “কেউ অপরিহার্য নয়”!!!!! আর সবাই আপামর শ্রমিক-কর্মচারী ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল সত্যিই এই পৃথিবীতে, এই জীবনে “কেউ অপরিহার্য নয়”। তাই এস এল ভাট্টারের অবর্তমানে কোম্পানীর ও কোম্পানীর শ্রমিক কর্মচারীর কোনও ক্ষতি হবে না। আর আজ সেই দর্শনের পচা দুর্গন্ধে হিন্দমোটরের শ্রমিক-কর্মচারীর জীবন তছনছ হয়ে গেছে। শাবাশ সি কে বিড়লা শাবাশ! শাবাশ আপনার জীবন দর্শন! শাবাশ আপনার ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ শয়তানি উপলব্ধি! শাবাশ আপনার ব্যবসায়ীক দূরদর্শিতা আর আপনার ধ্বংসলীলার অভুতপুর্ব দক্ষতা-যোগ্যতা। শাবাস শঙ্কর নারায়নন শাবাশ! শোনা গেছিল সেই সময় কোম্পানীর আনাচে কানাচে, সত্যি মিথ্যে জানিনা, কোম্পানীর বৃদ্ধির জন্য, প্রতিযোগীতার বাজারে কোম্পানীকে টিকিয়ে রাখার জন্য, আধুনিক ম্যানেজমেন্টের আধুনিক নূতন গাড়ী বের করার উদ্যোগের জন্য, ছোটাছুটির জন্য আপনি কোনও পুরস্কার পান আর না পান বছরে প্লেন চড়ার জন্য, প্লেন কোম্পানীকে সর্বাধিক পে করার জন্য আপনি প্লেন কোম্পানী থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন। শাবাশ শান্তারাম শাবাশ! শ্রমিক-কর্মচারীর সামনে মৃত্যুদেবের আড়ালে অরণ্যদেব হ’য়ে আবির্ভূত হওয়া! কারখানায় না আসা শংকরনারায়নের মত দিল্লীতে বসেই মডার্ন ম্যানেজমেন্টের বিজ্ঞানসম্মত শক্তিশালী হাতিয়ার ‘অপ্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণ’-এর সাহায্যে কারখানা পরিচালনের অসীম ক্ষমতা অর্জন ও দিল্লী থেকে বসে বসেই একজন রঙের কারখানার ননইঞ্জিনিয়র অযোগ্য ও অদক্ষ শুধু নয় আপাদমস্তক অভদ্র কর্মচারীকে উত্তরপাড়া প্ল্যান্টের মাথার ওপর বসিয়ে তাঁকে দিয়ে অটোমোবাইল শিল্পকে এবং হিন্দমোটরের পুরোনো দীর্ঘদিনের অটোমোবাইল শিল্পে অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ সমস্ত উচ্চপদস্থ ইঞ্জিনিয়রদের, শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিচালনা করার দুঃসাহসের জন্য শাবাশী জানাই শান্তানামকে। সেই সময় তাৎক্ষণিক প্রমাণ হয়েছিল সত্যিই ‘কেউ অপরিহার্য নয়’ এই দর্শন! কিন্তু তার থেকেও বড় যা, সত্য যা ‘সময় সবসে বড়া বলবান’ তা’ও প্রমাণ হয়েছিল বা হয়েছে, আজ যা নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। অ্যাম্বাসাডার গাড়ী কারখানার মালিক বি এম বিড়লার সহযোগী এস এল ভাট্টারের অপসারণের পরেই শুরু হ’য়ে যায় কারখানা ধ্বংসের ব্লু প্রিন্ট যা অর্থাৎ কারখানার বিশাল এলাকা আজ শ্মশানের ঘোর অন্ধকার ও নিস্তব্ধতাকে হার মানায়! আর কারখানার সেই ঘোর অন্ধকার নিস্তব্ধ বিশাল কার অ্যাসেম্বলি, ফাউন্ড্রি, ফোর্জ প্ল্যান্ট, ইঞ্জিন প্ল্যান্ট, মেশিন শপ, প্রেস শপ, প্লেটিং শপ সহ বড়ো ছোট অনেক ডিপার্টমেন্ট সঙ্গে বিশাল জেনারেল স্টোর, সিকিউরিটি অফিস, বিশাল অ্যাডমিনিষ্ট্রেটিভ বিল্ডিং যাকে বলা হ’ত মেইন অফিস, বিশাল দোতলা ক্যান্টিন, হাসপাতাল, কলোনি মেইন্টেন্যান্স ইত্যাদি চারপাশ থেকে ঘূর্ণির মত ব্যঙ্গের সুরে ভেসে আসে যেন একটাই কথা ‘কেউ অপরিহার্য নয়’! ‘কেউ অপরিহার্য নয়’!!
ক্রমশঃ (লেখা ২১শে ফেব্রুয়ারী'২০১৫)
No comments:
Post a Comment